নিরক্ষরতা দূরীকরণে বিশ্বনবী (সা.)

রচনায়ঃ মাওলানা খন্দকার মুশতাক আহমদ

নিরক্ষরতা অর্থ হচ্ছে অক্ষর-জ্ঞানহীনতা। এটি জাতির জন্য একটি অভিশাপ। নিরক্ষরতা জাতিকে বহুবিধ অগ্রগতির পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। অক্ষরজ্ঞান না থাকলে ব্যক্তি তার কর্মপন্থা ও জীবন-প্রণালী, নিয়ম-নীতি ইত্যাদির ব্যাপারে যথার্থ ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয় না। আর এ কারণেই বর্তমানে দেশে নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযান একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।

আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এ পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন উম্মতের শান্তি ও কল্যাণের বাহক হিসেবে। বিশ্ববাসীর সামগ্রিক উন্নতি ও অগ্রগতির সকল পথ উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য। সে মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি নিজেকে একজন সফল কর্মবীর হিসেবে প্রমাণ করেছেন। মানবীয় সফলতার সকল ক্ষেত্রেই তিনি যথাযথ দিকনির্দেশনা দানের মাধ্যমে উম্মতকে একটি ফলপ্রসূ ও পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা দান করে গেছেন।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড; তাই প্রিয়নবী (সা) উম্মতকে শিক্ষার ব্যাপারে সর্বাধিক উৎসাহিত করেছেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান আরোপ করেছেন এবং তা বাস্তবায়িত করে দেখিয়ে গেছেন। সুতরাং একথা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, নবীজী (সা) অন্যান্য কল্যাণকর বিষয়ের সাথে সাথে আদর্শ শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে নিরক্ষরতা দূরীকরণেও জাতিকে যথার্থ দিক-নির্দেশনা দান করেছেন। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা নিরক্ষরতা দূরীকরণে বিশ্বনবী (সা)-এর বহুবিধ অবদানের কিঞ্চিত আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ্।

প্রিয়নবী (সা) নিজে ছিলেন উম্মী বা নিরক্ষর। স্মর্তব্য যে, উম্মী আর মূর্খ এক কথা নয়। উম্মী বলা হয় এমন ব্যক্তিকে যিনি প্রচলিত পদ্ধতিতে লেখাপড়া করেন নি। নবীজী (সা) নিরক্ষর থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার ব্যাপারে তিনি উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন অত্যন্ত কঠোরভাবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও নির্দেশনা দিয়ে তিনি জাতিকে শিক্ষার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেছেন। এখানে সংক্ষেপে বলে রাখা প্রয়োজন যে, বিশ্বনবী (সা) যে মহান লক্ষ্য নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, সে লক্ষ্য . পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নকে সহজসাধ্য করার জন্যই মহান আল্লাহ্ তাঁকে উম্মী বা নিরক্ষর হিসেবে প্রেরণ করেছেন। যাতে পবিত্র কুরআন তাঁর রচিত বলে কেউ সন্দেহ করতে না পারে এবং যাতে অন্য কোন মানুষ নবীজী (সা)-এর উস্তাদ হয়ে তাঁর উপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার হতে না পারে। সেমতে দুনিয়ার হিসেবে প্রিয়নবী (সা) উম্মী হলেও মহান আল্লাহই ছিলেন তাঁর সরাসরি শিক্ষক। আল্লাহ্ পাকের দেয়া সে শিক্ষার আলোকেই প্রিয় নবী (সা) শিক্ষা ও জ্ঞান-বুদ্ধির সর্বশীর্ষে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেন: “হে নবী আপনাকে আমি এমন সব জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছি যা আপনিও জানতেন না এবং আপনার পূর্ব-পুরুষেরাও জানতো না। (সূরা আনআম : ৯২)

প্রিয়নবী (সা) নিজেই ইরশাদ করেন, “আমি বিশ্ববাসীর শিক্ষকরূপে দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছি।”

