কিংবদন্তীদের উপাখ্যান

হলিউডের কোনও অ্যাকশান মুভিই তুমি মিস করো না। তাই না?

অ্যাকশান সিনারিগুলো তোমার চোখকে ধাঁধিয়ে দেয়। স্নায়ুবিক উত্তেজনা এনে দেয়। এসব মুভির নায়কদের তুমি বীর মনে করো। তাদের এটাকিং সিনারিগুলো বারবার দেখো। আর মনে মনে ভাবো, কী অভিনয় রে বাবা! একাই সব গুণ্ডাদের কুপোকাত করে দিচ্ছে।

ভাই আমার! তুমি মুভিতে যেসব নায়কদের বীরের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখো, বাস্তবে তারা কাপুরুষ ছাড়া কিছুই নয়। শতাধিক গুণ্ডা তো দূরের কথা, একটা টিকটিকিকে পরাস্ত করার শক্তিও তাদের নেই। ওদের হিরোগিরি পর্দার ভেতরেই। পর্দার বাইরে ওরা কিচ্ছুনা। একাবারেই জিরো। সামান্য তেলাপোকা দেখলেও ওরা দৌড়ে পালাবে।

আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?

আচ্ছা আমাকে বলতো, বিশ্বের বড়ো বড়ো যুদ্ধাদের কে কে চলচ্চিত্র থেকে উঠে এসেছিলেন?

আমি চলচ্চিত্র থেকে উঠে আসা বড়ো কোনও যুদ্ধার নাম জানি না। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে এমন কাওকেই খুঁজে পাই না, যিনি চলচ্চিত্রের অভিনেতা ছিলেন। অভিনেতাদের মধ্যে বাস্তব জীবনে এমন কাউকেই আমি চিনিনা, যিনি অন্যের জন্যে নিজের জীবনকে বাজি রেখেছেন। শত্রুদেরকে বীরের মতো মোকাবিলা করেছেন। তোমার জানা কেউ থাকলে আমাকে জানাবে।

ভাই আমার! সিনেমার হিরোদের নিয়ে তুমি ঠিকই ভাবো। কল্পনার রঙ তুলিতে তাদের ছবি আঁকো। তাদের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখো। কিন্তু তুমি যে বীর উম্মাহর অংশ, সে কথা কি কখনও ভাবো? তুমি যে বীর পুরুষের উত্তরসূরি, ঘুণাক্ষরেও কি তা স্মরণ করো?

না করারই কথা। আড্ডাবাজি করতে করতে তোমার দিন কেটে যায়। সিনেমা দেখতে দেখতে রাত পেরিয়ে যায়। বিকেলের সময়টা কাটে গার্লফ্রেন্ডের হাত ধরে। তুমি কীভাবে এগুলো উপলব্ধি করবে?

ভাই আমার! একটিবার নিজের পূর্ব-পুরুষদের দিকে তাকাও।

আমি জানি, তুমি ব্যস্ত। তোমার সময় নেই। তুমি মহাব্যস্ত। আজ এই কাজ, কাল ওই কাজ, পরশু ওই মিটিং, এভাবেই তোমার দিন কেটে যায়। তুমি বিরতিহীন ছুটে চলো। পূর্বসূরীদের ইতিহাস পড়ার সময় কোথায় পাবে?

আজ আমাকে খানিকটা সময় দাওনা। একটু সময় চুপটি করে বসো। আমি তোমার পূর্ব-পুরুষদের কিছু কাহিনি শুনাই।

আমি তোমাকে সে সব বীরদের কাহিনি শুনাতে চাচ্ছি, যাদেরকে রাসূলের ﷺ সাহাবা হিসেবে বাছাই করা হয়েছিল। সেই সত্যবাদীদের কাহিনি বলতে চাচ্ছি, যারা তাঁদের রবের সাথে তাঁদের কৃত ওয়াদাকে সত্যে পরিণত করেছিলো।

কাহিনিটা হাজার বছর আগের। চতুর্থ হিজরির ঘটনা। একবার আমের ইবনু মালিক রাসূলের ﷺ সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। সে ছিলো তার গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। যার উপাধি ছিলো ‘মোলায়েবুল আসেন্না’। বর্শা খেলোয়াড়। রাসূল ﷺ আমেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন। তাওহীদের দাওয়াত দেন। আমের সে দাওয়াত কবুল করেনি। অস্বীকারও করেনি।

