পর্দাঃ নারী মর্যাদার অন্যতম উপায়

রচনায় : শাহীদা বিনতে তসীরুদ্দীন*

পর্দা ইসলামের এমন একটি মৌলিক বিধান, যা মানুষকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক নাশকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। স্বার্থবাদী, ভোগবাদী, কুচক্রী পশ্চিমা মিডিয়া যখন নারীর ক্ষমতায়ন ও সমানাধিকারের নামে নারীদেরকে তাদের অন্দরমহল থেকে টেনে বের করে এনে চরমভাবে লাঞ্ছিত করছে, তখন সময়ের অনিবার্য দাবী হ’ল ইসলামী শরী’আহ মোতাবেক পর্দার বিধান মেনে চলা। আলোচ্য নিবন্ধে পর্দার বিভিন্ন দিক তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

পর্দা কি?

আরবী ‘হিজাব’ (حِخَابٌ) শব্দের অর্থ হ’ল পর্দা, আবরণ, আচ্ছাদন, ঘোমটা[1] বোরক্বা বা শরীরের আচ্ছাদন।[2] পরিভাষায় মেয়েদের সমস্ত শরীর ঢিলেঢালা বড় কাপড় দ্বারা এমনভাবে ঢেকে রাখা, যাতে তার গোপনীয়তা প্রকাশ না পায়। তবে প্রকৃতপক্ষে পর্দা হ’ল সকল সামাজিক বিধি-বিধানের একত্রিভূত এমন একটি সূত্র, যা নারী-পুরুষ সকলকে ইসলামী বিধানের আওতাভুক্ত হ’তে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করে।[3]

পর্দার হুকুমঃ

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন-

 وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ

‘ঈমানদার নারীদেরকে বলুন! তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। যা সাধারণতঃ প্রকাশমান সেটুকু ছাড়া তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে এবং তাদের মাথার ওড়না যেন বক্ষদেশে ফেলে রাখে’ (নূর ৩১)।

আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র বলেন-

 يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ

‘হে নবী! আপনি আপনার পত্নিগণকে, কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়’ (আহযাব ৫৯)।

উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে আদেশসূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে পর্দার বিধানকে মুসলিম উম্মাহ্‌র জন্য ফরয করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক কোন বিধান জারী হ’লে তা যেকোন মুসলিম নর-নারীর পালন করা ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকে না। যেমন মহান আল্লাহ বলেন-

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُّبِينًا

‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন কিছু করার ক্ষমতা নেই। বস্তুতঃ যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য ভ্রষ্টতায় পতিত হয়’ (আহযাব ৩৬)।

পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার সময়কালঃ

মহিলাদের পর্দা সম্পর্কিত প্রথম আয়াত সূরা আহযাবে উম্মুল মুমিনীন জয়নব বিনতে জাহ্‌শের সাথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিবাহের সময় অবতীর্ণ হয়। এর সময়কাল কারো মতে তৃতীয় হিজরী আবার কারো মতে পঞ্চম হিজরী। তবে তাফসীর ইবনে কাছীর ও নায়লুল আওত্বার গ্রন্থে পঞ্চম হিজরীকে অগ্রগণ্য করা হয়েছে। রূহুল মা’আনীতে আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, পঞ্চম হিজরীর যিলক্বদ মাসে এ বিবাহ সম্পন্ন হয়। তবে এ বিষয়ে সবাই একমত যে, পর্দার আয়াত এই বিবাহের সময়ই অবতীর্ণ হয়েছে।[4]

পর্দার শর্তঃ

ইসলামী শরী’আতের পক্ষ থেকে মেয়েদের পর্দার ব্যাপারে কিছু শর্তাবলী রয়েছে। সেগুলি হ’লঃ

১. পর্দা হবে মেয়েদের সমস্ত শরীর আবৃতকারী। আল্লাহ্‌র ভাষায়, يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ  ‘তারা যেন (উপর দিক থেকে) নিজেদের উপর নিজেদের চাদরের আঁচল ঝুলিয়ে দেয়’ (আহযাব ৫৯)।

২. পর্দা হবে এমন কাপড়ের যাতে গোপনীয়তা প্রকাশ না পায় এবং ঢিলেঢালা হবে যাতে অঙ্গের আকৃতি ফুটে না উঠে।

৩. পর্দার কাপড় হবে সাধারণ ও কারুকার্য বিহীন। যাতে অন্যের দৃষ্টি না কাড়ে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا‘তারা যেন নিজেদের সাজসজ্জা প্রকাশ না করে, কেবল এ ব্যতীত, যা আপনা হ’তেই প্রকাশ পায়’ (নূর ৩১)।

