
সলাতে মুবাশ্শির (পর্ব ২৯)
রচনায় : আব্দুল হামীদ ফাইযী
রুকূ ও তার পদ্ধতি
‘রফয়ে য়্যাদাইন’ করে নবী মুবাশ্শির (সাঃ) তকবীর বলে রুকূতে যেতেন। রুকূ করা ফরয। মহান আল্লাহ বলেন,
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا ارْكَعُوْا وَاسْجُدُوْا।।।।।
অর্থাৎ, হে ঈমানদাগণ! তোমরা রুকূ ও সিজদা কর—। (কুরআন মাজীদ ২২/৭৭)
মহানবী (সাঃ) ও নামায ভুলকারী সাহাবীকে তকবীর দিয়ে রুকূ করতে আদেশ করে বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কারো নামায ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে উত্তমরুপে ওযু করে—- অতঃপর তকবীর দিয়ে রুকূ করে এবং উভয় হাঁটুর উপর হাত রেখে তার হাড়ের জোড়গুলো স্থির ও শ্রান্ত হয়ে যায়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৭, নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক)
রুকূতে ঝুঁকে তিনি হাতের চেটো দু’টোকে দুই হাঁটুর উপর রাখতেন। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৮০১ নং) আর এইভাবে রাখতে আদেশও দিতেন। হাত দ্বারা হাঁটুকে শক্ত করে ধরতেন। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৭৯২ নং) হাতের আঙ্গুলগুলোকে খুলে (ফাঁক ফাঁক করে) রাখতেন। (হাকেম, মুস্তাদরাক, সআবূদাঊদ, সুনান ৮০৯ নং) আর এইরুপ করতে তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকে আদেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “যখন রুকূ করবে তখন তুমি তোমারহাতের চেটো দু’টোকে তোমার দুই হাঁটুর উপর রাখবে। অতঃপর আঙ্গুলগুলোর মাঝে ফাঁক রাখবে। অতঃপর স্থির থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যেক অঙ্গ স্ব-স্ব স্থানে বসে না যায়।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৫৯৭ নং, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
এই রুকূর সময় তিনি তাঁরহাতের দুই কনুইকে পাঁজর থেকে দূরে রাখতেন। (তিরমিযী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, মিশকাত ৮০১নং)এই সময় তিনি তাঁর পিঠকে বিছিয়ে লম্বা ও সোজা রাখতেন। কোমর থেকে পিঠকে মচকে যাওয়া ডালের মত ঝুঁকিয়ে দিতেন। (বুখারী ৮২৮, বায়হাকী, মিশকাত ৭৯২নং) তাঁর পিঠ এমন সোজা ও সমতল থাকত যে, যদি তার উপর পানি ঢালা হত তাহলে তা কোন দিকে গড়িয়ে পড়ে যেত না। (ত্বাবা,কাবীরসাগীর,আহমাদ, মুসনাদ১/১২৪,ইবনে মাজাহ্, সুনান ৮৭২)
তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকে আদেশ করে বলেছিলেন, “যখন তুমি রুকূ করবে, তখন তোমার দুইহাতের চেটোকে দুই হাঁটুর উপর রাখবে, তোমার পিঠকে সটান বিছিয়ে দেবে এবং দৃঢ়ভাবে রুকূ করবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান)
রুকূতে তিনি তাঁর মাথাকেও সোজা রাখতেন। পিঠ থেকে মাথা না নিচু হত, না উঁচু। (আবূদাঊদ, সুনান, বুখারী জুযউল ক্বিরাআহ্,মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮০১ নং) আর নামাযে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হত সিজদার স্থানে। (বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৫৪নং)
রুকূতে স্থিরতার গুরুত্ব
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) রুকূতে স্থিরতা অবলম্বন করতেন। এ ব্যাপারে তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকে আদেশও করেছেন। আর তিনি বলতেন, “তোমরা তোমাদের রুকূ ও সিজদাকে পরিপূর্ণরুপে আদায় কর। সেই সত্তার শপথ! যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে, আমি আমার পিঠের পিছন থেকে তোমাদের রুকূ ও সিজদাহ করা দেখতে পাই। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৮৬৮নং)