নিরক্ষরতা দূরীকরণ তথা শিক্ষার প্রসারে প্রিয়নবী (সা)-এর অসাধারণ ভূমিকার অকুণ্ঠ স্বীকৃতি শুধু নবীজী (সা) এর অনুসারী ভক্তবৃন্দের মুখনিঃসৃত বক্তব্য তাই নয়; বরং ইসলামের ঘোর বিরোধী এবং ইসলামের প্রতিপক্ষ লবিতে অবস্থানরত ‘প্রসিদ্ধ’ যোদ্ধাদের নিরবচ্ছিন্ন ও নিরপেক্ষ গবেষণা-পরবর্তী স্বীকারোক্তিও এ কথাই প্রমাণ করে। টমাস কারলাইল অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বলেন, মুহাম্মদ (সা) ছিলেন একজন নিরক্ষর মানুষ, কোন শিক্ষকের সামনে তিনি বসেন নি কোনদিন। প্রচলিত পন্থায় তিনি আক্ষরিক কোন জ্ঞানই অর্জন করেন নি। অথচ তাঁরই মুখনিঃসৃত প্রতিটি বাক্য জ্ঞান- বিজ্ঞানের অসাধারণ ও বৈচিত্র্যময় উপকরণ। প্রয়োজন ছাড়া তিনি কোন কথাই বলতেন না; বরং তিনি তখন নীরব নিস্তব্ধ থাকতেন। যখন কোন কথা বলতেন তখন তা হত বুদ্ধিদীপ্ত ও বিচক্ষণতা সমৃদ্ধ। (Life of the Holy Prophet.)

আইয়ামে জাহিলিয়াত তথা মূর্খ যুগের ঘোর তমসাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতে পৃথিবীতে আগমন করে বিশ্বনবী (সা) আরব জাতিকে আক্ষরিক ও নৈতিক শিক্ষাদনের ব্যাপারে এক বৈপ্লবিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন এবং তাতে এক অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেন। যা একদিকে ছিলো বিরল ও বিস্ময়কর, অপরদিকে তা ছিলো আদর্শিক বিপ্লবের এক মহা চ্যালেঞ্জের বিজয়। আরবদের মাঝে লুক্কায়িত সুপ্ত প্রতিভাকে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করেছেন।

নিরক্ষরতা দূরীকরণে বিশ্বনবী (সা)-এর বহুবিধ বাস্তব ও ফলপ্রসূ কর্মসূচি বিশ্লেষণের পূর্বে আমরা এ ব্যাপারে প্রিয়নবী (সা)-এর একটি বিশেষ ভূমিকাকে একটু সবিস্তারে আলোচনা করে নিতে চাই। বিষয়টি ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের বন্দীদের নিয়ে সংঘটিত হয়। সেখানে প্রিয়নবী (সা)-এর সে ভূমিকা নবীজী (সা)-কে নিরক্ষরতা দূরীকরণে একজন ত্যাগী ও উদ্যমী মহাপুরুষ হিসেবে প্রমাণিত করে।

ইসলামের সর্বপ্রথম বৃহত্তর সামরিক অভিযান ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। এ যুদ্ধের বাহ্যিক সরঞ্জামাদির দিক বিচার করলে এটি ছিলো এক অসাধারণ অসম যুদ্ধ। কারণ সেখানে মুসলিম সৈন্যসংখ্যা ছিলো মাত্র তিনশত তের জন, তা-ও পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রবিহীন। পক্ষান্তরে, কাফিরদের অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য ছিলো মুসলিম সৈন্যের তিন গুণেরও অধিক। খোদায়ী সাহায্যের বদৌলতে সেখানে মুসলিম বাহিনী অভাবনীয় বিজয় লাভ করে। আর কুফরী শক্তি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তাদের বড় বড় নেতৃস্থানীয় লোকজনসহ সত্তরজন নিহত হয় এবং সত্তর জন কাফির সৈন্য মুসলিম সেনাদের হাতে বন্দী হয়। এ জাতীয় বন্দীদের ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবে দুনিয়ায় যে ধরনের আচার-আচরণ প্রচলিত প্রিয়নবী (সা) ছিলেন তা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। নবীজী (সা) প্রথমেই সাহাবাদের (রা) নির্দেশ দিলেন: “তোমরা বন্দীদের সাথে যথাসাধ্য সদাচরণ প্রদর্শন করবে।”