৪. পর্দা সুগন্ধিযুক্ত হ’তে পারবে না, যাতে করে সেই সুঘ্রাণ পুরুষের মনকে আকৃষ্ট করে। যেমন- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

‘মেয়েরা যখন পর্দাসহ সুগন্ধি ব্যবহার করে পুরুষদের কোন সমাবেশের কাছ দিয়ে অতিক্রম করে, তখন পুরুষরা (স্বাভাবিকভাবেই) বলাবলি শুরু করে দেয়ে যে, এই মহিলাটি এমন এমন অর্থাৎ সুন্দরী।[5]

৫. পর্দা পুরুষদের ব্যবহৃত পোষাকের অনুরূপ না হওয়া। কারণঃ

‘নবী করীম (ছাঃ) ঐ পুরুষের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন, যে পুরুষ নারীদের পোষাক পরিধান করে এবং ঐ নারীর প্রতি যে নারী পুরুষদের পোষাক পরিধান করে’।[6]

পর্দার মৌলিক উপকরণঃ

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত সূরা নূর ৩০, ৩১ ও আহযাব ৩৩, ৫৯নং আয়াতের আলোকে পর্দার মৌলিক উপকরণগুলি নিম্নরূপঃ

(ক) দৃষ্টি অবনত করা।

(খ) যৌনাঙ্গের হেফাযত করা।

(গ) যা সাধারণতঃ প্রকাশমান (যথা বোরক্বা, লম্বা চাদর) [7] তা ছাড়া সৌন্দর্য প্রকাশ না করা।

(ঘ) বক্ষদেশে ‘খিমার’ বা ওড়না ফেলে রাখা। উল্লেখ্য ‘খিমার’ ঐ কাপড়, যা নারীগণ মাথায় ব্যবহার করে থাকে, যা দ্বারা গলা এবং বক্ষ পানি ভরা কূপের ন্যায় আবৃত হয়ে যায়।

(ঙ) স্বামীসহ আয়াতে উল্লিখিত ১২ জন ছাড়া কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করা (নূর ৩১)। এখানে সাজ বলতে যে সাজের মাধ্যমে নারী নিজেকে সুসজ্জিত করে বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে প্রকাশ পায়। যেমন- অলংকার ও প্রসাধনী সামগ্রী ইত্যাদি।[8]

(চ) গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করা। এখানে হাত-পায়ের অলংকার, বেড়ি, ঝুমুর ইত্যাদি উদ্দেশ্য।[9]

(ছ) বুকের উপর ‘জিলবাব’ বা চাদর টেনে দেওয়া। ‘জিলবাব’ এমন বড় চাদর, যা বোরক্বার পরিবর্তে পরিধান করা হয়।[10]

(জ) কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে পর পুরুষের সাথে কথা না বলা। উল্লেখ্য যে, বৃদ্ধা নারী যারা বিবাহের আশা রাখে না, যদি তারা তাদের সৌন্দর্যের ব্যাপারে সাধারণ থাকে তাতে দোষ নেই (নূর ৬০)।

পর্দার মৌলিক স্তম্ভঃ

পর্দার মৌলিক স্তম্ভ ছয়টি, যার ভিত্তিতে পর্দার অপরিহার্যতা সাব্যস্ত হয়। যেমন-

১.(আল-ঈমান) বা ঈমান রাখা ২.(আল-ইফফাৎ) সতীত্ব সংরক্ষণ, নৈতিক পবিত্রতা বজায় রাখা ৩. (আল-ফিত্বরাত) স্বভাবধর্ম, প্রকৃতি ৪.(আল-হায়া) লজ্জাশীলতা ৫. (আত্ব-ত্বাহারাত) আত্মার পবিত্রতা ৬ز (আল-গায়রাত) শালীনতা, আত্মমর্যাদাবোধ।[11]

দলীলসহ নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রদত্ত হ’লঃ

১. আল-ঈমানঃ পর্দার মর্যাদা হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত আইন-কানূনের প্রতি ঈমান ও আনুগত্য। আনুগত্যের অপরিহার্যতা ঘোষণা করে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন কিছু করার ক্ষমতা নেই। বস্তুতঃ যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য ভ্রষ্টতায় পতিত হয়’ (আহযাব ৩৬)। আর পর্দার ব্যাপারে আল্লাহ্‌র আনুগত্য সম্পর্কে নিম্নে তাঁরই কথায় বর্ণিত হয়েছে,

