‘দুনিয়াবী পড়াশোনা’কে ইবাদাতে পরিণত করা-৫

(পূর্বের পর্বগুলি ১ম পর্ব     ২য় পর্ব     ৩য় পর্ব   ৪র্থ পর্ব     ৫ম পর্ব   ৬ষ্ঠ পর্ব   শেষ পর্ব )

আজকে ২য় পয়েন্টটা লেখার কথা। কিন্তু হঠাৎ করেই ১ম পয়েন্টের আর একটা উদাহরণ মনে পড়লো- হিল্লা বিয়ের আইনটা। আমার ছোট বেলায় নাটক সিনেমার একটা কমন দৃশ্য ছিলো যে স্বামী এসে ভাত চেয়েছে, বউ বলেছে ভাত হয় নাই, স্বামী রেগে গিয়ে যাহ তোরে আমি তালাক্ব দিলাম বলে তিন তালাক্ব দিয়ে দিলো। আর মেয়েটা আল্লাগো বলে একটা চিল্লান দিলো। তারপর তাদের হিল্লা বিয়ে হল ইত্যাদি নানা কিছু। আসলে কি তালাক্বের ব্যাপারটা এমন? IOU তে Fiqh of Marriage কোর্সে যখন বিয়ে এবং তালাক্বের নিয়ম বিস্তারিত পড়েছিলাম, আমার পুরা মুখ হা হয়ে গিয়েছিলো। নিয়মটা কী, আর আমরা জানিটা কী!

যাই হোক, এবার ২য় পয়েন্টে আসি।

দ্বিতীয়ত,বেশ কিছু ব্যাপারে ইসলামী আইনের প্রজ্ঞা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কেন ইসলামী আইন কোনো একটা কিছুর বিধান দিয়েছে সেটা প্রচলিত আইনের সাথে তুলনা করে ইসলামী আইনের Superiority তুলে ধরা যায়। যেমন ধরুন মৃত্যু দণ্ড প্রথাটা বর্বর মনে করে অনেক দেশই এখন এটাকে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু কার্যকারিতার দিক থেকে চিন্তা করলে এবং অর্থনৈতিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করলে মৃত্যু দণ্ড বেশী কার্যকরী পন্থা। আমার ইউনিভার্সিটির ইকোনোমেট্রিক্স এর প্রফেসরের রিসার্চ পেপার আছে ২টা এটার উপর। মজার ব্যাপার হচ্ছে এটা নিয়ে পেপার নাই বললেই চলে। মুসলিমদের তো প্রশ্নই উঠে না, নন-মুসলিমদের মাঝেও নাই। এটা জাস্ট একটা ছোট্ট উদাহরণ যা আমার মত Non-specialist এর মাথায় এসেছে।

তৃতীয়ত, ‘ল’ ফিল্ডটার Evolution নিয়ে কাজ করতে পারেন কেউ। দেখাতে পারেন যে আজকে যত মানব রচিত আইন আছে সেটার উৎস কোনো না কোনোভাবে কোনো ধর্মীয় গ্রন্থের ( যেমন বাইবেলের 10 commandments) সাথে সম্পর্কিত। তাই আজকে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা যতই অস্বীকার করা হোক না কেন, মানুষের পক্ষে একদম Scratch থেকে শুরু করা আসলে সম্ভব না।

আরো দেখানো যেতে পারে যে ‘আইন’ করে সমাজের সব Disaster প্রতিরোধ করা যায় না, নৈতিকতার প্রসার অপরিহার্য আর সেটা ধর্মীয় প্রভাব ছাড়া সম্ভব না।

চতুর্থত, যে ল ফিল্ডটা নিয়ে পড়েছে তার বুঝা উচিৎ আগে কোনো এক সময়ে কোনো কোর্টে দেয়া রায় পরবর্তীতে বিচার করার সময় আইনের একটা উৎস হতে পারে, কিন্তু সেটার সাথে তুলনা করে আজকে রায় দেয়ার সময় অবশ্যই সময়, পরিস্থিতির পরিবর্তন, সাথে আগের কেসের সাথে এই কেসের পার্থক্য বিবেচনা করতে হয়। যে এটা বোঝে, সে মনে হয় ফতওয়া এবং শরীয়াহর মাঝে পার্থক্যটা বুঝতে পারবে সবচেয়ে সহজে!