ভাবতেও অবাক লাগে, যে দুশমন গোষ্ঠী ছিলো মুসলমানদের রক্তপিপাসু তাদের সাথে এহেন সর্বোত্তম সদাচরণ বিশ্ব-ইতিহাসের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বন্দীদের মধ্যে কিছু লোক ছিলো শিক্ষিত। তারা লেখাপড়া জানতো। মহানবী (সা) তাদের মুক্ত করার জন্য যে মুক্তিপণ নির্ধারণ করলেন সেটিই এখানে আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। নিরক্ষরতা দূরীকরণে প্রিয়নবী (সা) কত অধিক অনুপ্রাণিত ও তৎপর ছিলেন, এ ঘটনা তারই একটি প্রমাণ বহন করে। প্রিয়নবী (সা) তাদের মুক্তিপণ স্থির করলেন দশটি ছেলেকে অক্ষরজ্ঞান দান করা। অর্থাৎ তারা প্রত্যেকে দশ-দশজন করে মুসলিম সন্তানকে লেখাপড়া শেখাবে। এর পর তারা মুক্ত হয়ে যাবে।

পাঠকবর্গ লক্ষ্য করুন! বিগত পনেরো বছরের অসহনীয় নির্যাতন নিপীড়নসহ কুরায়শদের বিভিন্ন রকমের অমানবিক আচরণের পর আবার শক্তি সঞ্চয় করে তারা মদীনা আক্রমণ করলো। এ যুদ্ধে যদি কাফির বাহিনী বিজয় লাভ করতো তবে তারা মুসলমানদের সাথে কিরূপ আচরণই না করতো। কিন্তু করুণার আধার বিশ্বনবী (সা) রক্তপিপাসু এসব বন্দীদের সাথে যে উত্তম ব্যবহার দেখালেন, বিশ্ব-ইতিহাস তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও এর সমকক্ষ কোন দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না।

এখানে সবচাইতে অধিক লক্ষণীয় বিষয় হলো, নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য তিনি চরম শত্রুকেও শিক্ষকের মর্যাদাদানে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধও করলেন না। বরং জীবনের সর্বপ্রথম সুযোগেই তিনি শত্রুদের দ্বারা মদীনায় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে দিলেন এবং এ ব্যাপারে তিনি ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করলেন।

বিশ্বসভ্যতার দাবিদার সমাজপতিরা তাকিয়ে দেখ, শিক্ষাকে প্রিয়নবী (সা) কিভাবে মূল্যায়ন করেছেন! এ পদ্ধতি গ্রহণ না করে তিনি তাদের নিকট থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ গ্রহণ করতে পারতেন। মুসলমানদের আর্থিক অনটনের সে মুহূর্তে এমনটি করাই ছিলো স্বাভাবিক যুক্তির চাহিদা। কিন্তু আদর্শিক শিক্ষার মহান শিক্ষক, বিশ্ববাসীর মহামুক্তির মহান বার্তাবাহক প্রিয়নবী (সা) অর্থের লোভ করেন নি। শিক্ষাকে তিনি অর্থের উপরে প্রাধান্য দিলেন। শিক্ষা বিস্তারের বিষয়টিকে তিনি সর্বোচ্চ স্থান দিলেন। কট্টর ইসলাম-বিদ্বেষীদেরকেও তিনি শিক্ষকের মত সম্মানজনক মর্যাদার আসনে সমাসীন করতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করলেন না।

শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে নবীজী (সা)-এর সে অসাধারণ ভূমিকার ফলেই তৎকালীন আরবের চরম মূর্খ ও বর্বর জাতিকে তিনি বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আরবের চরম অধঃপতিত ও বর্বরতার যুগে সেখানকার চরম মূর্খ ও নিরক্ষর জাতির মাঝে আবির্ভূত হয়ে প্রিয়নবী (সা) তাদেরকে সে মর্মন্তদ অধঃপতনমুক্ত করার জন্য চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, একমাত্র আদর্শিক শিক্ষার মাধ্যমে এ নিরক্ষর জাতিকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারলেই তারা সভ্য সমাজে পরিণত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রিয়নবী (সা) মূলত দু’টি ধারায় শিক্ষাক্রম পরিচালনা করেন। প্রথমত নিরক্ষরতা দূরীকরণে শিক্ষার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফযীলত বর্ণনা করে তিনি তৎকালীন আরব জাতিসহ অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষিত হয়ে গড়ে ওঠার একটি প্রশস্ত পথ উন্মোচন করেন। আর দ্বিতীয়ত, শিক্ষা বিস্তারে তিনি বহুবিধ বাস্তব কর্মসূচি ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করে মূর্খ ও নিরক্ষর জাতিকে অক্ষর-জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিত জাতিতে পরিণত করতে থাকেন।

