জবাবদিহিতা: পাপমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের অনিবার্য দাবি
ডক্টর আ. ছ. ম তরিকুল ইসলাম
জবাবদিহিতার অর্থ হচ্ছে কৈফিয়ত দান, অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের উত্তরদান, কি কর্তব্য ছিল আর কি করেছি তার ব্যাখ্যাদান প্রভৃতি। প্রকৃতিগত দিক থেকে ‘জবাবদিহিতা’-কে মানুষ পছন্দ করে না-এটাই স্বাভাবিক। কেননা এর দ্বারা মানুষের ভুল-ভ্রান্তি প্রকাশ হয়ে পড়ে। নিজের ভুল-ভ্রান্তি প্রকাশ হয়ে পড়াকে মানুষ কখনো স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না। মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। সেজন্য ভুল করাটা মানুষের জন্য একেবারেই স্বাভাবিক।
তবে ভুল কিন্তু নিজেরটা মানুষ নিজে তেমন দেখতে পায় না; সে কারণে মানুষ অসংখ্য ভুলের মধ্যে হাবুডুবু খেয়েও তার মনে ‘আমি যে ভুল করেছি’ এই বোধ উদয় হয় না। সে জন্য ভুল থেকে পরিত্রাণ পাওয়াটা তার জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে, অন্যের মাধ্যমে যদি সে ভুল বুঝতে পারে তহালে অবশ্যই সে ভুল থেকে দূরে অবস্থানের সুযোগ লাভ করতে পারে। ‘জবাবদিহিতা’ মূলত মানুষের জন্য এই সুবর্ণ সুযোগের দ্বার অবারিত করে। ‘আমাকে জবাবদিহি করতে হবে’- এই অনুভূতি মানুষকে অসংখ্য ভুলের পথ থেকে রক্ষা করে। সেই প্রেক্ষাপটে সে অসংখ্য অপরাধ প্রবণতা থেকে বেঁচে থাকার দুর্লভ সুযোগ লাভে ধন্য হয়।
পক্ষান্তরে, যার জবাবদিহিতা নেই, তার ভুল-ভ্রান্তি দোষ-ত্রুটি উন্মোচনের সুযোগ নেই; সে জন্য এগুলো থেকে মুক্তিলাভেরও সুযোগ নেই। যার জবাবদিহিতার অনুভূতি নেই, দোষত্রুটি ও অপরাধপ্রবণতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হওয়াটা তার জন্য একেবারেই স্বাভাবিক। সে জন্য ভুল-ত্রুটি ও পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত একজন মানুষ তৈরিতে জবাবদিহিতার বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। প্রতিটি মানুষই সমাজের সদস্য। পাপমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে প্রতিটি সদস্যের ভূমিকা থাকাটাই স্বাভাবিক। সে জন্য জবাবদিহিতার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ ভুল-ভ্রান্তি ও দোষ-ত্রুটি মুক্ত হয়ে গড়ে উঠলে পাপমুক্ত সমাজ
বিনির্মাণ মোটেও কঠিন নয়; বরং এমনি ধরনের একটি সুষমা সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের জন্য এই জবাবদিহিতার কোন বিকল্প নেই। একে বাদ দিয়ে সুস্থ সমাজ কল্পনাই করা যায় না।
একজন মুমিন ও মুসলমান অর্থই হচ্ছে সে আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসী। পার্থিব ক্ষণস্থায়ী এ দুনিয়া অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে। এর পর শুরু হবে অনন্ত অফুরাণ আখিরাতের জীবন। সেখানে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সবাইকে জবাবদিহি করতে বাধ্য হতে হবে। আসলে আসমান-যমীনে যা কিছু রয়েছে সবকিছু মানুষের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। আর সমগ্র সৃষ্টিই মানুষের খাদেম। সব কিছুকে উপভোগ করছে মানুষ। এই গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি, জল-স্থল, পশু-পক্ষী, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ- নক্ষত্র- এক কথায় সকল কিছুই মানুষের উপকারার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে। পৃথিবীতে