তিনি এক নামাযীকে দেখলেন, সে পূর্ণরুপে রুকূ করে না, আর সিজদাহ করে ঠকঠক করে। বললেন, “যদি এই ব্যক্তি এই অবস্থায় মারা যায়, তাহলে সে মুহাম্মাদের মিল্লাত ছাড়া অন্য মিল্লাতে থাকা অবস্থায় মারা যাবে। ঠকঠক করে নামায পড়ছে; যেমন কাক ঠকঠক করে রক্ত ঠুকরে খায়! যে ব্যক্তি পূর্ণরুপে রুকূ করে না এবং ঠকঠক করে সিজদাহ করে, সে তো সেই ক্ষুধার্ত মানুষের মত, যে একটি অথবা দু’টি খেজুর খায়, যাতে তার ক্ষুধা মিটে না।” (আবু য়্যা’লা, আজুরী, বায়হাকী, ত্বাবারানী, মু’জাম, যিয়া, ইবনে আসাকির, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৩১পৃ:)
আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, ‘আমার বন্ধু আমাকে নিষেধ করেছেন যে, আমি যেন মোরগের দানা খাওয়ার মত ঠকঠক করে নামায না পড়ি, শিয়ালের মত (নামাযে) চোরা দৃষ্টিতে (এদিক-ওদিক) না তাকাই, আর বানরের বসার মত (পায়ের রলা খাড়া করে) না বসি।’ (ত্বায়ালিসী, আহমাদ, মুসনাদ ২/২৬৫, ইবনে আবী শাইবা)
তিনি বলতেন, “সবচেয়ে নিকৃষ্ট চোর হল সেই ব্যক্তি, যে তার নামায চুরি করে।” লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! নামায কিভাবে চুরি করবে?’ বললেন, “পূর্ণরুপে রুকূ ও সিজদাহ না করে।” (ইবনে আবী শাইবা ২৯৬০ নং, ত্বাবা,হাকেম, মুস্তাদরাক)
একদা তিনি নামায পড়তে পড়তে দৃষ্টির কোণে দেখলেন যে, এক ব্যক্তি তার রুকূ ও সিজদায় মেরুদন্ড সোজা করে না। নামায শেষ করে তিনি বললেন, “হে মুসলিম দল! সেই নামাযীর নামায হয় না, যে রুকূ ও সিজদায় তার মেরুদন্ড সোজা করে না।” (ইবনে আবী শাইবা ২৯৫৭, ইবনে মাজাহ্, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৩৬ নং)
তিনি আরো বলেন, “সে নামাযীর নামায যথেষ্ট নয়, যে রুকূ ও সিজদায় তার পিঠ সোজা করে না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৫নং, আহমাদ, মুসনাদ)
রুকূর গুরুত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি একটি রুকূ অথবা সিজদাহ করে, সে ব্যক্তির তার বিনিময়ে একটি মর্যাদা উন্নত হয় এবং একটি পাপ মোচন হয়ে যায়।” (আহমাদ, মুসনাদ,বাযযার,দারেমী, সুনান,সহিহ তারগিব ৩৮৫নং)
রুকূর যিক্র
মহানবী (সাঃ) রুকূতে গিয়ে কয়েক প্রকার দুআ ও যিক্র পড়তেন। কখনো এটা কখনো ওটা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম দুআ পাঠ করতেন। যেমন:-
১। ُ سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيْم
উচ্চারণ:- সুবহা-না রাব্বিয়াল আযীম।
অর্থ:- আমি আমার মহান প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা করছি।
এটি তিনি ৩ বার পাঠ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, দারাক্বুত্বনী, সুনান, ত্বাহা, বাযযার, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৬০৪নং, ত্বাবারানী, মু’জাম)
অবশ্য কোন কোন সময়ে তিনের অধিকবারও পাঠ করতেন। কারণ, কখনো কখনো তাঁর রুকূ ও সিজদাহ কিয়ামের মত দীর্ঘ হত। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৩২পৃ:)
২।سُبْحَانَ رَبِّىَ الْعَظِيْمِ وَبِحَمْدِهِ।
উচ্চারণ- সুবহা-না রাব্বিয়াল আযীম অবিহামদিহ্।
অর্থ- আমি আমার মহান প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করছি। ৩ বার। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৮৫নং, দারাক্বুত্বনী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, মু’জাম, বায়হাকী)
৩। سُبُّوْحٌ قُدُّوْسٌ رَبُّ الْمَلاَئِكَةِ وَالرُّوْحِ।
উচ্চারণ:- সু ব্বূহুন ক্বুদ্দূসুন রাব্বুল মালা-ইকাতি অররুহ্।