আল্লাহ ভালো জানেন কিন্তু আমার কাছে মনে হয় যে আজকের প্র্যাক্টিসিং মুসলিমদের মাঝে একটা সমস্যা মহামারীর মত ছড়িয়ে গেছে, সেটা হচ্ছে ফতওয়া এবং শরীয়াহর মাঝে পার্থক্য বুঝতে না পারা। ফতওয়া By definition একটা পরিস্থিতিতে, একটা সময়ে, একটা জায়গায় একটা মানুষের জন্য দেয়া একজন স্কলারের opinion. সেই ফতওয়া আরেকজন মানুষ যার পরিস্থিতি, সময়, দেশ আলাদা তার জন্য প্রযোজ্য হবে নাকি সেটা চিন্তা না করেই আমরা একটা ফতোয়ার ওয়েবসাইট থেকে ফতওয়া কোট করে দিয়ে দেই। আমি নিজে Islam QA থেকে প্রচুর ফতওয়া কোট করি, কিন্তু সেটাকে ঐশী বাণীর মর্যাদা দেই না, মানে সেটা মন দিয়ে পড়ি এবং আমি যে পরিস্থিতিতে আছি আর প্রশ্নকর্তার পরিস্থিতির মাঝে বিশাল কোনো পার্থক্য আছে নাকি সেটা বোঝার চেষ্টা করি। ফতওয়া শপিং করছি নাকি সেটাও খেয়াল রাখার চেষ্টা করি। এই ফ্রি মিক্সিং নিয়ে Islam QA এর ফতওয়ার কথাই চিন্তা করুন (আমি এটা খুব মন দিয়ে পড়েছি) – এখানে কিন্তু ছেলে এবং মেয়ের উভয়ের জন্যই কো এডুকেশনে পড়া হারাম বলা হয়েছে, তারপর বেশ কিছু ব্যতিক্রমও দেয়া হয়েছে। ( https://islamqa.info/en/45883) আমরা এই ব্যতিক্রম গুলার কথা বলিনা, আমরা এই বিধান শুধু মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেই এটা বলে যে ছেলেদের জন্য আয় করা ফরয। অথচ এই exception এর কথা কিন্তু ফতয়াতে বলা নাই।

আমরা যদি এই ফতওয়াটার শরীয়াহ Evidence চিন্তা করি তাহলে দেখবো যে এখানেও কিন্তু Intermingling কে নিষেধ করে Evidence দেয়া হচ্ছে। আমি বারবার বলছি যারা কো এডুকেশনে পড়ে Intermingling Avoid করতে পারবে, এই পোস্ট তাদের জন্য।

এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা দরকার মনে হচ্ছে- Intermingling এর বিপক্ষে তুলে ধরা মূল Evidence হচ্ছে সেই বিখ্যাত হাদীস যে মেয়েরা ছেলেদের জন্য সবচেয়ে বড় ফিতনা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো হাদীসের ব্যাপারে আমার মনে কোনো ধরণের দ্বিধা, ক্ষোভ নাই আলহামদুলিল্লাহ, কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয় যে এটা একটা misquoted হাদীস। মেয়েরা ঠিক কী করলে ফিতনা হয় এটার একটা সীমা আমরা নিজেদের ইচ্ছামত ঠিক করে নিয়েছি। ইচ্ছামত বলছি কারণ কিছু ভাইকে আমি দেখি যে বোরখার ডিজাইন নিয়ে আলোচনা করতে করতে শহীদ হয়ে যাচ্ছেন। আজকে যেখানে ইন্টারনেটে একটা ক্লিক করলে নারীদেহের A-Z দেখা ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব সেখানে তাদের জন্য আপাদমস্তক ঢাকা মেয়েরাও ফিতনা বোরখার রঙ এর জন্য বা বোরখার ডিজাইনের জন্য। এ