কোন অফিস-আদালতের কোন কর্মকর্তাকে গাড়ি-বাড়ি বা অন্য কোন কিছু ভোগের জন্য সরবরাহ করলে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, হিফাযত প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁকে অবশ্যই জবাবাদিহি করতে হয়। পক্ষান্তরে, সমগ্র পৃথিবীকে আল্লাহ্ মানুষের ভোগ-উপযোগী করে দান করার পরেও তাকে এগুলো সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে না- এটা হতেই পারে না। তাকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। ইসলাম পাপমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি জীবনব্যবস্থা। যেহেতু জবাবদিহিতা ব্যতীত এইরূপ সমাজব্যবস্থার চিন্তাই করা যায় না, সে জন্য সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘জবাবদিহিতা’কে লালন করার জন্য ইসলামে জোর তাকীদ এসেছে। ইসলাম জবাবদিহিতার ব্যাপারে সকলকে সচেতন করে তুলেছে, মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে জলদগম্ভীর স্বরে তাই ইরশাদ হল:
“নিশ্চয় (তোমাকে) কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এগুলোর প্রত্যেকটির জন্য জবাবদিহি করতে হবে।” (বনি ইসরাঈল: ৩৬)
এখানে পঞ্চেন্দ্রিয়ের সবচেয়ে কর্মতৎপর দুটি ইন্দ্রিয় কান ও চক্ষুকে উল্লেখ করা হয়েছে। সকল ইন্দ্রিয়শক্তির নিয়ন্ত্রক অন্তঃকরণের কথাও উল্লেখ করে আল্লাহ্ বনী আদমকে সাবধান করে দিয়েছেন, যেন তার শরীরের সকল অণু-পরমাণূ জবাবদিহিতার জন্য তৈরি থাকে। কিয়ামতের হিসাব-কিতাব ও জবাবদিহির এক চিত্র আরো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আল-কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেন: “আজ আমি তাদের মুখের উপরে মোহর মেরে দিব, তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে আর তাদের পাগুলো তারা দুনিয়ায় কি কি করেছিল তার সাক্ষ্য দেবে।” (ইয়াসীন: ৬৫)
মানুষ জবাবদিহি করতে না চাইলেও জোর করে তাকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা হবে—সেই কথাটিই এখানে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
জবাবদিহির জন্য মানুষকে যে কৃতকর্মের তালিকা বা আমলনামা প্রদান করা হবে তা অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিশ্লেষণাত্মক। তাদের কৃতকর্মের অণু-পরমাণু ভাল হোক বা খারাপ হোক সব কিছু সেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ হবে। রাব্বুল আলামীন বলেন: “অতঃপর যে লোক বিন্দু পরিমাণ নেক আমল করবে সে তা দেখবে, আর যে লোক বিন্দু পরিমাণ খারাপ আমল করবে সে তা-ও দেখতে পাবে।” (যিলযাল: ৭.৮)
এই কৃতকর্মের তালিকায় নিজের কাজের অণু-পরমাণু সন্নিবেশিত হতে দেখে একজন কাফিরের অবস্থা কিরূপ হবে সে প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন- ““আমলনামা তখন তাদের সামনে রেখে দেয়া হবে। তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবে। তারা বলবে, হায় আফসোস! এ কেমন আমলনামা! এ যে ছোট-বড় কোন কিছু বাদ দেয়নি। সবই এতে রয়েছে।” (আল-কাহাফ: ৪৯)
সুতরাং ‘খাও দাও ফুর্তি কর, দুনিয়াটা মস্ত বড়’ ভেবে জবাবদিহিতাকে ভুলে থাকা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সে জন্য হযরত ওমর (রা) কত সুন্দরই না বলেছেন- “হিসাব প্রদানের পূর্বেই নিজে নিজের হিসাব কষে দেখ।” সকল বিষয়েই জবাবদিহি করতে হবে। বিশেষভাবে কোন্ কোন্ বিষয় জবাবদিহি করতে হবে, সে সম্পর্কেও হাদীসে আলোকপাত করা হয়েছে। যেমন বলা হচ্ছে:
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা) বলেছেন:“কিয়ামতের দিন বনী আদমকে তার রবের নিকট হতে দুই পা-কে এক বিন্দু পর্যন্ত সরাতে দেয়া হবে না, যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তার বয়স সম্পর্কে, সে কোথায় তা ধ্বংস করেছে; তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কোথায় সে তাকে পুরাতন করেছে; তার সম্পদ সম্পর্কে, সে কোন জায়গা হতে তা উপার্জন করেছে আর কোন জায়গায় তা খরচ করেছে, এবং তাকে যে বিদ্যা- বুদ্ধি দান করা হয়েছিল সে অনুযায়ী সে কি আমল করেছে।” (তিরমিযী) এখানে মূল বক্তব্য হচ্ছে: একটি মানুষের হায়াত, উপার্জন ও ইল্ম সম্পর্কে জবাবদিহি ব্যতীত একজন মানুষ একটি পা-ও অগ্রসর হতে পারবে না। মূলত ‘হায়াত’ শব্দটি ব্যাপক অর্থবহ যা মানব-জীবনের সব কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। উপার্জন ও ইল্ম অন্য ভাষায় অর্থ ও জ্ঞান-বুদ্ধি মানব-জীবনের বিশেষ চালিকাশক্তি। এই দুই চালিকাশক্তি সম্পর্কে পুনরায় পৃথকভাবে জবাবদিহির অর্থই হচ্ছে মানুষের জীবনের কোন দিকই জবাবদিহিতার আওতামুক্ত নয়। মানুষের সকল কাজ সম্পর্কেই জবাবদিহি করতে হবে। অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাই বলেছেন: “তোমাদের আমল সম্পর্কে তোমাদের নিকট অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” (নাহল: ৯৩)
একজন মু’মিনের ঈমানের অনিবার্য দাবিই হচ্ছে জবাবদিহিতা সম্পর্কে সদা সচেতন থাকা। তার প্রতিটি হাঁটা, চলা, প্রতিটি কাজকর্ম, প্রতিটি কথাবার্তা, প্রতিটি আচার-আচরণ সম্পর্কে জবাবদিহি করতেই হবে-এই অনুভূতি জাগ্রত থাকা ছাড়া একজন মু’মিন পূর্ণ ঈমানদার হতে পারে না। আখিরাতের এই জবাবদিহিতা আখিরাতের প্রতি ঈমান আনার অবিচ্ছেদ্য অংগ। যারা এই জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে না তারা মূলত আখিরাতকে বিশ্বাস করে না। আর যারা আখিরাতকে বিশ্বাস করে না, তাদের ঈমানদার দাবি করার কোন অধিকার নেই। এজন্য মজবুত ঈমানের অধিকারীরা সকল সময়েই জবাবদিহিতার ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। জবাব- দিহিতার জোরাল কশাঘাত তাদেরকে বার বারই পাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করে।
সুন্দর, পাপমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার কোন বিকল্প নেই। আজ আমাদের সারাটি সমাজ পাপ-পঙ্কিলতায় জরাজীর্ণ। চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, জোরদখল, ঘুষ, দুর্নীতি, খিয়ানতসহ অসংখ্য অপরাধে আজ) মানুষ শ্বাসরুদ্ধপ্রায়। দুঃজনক হলেও সত্য যে, এসব অপরাধীর অধিকাংশই মুসলমান (!), ধরা হয় তারা আখিরাতের উপরে বিশ্বাসী। তর্কের খাতিরে আমি ধরে নিচ্ছি, তারা আখিরাতে বিশ্বাসী মুসলমান। তবে আখিরাতের জবাবদিহিতা যাকে সামান্যও পাপ বর্জনে উৎসাহিত করে না, আখিরাতের প্রতি তার ঈমান আছে তা কি বিশ্বাসযোগ্য? একথা দিবালোকের মত সত্য যে, আখিরাতের জবাবদিহিতার তাড়া থাকলে কারো পক্ষে এ সব অপকর্মে সামান্য অংশগ্রহণ করাও কি সম্ভব? তা হলে আমি কিভাবে মেনে নেব, তাদের আখিরাতের উপর বিশ্বাস রয়েছে? আর তা যদি না মানতে পারি তাহলে আখিরাতকে অস্বীকারকারী মনেপ্রাণে মেনে নেয়ার পরেও আমি তাকে কি করে মুসলমান বলে স্বীকার করে নেব!