অর্থ- অতি নিরঞ্জন, অসীম পবিত্র ফিরিশ্তামন্ডলী ও জিবরীল (আহমাদ, মুসনাদ) এর প্রভু (আল্লাহ)। (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮৭২ নং)
৪। سُبْحَانَكَ اللّهُمَّ رَبَّنَا وَ بِحَمْدِكَ اللّهُمَّ اغْفِرْلِيْ।
উচ্চারণ:- সুবহা-নাকাল্লা-হুম্মা রব্বানা অবিহামদিকা,আল্লা-হুম্মাগ ফিরলী।
অর্থ- হে আল্লাহ! আমি তোমার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করি, হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাকে মাফ কর।
উক্ত দুআ তিনি অধিকাংশ পাঠ করতেন। এ ব্যাপারে তিনি কুরআনের নির্দেশ পালন করতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৮৭১নং)যেহেতু কুরআনে আল্লাহ তাঁকে আদেশ করেছেন,
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّاباً
অর্থাৎ, সুতরাং তুমি তোমার প্রভুর সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি তওবা গ্রহণকারী। (কুরআন মাজীদ ১১০/৩)
৫। اَللّهُمَّ لَكَ رَكَعْتُ وَ بِكَ آمَنْتُ وَلَكَ أَسْلَمْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ، أَنْتَ رَبِّيْخَشَعَ سَمْعِيْ
وَبَصَرِيْ وَدَمِيْ وَلَحْمِيْ وَعَظْمِيْ وَ عَصَبِيْ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ।
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা লাকা রাকা’তু অবিকা আ-মানতু অলাকা আসলামতু অ আলাইকা তাওয়াক্কালতু আন্তা রাব্বী , খাশাআ সাময়ী, অ বাস্বারী অ দামী অ লাহ্মী অ আযমী অ আস্বাবী লিল্লা-হি রাব্বিল আলামীন।
অর্থ:- হে আল্লাহ! আমি তোমারই জন্য রুকু করলাম, তোমারই প্রতি বিশ্বাস রেখেছি, তোমারই নিকট আত্মসমর্পণ করেছি, তোমারই উপর ভরসা করেছি, তুমি আমার প্রভু। আমার কর্ণ, চক্ষু, রক্ত, মাংস, অস্থি ও ধমনী বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য বিনয়াবনত হল। (মুসলিম, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১০০৬ নং)
৬। سُبْحَانَ ذِي الْجَبَرُوْتِ وَالْمَلَكُوْتِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْعَظَمَةِ।
উচ্চারণ:- সুবহা-না যিল জাবারুতি অল মালাকূতি অল কিবরিয়া-ই অল আযামাহ্।
অর্থ- আমি প্রবলতা, সার্বভৌমত্ব, গর্ব ও মাহাত্মের অধিকারী (আল্লাহর) পবিত্রতা ঘোষণা করি।
এই দুআ’টি তিনি তাহাজ্জুদের নামাযের রুকূতে পাঠ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৭৩, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১০০৪ নং)
রুকূর আনুষঙ্গিক মাসায়েল
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) এর রুকূ, রুকূর পর কওমাহ্, সিজদাহ এবং দুই সিজদার মাঝের বৈঠক প্রায় সমপরিমাণ দীর্ঘ হত।(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৮৬৯ নং)
রুকূ ও সিজদাতে তিনি কুরআন পাঠ করতে নিষেধ করতেন। তিনি বলতেন, “শোন! আমাকে নিষেধ করা হয়েছে যে, আমি যেন রুকূ বা সিজদাহ অবস্থায় কুরআন না পড়ি। সুতরাং রুকূতে তোমার প্রতিপালকের তা’যীম বর্ণনা কর। আর সিজদায় অধিকাধিক দুআ করার চেষ্টা কর। কারণ তা (আল্লাহর নিকট) গ্রহণ-যোগ্য।” (মুসলিম, মিশকাত ৮৭৩নং)
যেহেতু আল্লাহর কালাম (বাণী)। সবচেয়ে সম্মানিত বাণী। আর রুকূ ও সিজদার অবস্থা হল বান্দার পক্ষে হীনতা ও বিনয়ের অবস্থা। তাই আল্লাহর বাণীর প্রতি আদব রক্ষার্থে উক্ত উভয় অবস্থাতেই কুরআন পাঠ সঙ্গত নয়। বরং এর জন্য উপযুক্ত অবস্থা হল কিয়ামের অবস্থা। (মাদারিজুস সা-লিকীন ২/৩৮৫)
উল্লেখ্য যে, দীর্ঘ নামাযের একই রুকূতে কয়েক প্রকার যিক্র এক সঙ্গে পাঠ দূষণীয় নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৩৩, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৩৪পৃ:)
(চলবে)