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ

‘তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান কর, ইসলামপূর্ব বর্বর যুগের ন্যায় নিজেদেরকে প্রকাশ কর না’ (আহযাব ৩৩)।

২. আল-ইফফাতঃ নৈতিক পবিত্রতা, সতীত্ব সংরক্ষণ। আল্লাহ তা’আলা রমনীর জন্য পর্দার বাঞ্ছনীয় ও নৈতিক পবিত্রতা বজায় রাখার ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে, কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না’ (আহযাব ৫৯)। অর্থাৎ যখন মুসলিম নারী এভাবে আবৃত অবস্থায় ঘরের বাইরে যাবে, তখন লোকেরা বুঝতে পারবে যে, এ এক সম্ভ্রান্ত মহিলা, শ্লীলতা বর্জিত মহিলা নয়। এ কারণে কেউ তার শ্লীলতার প্রতিবন্ধক হবে না।

৩. আল-ফিত্বরাতঃ স্বভাবধর্ম, প্রকৃতি। আল্লাহ বলেন,

فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا ۚ فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا ۚ لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

‘তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। এটাই আল্লাহ্‌র প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্‌র সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। বস্তুতঃ এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (রূম ৩০)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

‘প্রত্যেক নবজাত শিশু ফিত্বরাত তথা ইসলামের উপরই ভূমিষ্ঠ হয়; কিন্তু অভ্যাসগতভাবেই তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী, খৃষ্টান ও অগ্নিপূজকে পরিণত করে’।[12]

৪. আল-হায়াঃ লজ্জাবোধ। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,‘লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ’।[13] তিনি আরো বলেন,‘যখন তুমি নির্লজ্জ হবে, তখন যা খুশি তাই করবে’।[14]এ জন্য নিঃসন্দেহে বলা যায়, পর্দা লজ্জাবতী মহিলার মূর্তপ্রতিক।

৫. আত-ত্বাহারাতঃ পবিত্রতা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন,

وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِن وَرَاءِ حِجَابٍ ۚ ذَٰلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ

‘তোমরা তাঁর পত্নীগণের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের অন্তরের জন্য এবং তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ’ (আহযাব ৫৩)।

অত্র আয়াতে পর্দাকেই মানুষের অন্তরের পবিত্রতার উপকরণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। কারণ ধর্ষণের মূল দর্শনই দায়ী। আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র বলেন,

إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا

‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে বাক্যালাপ করো না। কারণ এর ফলে সেই ব্যক্তি কু-বাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে’ (আহযাব ৩২)।

৬. আল-গায়রাতঃ শালীনতা, আত্মমর্যাদা। নারীর জন্য শালীনতা যেহেতু তার মান-মর্যাদার অন্তর্ভুক্ত। তাই তার শালীনতা হানিকর যেকোন আচরণই তার মানহানির নামান্তর। আর কোন নারীকে পরপুরুষ শুধু যৌনসঙ্গমে উপভোগ করলেই তার মানহানিহয় না; বরং কামুক দৃষ্টিতে উপভোগ করলেও মানহানি হয়।

পর্দা সম্ভ্রমের প্রতীকঃ

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,

‘তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না।’ (আযহাব ৫৯)।

রাঈসুল মাফাসসিরীন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, (আল্লাহ তা’আলা) ঈমানদার মহিলাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, যখন তারা বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে বের হবে, তখন যেন নিজেদের চাদর দিয়ে উপর থেকে নিজেদের মুখমণ্ডলকে ঢেকে দেয় এমনভাবে, যাতে করে বক্ষদেশেও আবৃত হয়। আল্লাহ তা’আলা ঈমানদার মহিলাকে এমন নির্দেশ এ জন্যই দিয়েছেন, যাতে করে তাদের পোশাক তাদেরকে সতী-সাধ্বী ঐতিহ্যময়ী মহিলা বলে পরিচয় করে দেয় এবং খারাপ ও দুষ্ট লোকদের মনে এঁটে দেয় হতাশার মোহর।[15]

এবার আল্লাহ্‌র কালাম ও দুনিয়ার বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য করে দেখুন। যারা রাস্তায় ঠাট্টা-মশকারা, বিদ্রুপ, ছিনতাই ও ব্যাভিচারের সম্মুখীন হয়, তারা একমাত্র রূপ-সৌন্দর্যের প্রদর্শনকারিণীরাই। এ জন্য তাদের বেহায়াপনা ও উচ্ছৃংখলতাই দায়ী।

পর্দাহীনতা শয়তানী ও ইহুদী চক্রান্তঃ

রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন,

‘আমার পরে মহিলাদের ফিৎনাই পুরুষদেরকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে’।[16]