শিক্ষার গুরুত্ব বর্ণনা : শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি হৃদয়গ্রাহী করার জন্য প্রিয়নবী (সা) পবিত্র কুরআনের বাণী উদ্ধৃত করে বলেন, যাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে (ইলমে) সমৃদ্ধ করা হয়েছে, তাকে মহাকল্যাণে ভূষিত করা হয়েছে। (সূরা বাকারা: ২৬৯)। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে: “যে ব্যক্তি জ্ঞান রাখে আর যে জ্ঞান রাখে না এ দু’ব্যক্তি কি সমান হতে পারে? (কক্ষণো নয়) (সূরা যুমার:৯)। আরো ইরশাদ হচ্ছে: “তোমাদের মাঝে যারা ঈমানদার এবং জ্ঞানী, মহান আল্লাহ্ তাদের মর্যাদা উঁচু করে দিবেন। (সূরা মুজাদালা: ১১)

নিরক্ষরতাকে নিন্দাবাদ করে তা দূরীকরণে সমাজের অধিবাসীদের সচেতন ও অনুপ্রাণিত করে হাদীস শরীফে প্রিয়নবী (সা) ইরশাদ করেন: পৃথিবীতে জ্ঞানী (আলিম) ব্যক্তির দৃষ্টান্ত আকাশের তারকার ন্যায় যা পানি ও স্থলভাগকে করে আলোকিত। (মুসনাদে আহমাদ)

অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে: জ্ঞান (ইম) অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরয (মু’জামে তাবারানী কবীর)। আরো ইরশাদ হচ্ছে, “রাতের কিছু সময় জ্ঞানের অনুশীলন করা সমস্ত রাত জাগ্রত থেকে ইবাদত করার চাইতে উত্তম (মুসলিম)।

নবীজী (সা) অন্যত্র ইরশাদ করেন: জ্ঞান সাধকের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র।

শিক্ষাকে ব্যাপক করার মাধ্যমে নিরক্ষরতার অভিশাপ থকে জাতিকে মুক্ত করে একটি সত্য ও নিরক্ষরতামুক্ত কল্যাণ-সমাজ গড়াই ছিলো উপরোক্ত বাণীসমূহের মৌলিক আবেদন।

নিরক্ষরতা দূরীকরণে বাস্তব কর্মসূচি

বিশ্বশান্তির অগ্রদূত মহানবী (সা) নিরক্ষরতা দূরীকরণার্থে যেসব বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করে তার আলোকে তৎকালীন আরব সমাজে যে কল্যাণকর সুফল বয়ে আনতে সক্ষম হন, নিম্নে অত্যন্ত সংক্ষেপে তা তুলে ধরা হচ্ছে।

শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন: পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামের প্রারম্ভিক সময়ে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রিয়নবী (সা) ঐতিহাসিক সাফা পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত “দারে আরকাম”-কে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরি করেন। এবং সেখানে দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ইতিহাসে এটিই ছিলো সর্বপ্রথম বেসরকারী শিক্ষাকেন্দ্র।

এমনিভাবে হিজরতের পূর্বেই মদীনার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করলে তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষায় সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার জন্য নবীজী (সা) হযরত মুস’আব ইবনে উমাইর (রা)-কে শিক্ষক হিসেবে মদীনায় প্রেরণ করেন। হযরত মুস’আব ইবনে উমাইর (রা) মদীনার আবূ উমামা ইবনে যুরারার বাড়িতে একটি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করে নবীজী (সা)-এর নির্দেশমতো সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। মদীনায় এটিই ছিলো সর্বপ্রথম ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্ৰ৷

হিজরতের পর প্রিয়নবী (সা) দীর্ঘ আট মাস যাবৎ হযরত আবূ আইউব আনসারী (রা)-এর দ্বিতল ভবনের নিচতলাকে শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সেখানে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালিত করতে থাকেন। এটি ছিলো মদীনার দ্বিতীয় ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্ৰ৷

আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: মহানবী (সা) শিক্ষা কার্যক্রমকে আরো ব্যাপক করার জন্য সাহল ও সুহাইল নামের দুই ভাইয়ের নিকট থেকে একটি জমি খরিদ করে সেখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন- যা ‘সুফফা’ নামে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ, আর সে শিক্ষাকেন্দ্রের ছাত্রদের বলা হতো ‘আসহাবে সুফ্ফা’। নিরাশ্রয় লোকদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা ছিলো সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম বিশেষ উদ্দেশ্য। সে শিক্ষাকেন্দ্র প্রিয়নবী (সা) নিজে শিক্ষাদানসহ সার্বক্ষণিক শিক্ষক হিসেবে হযরত সাঈদ ইবনে ‘আস (রা)-কে নিযুক্ত করেন। তিনি ছিলেন যথেষ্ট সুন্দর হস্তাক্ষরের অধিকারী। এ থেকে বোঝা যায় যে, প্রিয়নবী (সা) শিক্ষার্থীদের অক্ষরজ্ঞান শিক্ষাদানের পাশাপশি সুন্দর হস্তাক্ষরের প্রতি যথেষ্ট লক্ষ্য রেখেছেন।

বিশিষ্ট ঐতিহাসিক আল্লামা বালাজুরীর বর্ণনা মতে, হিজরী দ্বিতীয় সনে প্রিয়নবী (সা) ‘দারুল কোররা’ নামে আরো একটি আবাসিক শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

শিক্ষা কার্যক্রম তত্ত্বাবধান: দাওয়াত ও জিহাদী কর্মসূচিসমূহের ব্যস্ততা সত্ত্বেও প্রিয়নবী (সা) আপন প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাকেন্দ্রসমূহের যথার্থ তত্ত্বাবধান করেন। শিক্ষার্থীদের মাঝে কোন বে-মানান কাজ পরিলক্ষিত হলে কিংবা তাদেরকে কোন তর্ক- বিতর্কে লিপ্ত দেখলে তাৎক্ষণিকভাবে নবীজী (সা) তা বন্ধ করে দিতেন এবং এ জাতীয় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়ার উপদেশ দান করতেন। একবার কয়েকজন শিক্ষার্থীকে হাসাহাসি করতে দেখে প্রিয়নবী (সা) সাথে সাথে তাদেরকে ইন্তিকাল-পরবর্তী কঠিন অবস্থার কথা বলে হাসি থেকে বিরত থাকতে বলেন।

শিক্ষাদান পদ্ধতি: প্রিয়নবী (সা)-এর শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিলো অত্যন্ত সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীকে কয়েকবার উচ্চারণ করে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রদেরকে শিক্ষার বিষয়টি কণ্ঠস্থ করিয়ে দিতেন। আবার কখনো লিখে রাখার পরামর্শ দিতেন; শিক্ষার্থিগণ তা লিখে রাখতেন। নবীজী (সা) যাদেরকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করতেন তাদেরকেও তিনি এ বলে উপদেশ দিতেন যে, তোমরা ছাত্র- শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের মেধানুসারে বিষয়াবলী উপস্থাপন করবে।’ এভাবেই নবীজী (সা)-এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কঠিন বিষয়াবলীকেও অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল উপস্থাপনার মাধ্যমে সর্বজনবোধ্য করে পেশ করা হতো।

শিক্ষক প্রেরণ: নিরক্ষরতার অমানিশা থেকে মুক্ত করে অশিক্ষিত ও মূর্খ জাতিকে অক্ষর-জ্ঞান সমৃদ্ধ একটি সুশিক্ষিত জাতিতে পরিণত করার জন্য প্রিয়নবী (সা) প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দান করেন। এ লক্ষ্য অর্জনে তিনি ভ্রাম্যমাণ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন। এ ক্ষেত্রে প্রিয়নবী (সা) দূর-দুরান্তে শিক্ষক প্রেরণ করেন। যার ফলে ব্যাপকভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটে।

হিজরী ১১ সালে প্রিয়নবী (সা) হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রা)-কে ইয়ামানে প্রেরণ করেন। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের অঞ্চল ঘুরে ঘুরে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করেন এবং একজন ভ্রাম্যমাণ শিক্ষকের ভূমিকায় কাজ করেন। এমনিভাবে হযরত আবূ মূসা আশ’আরী (রা)-কেও একটি এলাকায় প্রেরণ করা হয়। (বুখারী শরীফ)

কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ: প্রিয়নবী (সা) দূর-দূরান্তের অঞ্চলসমূহ হতে বাছাই করে কিছু মেধাবী যুবককে নির্বাচিত করে তাদেরকে মদীনার কেন্দ্রীয় শিক্ষালয়ে প্রশিক্ষণদানের ব্যবস্থা করেন। অতঃপর তাদেরকে নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেন।

মসজিদভিত্তিক শিক্ষা: হযরত (সা) সাহাবায়ে কিরাম (রা)-কে তাদের নিজ নিজ এলাকায় মসজিদ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন। এবং সেসব মসজিদকে ভিত্তি করে ‘মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম’ চালু করার নির্দেশ দেন। ওমানের নওমুসলিমদেরকে মসজিদ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়ে নবীজী (সো) যে চিঠি প্রেরণ করেছিলেন তা বুখারী শরীফসহ নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থসমূহে সংকলিত রয়েছে।

বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভাষা: প্রিয়নবী (সা) মাতৃভাষার লিখন ও পঠনে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে লোক নির্বাচন করে তাদেরকে অন্যান্য রাষ্ট্রের ভাষা শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করেন। হযরত যায়েদ (রা)-কে নবীজী (সা) হিব্রু ভাষা শেখার নির্দেশ দিলে তিনি মাত্র সতেরো দিনে হিব্রুভাষা শিক্ষা সমাপ্ত করেন। অনুরূপ হাবশী, ফারসি, সুরইয়ানী, গ্রীক প্রভৃতি ভাষা শিক্ষারও তিনি ব্যবস্থা করেন।

বিবিধ: এ ছাড়াও মূর্খতা ও নিরক্ষরতা দূরীকরণে প্রিয়নবী (সা) স্থান-কাল ও পাত্রভেদে বিভিন্ন বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করেন। যেমন বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ, কাব্য ও সাহিত্যকে অনুপ্রাণিতকরণ, স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন হওয়ার প্রশিক্ষণ, শিশু শিক্ষা ও মহিলা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা; শিক্ষাগত দিক থেকে বৈষয়িক স্বাতন্ত্র্য স্থাপনসহ আরো অসংখ্য কর্মসূচি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়িত করেন। সুতরাং, নিরক্ষরতা দূরীকরণে প্রিয়নবী (সা) একজন সফল কর্মবীর হিসেবে চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

উপসংহার: সারকথা হচ্ছে, প্রিয়নবী (সা) এক বিশেষ হিকমত ও রহস্যহেতু উম্মী হিসেবে দুনিয়ায় প্রেরিত হলেও তিনি ইসলামের প্রারম্ভিক যুগ থেকেই নিরক্ষরতা দূরীকরণে বাস্তব ও ফলপ্রসূ কর্মসূচি হাতে নেন। মূর্খতার হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য তিনি গ্রহণ করেন বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি, যা বাস্তবায়িত হয় প্রিয়নবী (সা)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। ফলে বর্বর আরব জাতির মাঝে এত অধিক শিক্ষানুরাগী সৃষ্টি হয় যা আরবের রুক্ষ মরুবাসীদের একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিণত করে। আর আরব মরুভূমি পরিণত হয় একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে।

প্রিয়নবী (সা)-এর শিক্ষা সম্প্রচার ও তা ব্যাপককরণ কর্মসূচিকে তিনি চূড়ান্ত সাফল্যে রূপদান করতে সক্ষম হন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার ফসল হিসেবেই মূর্খতায় আচ্ছাদিত আরবের অধিবাসীরা নিরক্ষরতার হাত থেকে মুক্ত হয়ে শিক্ষার সম্মানজনক আসনে সমাসীন হয়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়।

তাই পরিশেষে আমরা বলবো: বিশ্বনবী (সা) নিরক্ষরতা দূরীকরণে শুধু অবদানই রাখেন নি; বরং এ অভিশাপ থেকে জাতিকে উদ্ধার করার লক্ষ্যে চেষ্টা-প্রচেষ্টার তিনি গোড়াপত্তন করে দিয়েছেন।

সুতরাং আসুন, আমরা জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সচেতনতা গ্রহণ করি এবং প্রিয়নবী (সা)-এর নীতি-দর্শনের অনুসরণে শিক্ষা সম্প্রসারণ কাজের আঞ্জাম দিয়ে জাতিকে অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে রক্ষা করি। মহান আল্লাহ্ আমাদের তাওফীক দিন, আমীন !

***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button