মানুষ কোন না কোন ক্ষেত্রে অবশ্যই দায়িত্বশীল। কেউ সন্তান-সন্ততির প্রতি দায়িত্বশীল; কেউবা সমাজ, গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা, জেলা… পর্যায়ে দায়িত্বশীল। যে যাদের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত তাকে তাদের সম্পর্কে জবাবদিহি করাটাও কিন্তু পার্থিব নিয়মে গড়ে ওঠা সমাজ ব্যবস্থারও অংশ। বাস্তবে এই জবাবদিহির কতটুকু বলবৎ রয়েছে সে কথা ভিন্ন। ইসলাম কিন্তু অত্যন্ত সচেতনতার সাথে এই জবাবদিহির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
রাসূল (সা) বলেছেন: “তোমরা সকলেই রাখাল, আর যাদের উপর তোমরা রাখালীর দায়িত্ব পালন করছ তাদের সম্পর্কে তোমাকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
আখিরাতের অনিবার্য জবাবদিহিতাকে কোন নির্বোধ যদি উপেক্ষাও করে- সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতাকে মনেপ্রাণে লালন করে, তা হলেও যে কোন কু-কর্ম করতে তার পিছ-পা হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে এক্ষেত্রে সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে জবাবদিহিতামূলক বিধি-ব্যবস্থার প্রচলন থাকাও বাঞ্ছনীয়। সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের প্রতিটি স্তরের প্রতিটি লোক সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে; এমনি ধরনের সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ছাড়া পাপমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ কক্ষনো সম্ভব নয়।
আখিরাতে গত্যন্তর না থাকার কারণে সবাইকে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকতে হলেও পার্থিব জীবনে কিন্তু জবাবদিহিতাকে মেনে নেয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। প্রকৃতিগত দিক থেকেই মানুষ জবাবদিহিতাকে পছন্দ করে না। আমরা অনেকেই মনে করি, জবাবদিহিতা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করে। স্বমর্যাদাকে কমিয়ে দেয়। নিজের স্বার্থকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমি ভুলের ঊর্ধে, আমি প্রশ্নাতীত, আমি বুনিয়াদী, আমি এই সেই সাত পাঁচ- আমাকে আবার জবাবদিহি কেন করতে হবে- এমনি একটি ধ্যান- ধারণা আমাদের সমাজে কম-বেশি প্রচলিত। এ জন্য জবাবদিহি-মুক্ত স্বাধীনতা ভোগে আমরা প্রায় সকলেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমরা কেউ কারো ধার ধারি না। কারো তোয়াক্কা করি না। আসলে এটি সমাজের জন্য কোন শুভ লক্ষণ নয়।