বহু চিন্তা, গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের পর ইসলামের শত্রুরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, মহিলাদের চরিত্র ধ্বংসের মাধ্যমেই গোটা মুসলিম জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া যায়। তাই মুসলমানদের চরম শত্রু ইহুদীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক ব্যক্তি বলেছেন যে, এমন যন্ত্র আছে, যা উম্মতে মুহাম্মাদীকে ধ্বংসের ব্যাপারে এক হাযার কর্মীর চেয়েও অধিক কার্যকর। তা হ’ল চরিত্রহীন মহিলা। সুতরাং এদের ধ্বংস করতে হ’লে দ্রুত প্রবৃত্তির অনুসরণের দিকে ঢেলে দাও।

আরেকজন এমনও বলেছেন যে, আমাদের উচিৎ আধুনিকতার নামে মেয়েদের নগ্নতা, বেহায়াপনা ও চরিত্রহীনতার দিকে ঠেলে দেয়া। কেননা যেদিন আমরা এদের উলঙ্গ করে চরিত্রহীন অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারব, তখন তারাই হবে এমন এক দুঃসাহসী বিজয়িনী সৈনিক, যারা উম্মতে মুহাম্মাদীকে ধ্বংস করে সার্থক বিজয় নিয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসবে।[17]

পর্দাহীনতার কতিপয় অকল্যাণঃ

১. ফিৎনা ও অনাচারে পতিত হওয়া

নারী মুখমণ্ডল খোলা রেখে বেপর্দা হ’লে আপনাআপনি ফিৎনা ও অনাচারে লিপ্ত হ’তে বাধ্য হয়। কারণ মুখমণ্ডল খোলা রেখে চলতে গেলে তার মুখমণ্ডলে এমন কিছু বস্তু-সামগ্রী ব্যবহারে অভ্যস্ত হ’তে হয়, যা সহজে পুরুষ হৃদয়কে আকৃষ্ট করে।

২. নারীর লজ্জাশীলতা বিলীন হয়ে যাওয়া

পর্দাহীনতার ন্যায় অসৎ আচরণের কারণে নারীর অন্তর থেকে ক্রমে ক্রমে লজ্জা-শরম বিলুপ্ত হয়ে যায়, যা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত এবং নারী প্রকৃতির অন্যতম দাবী। বস্তুতঃ নারীর লজ্জাহীনতা কেবল দ্বীন ও ঈমান বিধ্বংসী আচরণই নয়; বরং আল্লাহ তাকে যে স্বভাবধর্মে সৃষ্টি করেছেন তার বিরোধিতাও বটে।

৩. পুরুষ অপ্রীতিকর বিষয়ে জড়িত হওয়া

মহিলা সুন্দরী-রূপসী হওয়ার সাথে সাথে যদি তোষামোদপ্রিয়া, হাসি-ঠাট্টাকারিণী ও কৌতুকী হয়, তখন অধিকাংশ বেপর্দা নারীর সাথে এরূপ অশোভন আচরণ সংঘটিত হয়। যেমন- প্রবাদ বাক্য-

‘আঁখি মিলন, এরপর সালাম অনন্তর কালাম

অতঃপর অঙ্গীকার, সাক্ষাৎ, সঙ্গম শেষ পরিণাম’।[18]

পর্দাহীনতার সর্বশেষ পরিণতিঃ

বেপর্দা নারীদের পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন,

إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

‘যারা ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার (নির্লজ্জা) প্রসার লাভ করা পসন্দ করে, তাদের জন্য ইহকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে’ (নূর ১৯)।

মহানবী (ছাঃ) বলেন,

‘দু’টি দল জাহান্নামী, যাদেরকে আমি কখনো দেখিনি। এদের একটি দল এমন, যাদের হাতে সর্বদাই চাবুক থাকে যা দেখতে গরুর লেজের ন্যায়, তা দিয়ে তারা মানুষকে প্রহার করে। (অর্থাৎ যারা সর্বদাই অন্যায়ভাবে মানুষের উপর যুলুম করে)। আর অপরটি নারীর দল, যারা অর্ধনগ্ন অবস্থায় কাপড় পরিধান করে। ফলে তারা লোকদের আকৃষ্ট করে এবং তারাও দুষ্ট লোকদের দ্বারা আকৃষ্ট ও ব্যাভিচারের শিকার হয়। তাদের মাথা যেন উঁচু কুঁজবিশিষ্ট চলন্ত উটের ন্যায়। এরা কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি জান্নাতের গন্ধও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি অনেক অনেত দূর থেকে পাওয়া যাবে’।[19]