মনে মনে সে এক ঘৃণ্য চক্রান্ত রচনা করেছিলো। কিছু সাহাবাকে সে নজদের অধিবাসীদের কাছে পাঠানোর অনুরোধ করে। ইসলামের দাওয়াত জন্যে। দাওয়াতের নাম করে সে সাহাবাদের সাথে নিয়ে যায়। সত্তর জন সাহাবা তার সাথে রওনা হন। মোনযের ইবনু আমর (রা) ছিলেন এ জামাতের আমীর।

পথ চলতে চলতে সাহাবারা মাউনার কুয়োর কাছে পৌঁছন। কুয়োটি ছিলো বনী সোলায়ম ও বনী আমের গোত্রের মাঝামাঝি। সেখানেই সাহাবারা তাঁবু করেন। সাহাবাদের একজন ছিলেন হারাম ইবনু মিলহান (রা)। ইবনু মিলহান (রা) রাসূলের ﷺ দেওয়া দাওয়াতনামা সেখানকার গোত্রনেতা আমের ইবনু তোফায়েলের হাতে পৌঁছে দেন।

ইবনু তোফায়েল ছিলেন ইসলামের ঘোরতর দুশমন। সে রাসূলের দেওয়া চিঠিটি খুলেও দেখেনি। ইবনু মিলহান (রা) যখন চিঠিটি তাঁর হাতে পৌঁছে দিচ্ছিলো, তখন সে চোখ দিয়ে এক লোককে ইশারা করে। সে লোকটি ইবনু মিলহানকে (রা) লক্ষ্য করে বর্শা নিক্ষেপ করে। নিক্ষিপ্ত বর্শাটি ইবনু মিলহানের (রা) বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়।

তুমি সিনেমায় এমন অনেক দৃশ্য দেখেছো, তাই না? নায়ককে ভিলেন পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করে। আর নায়ক তখনও সটান দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর ভিলেনের সাথে লড়াই করে।

আচ্ছা, তোমাকে যদি কেউ এভাবে বর্শা দ্বারা আঘাত করতো, তাহলে তুমি কী করতে?

বাবাগো-মাগো বলে চিৎকার করতে থাকতে?

নাকি দৌড়ে পালাতে?

নাকি শত্রুদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে?

তুমি নিজেই এর উত্তর ঠিক করো।

বর্শা নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর হারাম ইবনু মিলহান (রা) কী করেছিলো, জানো?

ইসলামের হিরো ইবনু মিলহান (রা) যখন বর্শা নিক্ষিপ্ত হলেন, তখন সটান সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন।

তিনি শত্রুদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি।

বাবাগো-মাগো বলে চিৎকার শুরু করে দেননি।

দৌড়ে ময়দান ছেড়ে পালিয়েও যাননি।

ইবনু মিলহান (রা) তার বুকের রক্ত শরীরে মাখতে লাগলেন। আর বলতে লাগলেন, ‘আল্লাহু আকবার। কাবার রবের শপথ, আমি সফলকাম হয়েছি।’

এই বলে তিনি তাঁর সাথিদের সাথে মিলিত হলেন। বীরদর্পে যুদ্ধ করতে করতে দুনিয়া থেকে বিদেয় নিলেন।

তুমি ভেবোনা গাজি-কালু-চম্পাবতির পুঁথি থেকে তোমাকে এ গল্প শুনাচ্ছি। কিংবা হলিউডের সিনেমা থেকে ধার করে বলছি। না, এটা পুঁথির কাহিনি নয়। সিনেমার কাহিনিও নয়। নিজের বানানো গল্পও নয়। এটা সহীহ বুখারীতে বর্ণিত সত্যি কাহিনি।[১] এটা ওই তারকার কাহিনি, যার সাহস সিনেমার কাহিনিকেও হার মানিয়েছিলো।

তুমি কি চতুর্থ হিজরির সফর মাসে ঘটে যাওয়া রাযীর কাহিনি শুনেছো?