আমাদের চাকরি, সমাজ, রাষ্ট্র- প্রতিটি ক্ষেত্রে উর্ধতন কেউ না কেউ রয়েছেন। আর অধস্তন কেউ থাকাটা একেবারেই স্বাভাবিক। অধস্তনদের কাছে তো জবাবদিহির প্রশ্নই ওঠে না, এমন কি ঊর্ধ্বতনদের কাছেও আমরা জবাবদিহি করি না। সমাজ যেন এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে, আমরা জবাবদিহি করতে বাধ্য নই। আমাদের সমাজব্যবস্থা আমাদেরকে জবাবদিহির অনুভূতি লালন করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। পক্ষান্তরে, ঊর্ধতন তো দূরের কথা অধস্তনরাও ইসলামী সমাজে জিজ্ঞাসাবাদ করার অধিকার রাখে। হযরত ওমর (রা) তখন মুসলিম জাহানের প্রতাপশালী খলীফা। তদানীন্তন বৃহৎ পরাশক্তি রোমান ও পারস্য সম্রাটের আতঙ্কের বস্তু তিনি। মসজিদে নববীতে খুতবা দিতে উঠেছেন। গ্রাম্য এক দরিদ্র প্রজা তাকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন দৃঢ় ভাষায় :
“হে ওমর! আমি আপনার খুতবা শুনব না। আপনার প্রতি অনুগত্যও দেখাব না। যতক্ষণ না আপনি আপনার পরিহিত জামার কাপড় সম্পর্কে জবাবদিহি না করেন। গতকাল আপনার পক্ষ থেকে যে কাপড় আমাদের মাঝে বন্টন করা হয়েছে তা দিয়ে এত বড় লম্বা জামা বানান কোনক্রমেই সম্ভব নয়। আপনি আমাদের চেয়ে বেশি কাপড় না নিলে কিভাবে আপনার জামা এত লম্বা হওয়া সম্ভব হল?”
ওমর (রা) রাগান্বিত হলেন না। বেদুঈনকে ধমক দিয়ে থামিয়েও দিলেন না। দেহরক্ষীরা বেদুঈনের স্পর্ধা থেকে গালমন্দ পর্যন্তও করলেন না। বিশ্বমুসিলম জাহানের খলীফা বেদুঈনের জিজ্ঞাসাবাদের কাঠগড়ায় দাঁড়ান। প্রকৃতি জবাবদিহির নমুনা দেখে থমকে গেল। বিশ্ব জবাবদিহিতার উজ্জ্বল নমুনা দেখে ধন্য হল। ওমর (রা) নীচু স্বরে নিজের পুত্র আবদুল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। হযরত আবদুল্লাহ বললেন: “মদীনার সকল অধিবাসীর মত আমি ও আমার পিতা এক এক খণ্ড করে দুইজনে দুই খণ্ড কাপড় পেয়েছিলাম। আমার পিতা দীর্ঘকায় হওয়ার কারণে এ কাপড় তাঁর জামা তৈরির জন্য কোনক্রমেই সংকুলান হচ্ছিল না। তাই আমার ভাগেরটাও তাঁকে দিয়ে দুইজনের কাপড় একত্র করেই তাঁর এই জামা তৈরি করা হয়েছে। তাঁর একার কাপড় দিয়ে নয়।”
মুক্তি পেলেন মুসলিম জাহানের খলীফা। বেদুঈনের স্বগত উক্ত ঘোষিত হল: “হে ওমর (রা)! আপনি আপনার খুতবা অবিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যান। এখন আমি খুতবা শুনব। আমি আপনার আনুগত্য দেখাব।” এই তো সেই ওমর (রা) যাঁর জবাবদিহিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে বিরাজ করছে তাঁর সেই ঐতিহাসিক বাণী: “ফুরাতের কিনারায় যদি কোন কুকুর অভুক্ত থেকে মারা যায় তার জন্য আমি ওমর আল্লাহর কাছে কি কৈফিয়ত দেব! হায়! ওমর-জননী যদি ওমরকে প্রসব না করত তা হলে কতই না ভাল হত!”
