
ফুলগুলো হুমায়রার জন্য
ছোটগল্পঃ ফুলগুলো হুমায়রার জন্য
আ’লেমা মেয়ে বিয়ে করেছে জহির। বিয়েটা করতে একরকম বাধ্যই হয়েছে সে। পরিবারের চাপে। জহিরের বাবা হারুন সাহেব এককথার মানুষ। যা বলবেন তা-ই। মেয়ে দেখা শেষ হতেই তিনি বললেন,
: দেখেছ ভালো করে?
: জ্বী। চিনচিনে গলায় বলল জহির।
: এই মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে তোমাকে। তবেই যদি তোমার স্বভাব-চরিত্রের কিছুটা উন্নতি হয়। মনে রেখ হে! আমার কথার অন্যথা হবে না, বলে দিলাম!
বিয়েটা করে জহিরের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। বিয়ের দ্বিতীয়দিনে, রাত করে ঘরে ফিরতেই হুমায়রা বলে উঠল,
: কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?
জহির মনে মনে ক্ষিপ্ত। বিয়ে হয়েছে চব্বিশ ঘন্টার বেশি হয় নি! এখনই এই মেয়ে খবরদারী শুরু করে দিয়েছে।
: বাইরে ছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে।
: এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা ঠিক নয়। দিনকাল ভালো না।
মাদ্রাসার মেয়ে। বিয়েবহির্ভুত ভালোবাসাবাসির মধ্য দিয়ে যায় নি কখনো। এগুলো ‘পাপ’ জেনে এসেছে সে। একদিনেই যে এই মেয়ে জহিরকে ভালোবেসে ফেলেছে, কেয়ারিং-শেয়ারিং এর ভিতর দিয়ে যেতে চাচ্ছে- এটা জহির বুঝল না।
কথাটা সে নিল ‘প্যারা’ হিসেবেই। কপালকুঞ্চন করে মনে মনে বলল,
: কী বিপদ! বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাও দেয়া যাবে না? এতদিনের বন্ধুত্ব এক রাত্রেই ভুলে যেতে হবে!
“এটা করা যাবে না, ওটা ঠিক নয়, এখন থেকে নামাজ-রোজা, দাড়ি-টুপি এগুলোর অভ্যাস করলে ভালো হয়”- দিন যাচ্ছিল এভাবেই। প্রতিদিন একই কথা শুনতে শুনতে জহির তিতি বিরক্ত হয়ে গেল।
প্রতিদিনই ইচ্ছে করে, মুখের ওপর বলতে,
: এই মেয়ে, তুমি যে আমাকে জ্বালিয়ে মারছো, সেটা কি বুঝতে পারছো?
বলা হয়ে ওঠে না। মনের কথা মনেই রেখে দিতে হয়। মনের মধ্যে না রেখে উপায়ও নেই! বাবাকে এই মেয়ে নালিশ করে দিবে নিশ্চিত।
কিন্তু আজ সকালে যেটা ঘটল!
সেটা কি সহ্য করা যায়?
হুমায়রার চাপে আর বাবার চেঁচামেচির উত্তাপে ফজরের সময় উঠতেই হল জহিরকে।
নামাজের পর বাসায় ফিরে হুমায়রাকে জহির বলল,
: আমার কালো পাঞ্জাবীটা দাও।
: কেন? হঠাৎ কালো পাঞ্জাবী কেন?
: শহীদ মিনারে যাব। ফুল দিতে।
: ফুল দিলে কী হবে? শহীদদের আত্মা কি শান্তি পাবে? তারচে বরং…
জহির ক্ষেপে গেল। অবেলায় ঘুম ভাঙাতে এম্নিতেই ‘খাট্টা’ মেজাজে আছে সে। বলল,
: শুরু হয়ে গেল নীতি কথা?…অনেক হয়েছে।… আমাকে আর জ্বালিও না, প্লীজ!… মুক্তি চাই আমি।
হুমায়রার মন খারাপ হয়ে গেল ঝুপ করে। জহির বের হয়ে যেতেই চোখ ভিজে ওঠল অভিমানে- আমি জ্বালাই! এই ছিল তোমার মনে?
শহীদ মিনারের আশপাশ লোকে লোকারণ্য। জহির একতোড়া ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে ভিড়ের মধ্যে। সামনে এগুতে পারছে না। ওর মন প্রচন্ড খারাপ। ভিড় ঠেলতে হচ্ছে বলে নয়, হুমায়রার জন্য। ধমক খেয়ে বেচারি কষ্ট পেয়েছে। ফর্সা চেহারায় বিষন্নতার মেঘ এসে ছেয়ে গিয়েছিল মুহূর্তেই।
হুমায়রার মিষ্টি কন্ঠে বলা কথাগুলো কানে বাজছে- “ফুল দিলে কী হবে? শহীদের আত্মা কি শান্তি পাবে?”
জহির ভিড় থেকে বের হয়ে উল্টো দিক হাঁটা দিল। হাতে ফুলের তোড়া। শাহবাগের ফুলের দোকান থেকে একশ টাকায় কেনা হয়েছিল। কী করবে এটা? ফেলে দিবে?
জহিরের বিবেক বলে উঠল,
: ফেলে দিবি কেন? ফুলগুলো বউয়ের হাতে দিয়ে বলবি, ভালোবাসি তোমায়। আর ভাষা শহীদদের জন্য- দুই রাকাত নামাজ।…ব্যস!
বউও খুশী, শহীদদের আত্মারও শান্তি। এক ঢিলে দুই পাখি মারার এই সুযোগ হেলায় হারাবি কেন, বল!
(ওহো! ‘ছোটগল্প’ লিখতে গিয়ে বড় করে ফেললাম মনে হয়!)
—প্রিয় লেখক মাহিন মাহমুদ ভাইয়া।