শুনবেই কী করে, বলো? তোমার দিন কাটে টম ক্রুজ, রবার্ট প্যাটিনসন, হৃত্বিক রৌশান কিংবা ইমরান হাশমিদের সাথে। রাযীর কাহিনি তুমি কীভাবে শুনবে? তোমার তো সময়ই নেই। চারিদিকে তোমার কতো কাজ। গালফ্রেন্ডকে সময় দিয়েই শেষ করতে পারো না, এসব কাহিনি জানার মতো সময় কোথায় তোমার।

অসুবিধে নেই। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমিই তোমাকে সেই কাহিনি শুনাচ্ছি।

একবার আযল এবং কারাহ গোত্রের কিছু লোক নবীজির ﷺ কাছে এলো। এসে জানালো তাঁরা ইসলাম নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে চর্চা করছে। এও জানালো, ইসলাম শেখানোর জন্যে তাদের সাথে কিছু সাহাবি পাঠালে ভালো হয়। তাহলে তাঁরা সাহাবাদের কাছ থেকে দীন শিখতে পারবে। রাসূল ﷺ তাঁদের প্রস্তাব শুনে খুশি হলেন। দশ জন সাহাবিকে তাঁদের সাথে পাঠিয়ে দিলেন। উমার এর ছেলে আসিম (রা) ছিলেন সেই জামাতের জিম্মাদার।

সাহাবারা রাযী নামক স্থানে পৌঁছলেন। স্থানটি ছিলো রাগেব ও জিদ্দার মাঝামাঝি। এই স্থানে পৌঁছানোর পর আযল এবং কারাহ গোত্র সাহাবাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। বানু লেহইয়াকে তাঁরা সাহাবাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলো। বানু লেহইয়ার একশো তীরন্দাজ সাহাবাদের ওপর আক্রমণ করলো।

সাহাবারা টিলার ওপরে আশ্রয় নিলেন। তীরন্দাজরা তাঁদের ঘিরে ফেললো। তারা সাহাবিদেরকে নেমে আসতে বললো। সাহাবারা তাঁদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। তখন তারা সাহাবাদের ওপর তীরের বৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকলো। যুদ্ধ শুরু হলো। সাহাবারা দৃঢ়পদে যুদ্ধ করতে থাকলেন। তীরের আঘাতে সাতজন সাহাবা শহীদ হলেন। তিনজন বেঁচে রইলেন।

বানু লেহইয়ান তিনজনকে টিলা থেকে নেমে আসতে বললো। সাহাবারা নেমে এলেন। তারা সাহাবাদের বেধে ফেললো। এরপর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকলো। একজন সাহাবা তাঁদের সাথে যেতে অস্বীকার করলেন। তারা এই সাহাবাকে এখানেই হত্যা করলো। বাকি রইলেন খোবায়ব (রা) ও যায়েদ ইবনু দাসেনা (রা)। ইবনু দাসেনাকে (রা) মক্কায় বিক্রি করে দেওয়া হলো। খোবায়ব আটক থাকলেন।

কিছুদিন পর কাফিররা খোবায়বকে (রা) হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলো। শূলিতে চড়িয়ে। কাফিরদের এই সিদ্ধান্ত শুনে খোবায়ব (রা)-এর অবস্থা কেমন হয়েছিলো, জানো?

খোবায়ব (রা) তাঁর মৃত্যুর ফয়সালা শুনে একটুও ঘাবড়ে যাননি। তিনি দু-রাকাত সালাত আদায় করার অনুমতি চাইলেন। কাফিররা অনুমতি দিলো। খোবায়ব ওজু করে সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। সালাত শেষ করে কাফিরদেরকে বললেন, ‘আল্লাহর শপথ। আমি মৃত্যুকে ভয় করেই সালাত আদায় করছি—তোমরা এমন কথা ভাববে—যদি এ আশঙ্কা মনে না আসতো, তবে আমি সালাতকে আরও দীর্ঘ করতাম।’

এরপর খোবায়ব (রা) বললেন, ‘হে আল্লাহ, এদের প্রত্যেককে গুনে রাখুন। একজনকেও ছাড়বেন না। এদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে মৃত্যু দান করুন।’