একজন সাধারণ প্রজার কাছে মুসলিম জাহানের শক্তিশালী শাসক ওমরের এই জবাবদিহিতা, ইসলামের দৃষ্টিতে অধস্তনের নিকট প্রত্যেক ঊর্ধতনকে যে জবাবদিহি করতে বাধ্য, তার জাজ্বল্য প্রমাণ বহন করে।
আমাদের সমাজে জবাবদিহির এই ধারা বিলুপ্ত হওয়ার কারণে গোটা সমাজব্যবস্থা বিশৃঙ্খলার আবর্তে পতিত হয়েছে। আখিরাতের জবাবদিহিতার অনুভূতি তো নেই-ই; এমন কি ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও’-এর প্রবক্তাদের মাঝে পার্থিব জবাবদিহিতা চর্চারও প্রচলন নেই। যার কারণে ‘যেমন ইচ্ছা তেমন কর’ ‘জোর যার মুলুক তার’-এই সব ‘অলিখিত সংবিধান’ সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
জবাবদিহিতামুক্ত সমাজে বল্গাহীন স্বাধীনতা ভোগের দ্বার উন্মুক্ত হয়। বল্গাহীন স্বাধীনতা সকল অপকর্মের জন্ম দেয়। অর্থ-সন্ত্রাস, তথ্য-সন্ত্রাস, রাজনৈতিক-সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, যৌন-সন্ত্রাস এমনকি অসংখ্য নাম না জানা সন্ত্রাসের চাপে মানুষ দিশেহারা। সমাজে যত দিন পর্যন্ত যিনি যেখানে যেটুকু দায়িত্ব নিয়ে আছেন তাঁকে জবাবদিহিতার গণ্ডিভুক্ত না করা সম্ভব হবে, ততদিন কোনক্রমেই সার্বিক মুক্তির আশা করা অবান্তর। সকল ক্ষেত্রে, সকল পর্যায়ে কি অধস্তন, কি ঊর্ধতন, কি সরকারী, কি বেসরকারী, কি রাষ্ট্রীয় কি স্বায়ত্বশাসিত, কি দেশী, কি বিদেশী কি রাজা, কি প্ৰজা, কি চাকর, কি মনিব-সকলকেই জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় অবশ্যই দাঁড়াতে হবে; এমনি ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি ব্যতীত কল্যাণমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা কখনই সম্ভব নয়।
জবাবদিহিমুক্ত সমাজ মানুষকে আইনের প্রতি অসম্মান দেখাতে প্ররোচিত করে। দায়িত্ববোধ জাগ্রত হওয়ার দ্বার রুদ্ধ করে। অন্যের সম্পদের প্রতি লোলুপদৃষ্টি নিক্ষেপের পথ উন্মুক্ত করে। অভদ্র আচরণ করতে শেখায়। হামবড়া ভাবের জন্ম দেয়। এক কথায় যত অপকর্ম রয়েছে সবগুলো করতে উদ্বুদ্ধ করে। এ জন্য পাপমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে জবাবদিহিতার কোন বিকল্প নেই। আখিরাতের অনিবার্য জবাবদিহিতার অনুভূতি সমাজে যাতে অপকর্ম ছড়াতে না পারে সে ক্ষেত্রে অতন্দ্র প্রহরীর কাজ করে। এমনকি আখিরাতের প্রতি দুর্বল ঈমান অথবা যার ঈমানই নেই তাদের জন্যও পৃথিবীতে জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরি করলে এ সমাজকে কল্যাণমূলক সমাজে রূপ দেয়া সম্ভব। জবাবদিহিতাকে উপেক্ষা করে তা একেবারেই অকল্পনীয়। জবাবদিহিতা পাপমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের জন্য একেবারেই অনিবার্য। আমরা সমাজের প্রতিটি স্তরে যত জবাবদিহিতার চর্চা করতে পারব ততই সমাজ পাপমুক্ত হবে, অপরাধ থেকে পরিত্রাণ পাবে। আল্লাহ আমাদের এ কাজে সহায় হোন।
***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।