পর্দার ব্যপারে পুরুষের ভূমিকাঃ

পুরুষগণ হ’লেন পরিবারের প্রধান। নারীগণ তাদের অধিনস্ত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল’ (নিসা ৩৪)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

‘দায়ূছ’ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। দাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্‌র রাসূল (ছাঃ)! দায়ূছ কে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি তার পরিবারে আল্লাহ্‌র আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোন তৎপরতা অবলম্বন করে না; বরং এটাকে উপেক্ষা করে চলে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে ‘দায়ূছ’ হ’ল সে ব্যক্তি, যে তার পরিবারে বেহায়াপনায় সন্তুষ্ট ও পরিতুষ্ট’।[20]এই কর্তৃত্বের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য এবং জবাবদিহীতা সম্পর্কে মহানবী (ছাঃ) বলেন, ‘পুরুষগণ তার পরিবারের দায়িত্বশীল। অতএব সে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[21]

অনত্র আল্লাহ তা’আলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ

‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণহৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ’ (তাহরীম ৬)।

অতএব আমরা যদি আল্লাহ্‌র বিধান ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত আদর্শকে মেনে নিতে পারি এবং পুরুষেরা যদি তাদের মা-বোনদের ইয্‌যতের মূল্য দেওয়ার জন্য সচেতন দায়িত্বশীল হন এবং পরকালের জবাবদিহীতার কথা স্মরণ করেন, তবে আজ সারা বিশ্বে যে নারী কণ্ঠের করুণ আর্তনাদ ভেষে আসছে এবং দৈনিক পত্র-পত্রিকাগুলিতে যে চোখ ঝলসানো লোমহর্ষক দৃশ্যগুলি চোখে পড়ছে তা হয়ত আর চোখে পড়বে না। ফলে গড়ে উঠবে সুন্দর ও শান্তির সমাজ, ফিরে পাব সোনালী যুগের ইতিহাস। সর্বোপরি পরকালীন জীবনে আমরা হব চির শান্তির নিবাস জান্নাতের অধিবাসী। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন আমীন!!

* দিগদানা, ঝিকরগাছা, যশোর

তথ্যসূত্র :

[1] ডঃ মোহাম্মাদ ফজলুর রহমান, আরবী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান (ঢাকাঃ রিয়াদ প্রকাশনী, ২য় সংষ্করণঃ জানুঃ ২০০০) পৃঃ…

[2] মুসলিম বোন! কে তোমাকে পর্দার আদেশ দিয়েছেন? সম্পাদনাঃ শাহ ওয়ালীউল্লাহ (ঢাকাঃ ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংস্থা, ১ম প্রকাশঃ জানুয়ারী ’৯৭), পৃঃ ১৩

[3] তদেব

[4] মুফতী মুহাম্মাদ শফী, তাফসীরে মা’আরেফুল কুরআন, অনুবাদ ও সম্পাদনাঃ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃঃ ৯৩৮

[5] তিরমিযী, আবুদাঊদ, নাসাঈ, সনদ হাসান, মিশকাত হা/১০৬৫ ‘ছালাতের জামা’আত ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ

[6] আবুদাঊদ, সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৪৪৬৯ ‘পোশাক’ অধ্যায় ‘চুল আঁচড়ানো’ অনুচ্ছেদ

[7] মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছাইমিন, পর্দা, অনুবাদঃ মিজানুর রহমান বিন আবুল হুসাইন (প্রকাশকঃ আল-মাকতাবুত তা’আভুনী লিদ-দা’ওয়াহ ওয়াল ইরশাদ বিল বাদী’আহ, ১৪১৬ হিঃ), পৃঃ ১৬

[8] প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭

[9] প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮

[10] প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩

[11] প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০২

[12] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৯০ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘তাক্বদীরের উপর বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ

[13] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫ ‘ঈমান’ অধ্যায়

[14] বুখারী, মিশকাত হা/৫০৭২, ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়

[15] মুসলিম বোন! কে তোমাকে পর্দার আদেশ দিয়েছেন? পৃঃ ১১

[16] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩০৮৫ ‘বিবাহ’ অধ্যায়

[17] মুসলিম বোন! কে তোমাকে পর্দার আদেশ দিয়েছেন? পৃঃ ২০

[18] পর্দা, পৃঃ ৩৮-৪০

[19] মুসলিম, পৃঃ ২১৩ ‘পোষাক ও সৌন্দর্য’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৩৫২৪ ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়

[20] আহমাদ

[21] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত‘ইমারত’ অধ্যায়

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button