ভাই আমার! বুঝতে পারছো, বীর কাকে বলে? কতখানি সাহস থাকলে পরে—নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও কেউ এভাবে কথা বলতে পারে।

খোবায়বকে (রা) যখন শূলির কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, তখন তিনি কবিতা আবৃতি করতে থাকেন। তিনি বলেন,

“ওরা সবাই দলে দলে আমায় ঘিরে রাখলো

গোত্রে গোত্রে জড়ো হলো, কেউ বাকি নাহি থাকলো

নারী-শিশু বাদ গেলো না কেউ, সবে এলো দলে দলে

ওরা আমায় নিয়ে গেল বড়ো বৃক্ষের তলে

স্বদেশ থেকে দূরে আজি, আমি সহায়হীন

তোমার কাছেই ফরিয়াদ করি, হে রাব্বুল আলামীন

আরশের মালিক দিয়ো আমায় ধৈর্যশীল অন্তর

মনোদৈহিক সাহস আমায় দিয়ো হে প্রভু নিরন্তর

বললো ওরা কফির হতে, ঢের ভালো মরণ

অশ্রুবিহীন ঢুকরে কাঁদে, আমার দু-নয়ন

মুসলিম হয়ে মরছি আমি, মোর কীসের ভয়

আল্লাহর পথে মরবো যখন, চাইনা দিক নির্ণয়

আল্লাহ পাকের খুশীর জন্যে আমার শাহাদাত

তিনি ইচ্ছে করলে টুকরো দেহে দেন যে বারাকাত”

খোবায়ব (রা)-এর কবিতা শুনে কাফিররা তাঁকে প্রস্তাব দিলো—‘তুমি কি চাও, তোমার পরিবর্তে আমরা মুহাম্মাদের শিরচ্ছেদ করি?’

খোবায়ব (রা) তাদের প্রস্তাব শুনে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। এরপর দৃঢ়তার সাথে বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমি বেঁচে থাকতে মুহাম্মাদের ﷺ গায়ে একটি কাটার আঘাত আসবে, এটা কখনোই হতে পারে না।’

সুবহানাল্লাহ! ভাই আমার, এক মিনিট একটু কথাটা নিয়ে ভাবো তো। একটু মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করো। এবার আমাকে বলো, তুমি কি তোমার রাসূলকে ﷺ খোবায়বের মতো ভালোবাসতে পেরেছো? তোমার জীবনের চেয়েও রাসূলকে ﷺ বেশি গুরুত্ব দিতে পেরেছো? উত্তরটা তোমার কাছেই রইলো।

খোবায়বের (রা) মুখে এ কথা শুনার পর, তাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো। এরপর শূলিতে চড়ানো হলো। আত্মাভিমানী খোবায়ব (রা) বীরের বেশে দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। মৃত্যুর ভয় খুবায়বকে (রা) চুল পরিমাণও বিচলিত করেনি। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত শত্রুর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। বিশ্বাস তাঁর এতটাই মজবুত ছিলো যে, মৃত্যুর ভয় তা দুর্বল করতে পারেনি। ইনিই সেই খোবায়ব (রা), তুমি যার উত্তরসূরি।

এগুলো হলো বিশ্বাসীদের কাহিনি। এ কাহিনি কোনও গল্পকারের বানানো নয়, কল্পিত উপন্যাসের অংশাবশেষ নয়, অ্যাকশান মুভির দৃশ্যও নয়। সত্যিকারের কাহিনি।

ভাই আমার। তুমি মুভিতে যা দেখো, সেগুলো অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা তুমিও জানো। তবুও তুমি সত্যিকারের হিরোদের বাদ দিয়ে, নকল হিরোদের নিয়েই মত্ত থাকো।

তুমি কতই না দুর্ভাগা।

হে মিসকিন, তুমি আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবে? কোন মুখ নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াবে?

কিংবদন্তীদের উপাখ্যান-০২/জাকারিয়া মাসুদ

==========================

তথ্যসূত্র :

[১] বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল, আস-সহীহ, অধ্যায় : যুদ্ধাভিযান, হাদীস : ৩৭৯১।

[২] মুবারকপুরী, শফিউর রহমান, আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ৩১৪-৩১৬।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button