কটা বোরখা পরা মেয়ের দিকে অনুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে না তাকালে এগুলো বোঝার কথা কী না আল্লাহই ভালো জানেন। ( যখন আমি ইসলামের ধারে কাছে ছিলাম না তখন হাম তুম একটা হিন্দি সিনেমায় নায়িকার একটা ডায়লগ ছিলো যা সে নায়ককে বলছিল- কথাটা কেন যেন আজো আমার ব্রেনে গেঁথে গেছে। ডায়লগটা ছিলো এমন- তুমহারা আঁখোমে এক্সরে হ্যাঁ কেয়া, কাপড়া কা আন্দার দেখ সাকতিহো! মানে তোমার চোখে কি এক্সরে আছে যে কাপড়ের মাঝ দিয়ে দেখতে পাও? খুব দুঃখ জনক হলেও কথাটা আমার কিছু কিছু প্র্যাক্টিসিং ভাইদের কথা শুনলে তাদের বলতে ইচ্ছা করে)

কিছু ভাইদের জন্য মেয়েরা ফিতনা হয়ে যান তাদের কণ্ঠ শুনলে। আমি অবশ্যই RJ অথবা সংবাদ পাঠিকাদের কথা বলছি না কারণ আকর্ষণীয় কণ্ঠে নন-মাহরামদের সাথে কথা না বলার নির্দেশ সরাসরি কুরআনে এসেছে। আমি বলছি স্বাভাবিক স্বরে প্রয়োজনীয় কথাতে কী সমস্যা আল্লাহই জানেন। আমি নিজে IOU তে পড়াই, নিয়মিত সেটার লাইভ সেশন নেই, আমার ছেলে ও মেয়ে উভয় Student ই আছে, আমার চেহারা দেখানো হয় না, আমি পারত পক্ষে চেষ্টা করি কণ্ঠের পর্দা বজায় রাখার জন্য, আল্লাহ জানেন পুরাপুরি পারি নাকি, কিন্তু চেষ্টায় ঘাটতি রাখি না……এখন এতেও যদি কারও সমস্যা হয়, আমার করার কিছু নাই। আসলেই নাই। কারণ আমি কোনো নাট্য কলা বা বিনোদনের কিছু পড়াই না, আমি আজকের অর্থনীতিতে সুদ কোনটা আর কোনটা না, এগুলা নিয়ে পড়াই, কারো যদি মেয়েদের কণ্ঠ শুনলে তাকে ফিতনা মনে হয় তাহলে তাদের জন্য চারটা অপশন আছে- ১। নিজেরা এই ডিসিপ্লিন নিয়ে পড়ে ছেলেদের জন্য ছেলে বিকল্প তৈরি করা ২। অলরেডি আছে এমন ছেলেদের কাছে যাওয়া ( আমি মুসলিম অর্থনীতিবিদ খুব কম দেখি চারপাশে- ছেলে হোক বা মেয়ে। ছেলেরা সবাই আজকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা সাইন্সের সাব্জেক্ট পড়তে চায় কারণ তাতে চাকরি পাওয়া সহজ।) ৩। তার ঘরের মেয়েদেরকে মেয়ের ক্লাস করতে দেয়া এবং তারপর তার মাহরাম মেয়ের কাছ থেকে সেই জ্ঞান অর্জন করা (যদি তাতে ইগোতে না লাগে আর কী) ৪। শেষের অপশন সবচেয়ে সহজ। সুদ কি তা না জেনেই সুদের মাঝে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকা………

তবে যাদের বোরখা পরা মেয়ে দেখলে কিংবা মেয়েদের স্বাভাবিক স্বরে বলা প্রয়োজনীয় কথা শুনলেই সমস্যা হয়, তাদেরকে দিয়ে উম্মাহর সেবা কতটুকু হবে বা আদৌ হবে নাকি সেটা একটা চিন্তার বিষয় বৈ কী!

Hamida Mubasshera

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button