
ইন্টারফেয়ার: পর্ব-৩
আমরা আলোচনা করছিলাম ইসলাম সম্পর্কে আমাদের ধারনাকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে কুফফাররা কীভাবে কাজ করে যাচ্ছে সে সম্পর্কে। সে ধারাবাহিকতায় আজ আমরা তাদের একটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করব। তা হল তারা কীভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের সীরাত সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞ রাখতে চেষ্টা করছে।
রাসূল (সা) ও সাহাবাদের জীবনীর ওপর হস্তক্ষেপঃ
আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে একবার কয়েকজন সাহাবী অনুরোধ করলেন রাসূল (সা) এর চরিত্র সম্পর্কে কিছু বলতে। আয়িশা বললেন, “তোমরা কি কুরআন পড় না? এই কুরআনই হল তাঁর (মুহাম্মাদ) চরিত্র।”
যেহেতু রাসূল (সা) হচ্ছেন মুসলিমদের আদর্শ এবং তাঁর জীবনের দিকে তাকিয়েই মুসলিমদের ইসলাম শেখার কথা, কাজেই রাসূল (সা) এর জীবনে ইসলামের সম্পূর্ণ শিক্ষার প্রতিফলন থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তিনি কাজ করেছেন রাখাল হিসেবে, ব্যবসায়ী হিসেবে, গৃহকর্তা হিসেবে, রাজনীতিবিদ হিসেবে, যোদ্ধা হিসেবে, সামরিক অধিনায়ক হিসেবে, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে- কোথায় তাঁর আদর্শ নেই !! একজন মানুষ কেবল তাঁর সীরাত পড়েই ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণ ধারনা পাবার সামর্থ্য রাখে-এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছি কুফফাররা কুরআনকে কীভাবে গণ্ডিবদ্ধ করল। এখন তারা দেখল কেবল কুরআনকে তালাবদ্ধ করেই ইসলাম শেখা থেকে মুসলিমদের দূরে রাখা যাচ্ছে না, যতক্ষণ না রাসূল (সা) আর সাহাবাদের (রা) জীবনী তাদের সামনে থেকে যাচ্ছে। কেননা রাসূল (সা) এর জীবনটাই কুরআনের বাস্তব রূপ। ফলে মুসলিমরা তাঁদের সীরাত থেকে ইসলাম শিখে নেবে। কাজেই এবার হস্তক্ষেপ করতে হবে রাসূল (সা) এর সীরাতের ওপর।
রাসূল (সা) এর জীবনীর দিকে নজর দিলেই আমরা দেখতে পাই, ইসলাম কতটা ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। রাসূল (সা) গৌতম বুদ্ধ বা মহাত্মা গান্ধীর মত কেবল প্রেম আর অহিংস বাণী প্রচার করে যান নি, আবার চে বা লেনিনের মত সন্ত্রাসও করে যান নি। তিনি কোমল হয়েছেন, প্রয়োজনে কঠোর হয়েছেন। কাফিররা তাঁর আচরণে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে, আবার তিনি তরবারির আঘাতে কাফিরদের শিরোচ্ছেদও করেছেন। যে রাসূল মক্কা বিজয়ের পর অগণিত পাপিষ্ঠ কাফিরকে ক্ষমা করেছেন যে রাসূল (স) ই বনু কুরাইজা গোত্রের ৭০০ ইহুদিকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রদোহের অপরাধে। এসবগুলো কো রিলেটেড। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটাকে নিলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে না। কেবল ভালোবাসা আর ক্ষমার অংশটা তুলে ধরলে মনে হবে ইসলাম নিস্ক্রিয় আঘাতসহ ধর্ম, আবার কেবল প্রতিরোধের কথা উল্লেখ করলে মনে হবে ইসলাম সন্ত্রাসে উৎসাহ দেয়।
কাফিররা তাই নিজেদের দেশে রাসূল (সা) এর প্রেম বা ভালোবাসার আদর্শের কথা সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে কেবল তাঁর হত্যা বা যুদ্ধ-রক্তপাত সংক্রান্ত ঘটনাগুলো তুলে ধরে। সেটাও এভাবে যে, কাফিররা কোন অপরাধ করেনি, রাসূল (সা) তাদের শুধুশুধু হত্যা করেছিলেন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কিংবা স্বার্থ হাসিল করতে। যেন তারা ধারনা পায় যে ইসলাম নির্দেশ করেছে অমুসলিম পেলেই হত্যা করতে হবে, রক্তপাত ব্যতীত আর কোন কথা ইসলামে নেই। চিন্তা করুন, রাসূল (সা) যে বনু কুরাইজা গোত্রের ৭০০ ইহুদিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেটা বিচ্ছিন্নভাবে একজন অমুসলিমের কাছে তুলে ধরলে ইসলাম সম্পর্কে তার কী ধারনা হতে পারে !! তাই আজ কাফির রাষ্ট্রগুলোর সাধারন মানুষের অনেকের কাছেই ইসলাম হল সন্ত্রাসের ধর্ম, আর রাসূল (সা) হলেন সবথেকে বড় সন্ত্রাসী !! (নাউযুবিল্লাহ)
আবার কুরআনের কঠোর আয়াতগুলো তারা অপব্যাখ্যা করে অমুসলিমদের কাছে তুলে ধরল, যেন তাদের মনে বদ্ধমূল হয় ইসলাম অমুসলিমদের পাইকারি হারে হত্যা করতে আদেশ করে। এর ফলে তাদের মাঝে এই ধারনা প্রতিষ্ঠা সম্ভব যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেই অমুসলিমদের ওপর অত্যাচার আর নির্যাতন নেমে আসবে। তাই যেখানেই শরীয়াহ কায়েমের চেষ্টা করা হয়, সেখানেই তারা “মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা”র নামে হামলা করার একটা জাস্টিফিকেশন নিজেদের দেশের লোকদের কাছে পেয়ে যায়।
বিপরীত মেথড কাফিররা অ্যাপ্লাই করল মুসলিমদের ওপর। তারা জানে মুসলিমদের কাছে নবীজী বা সাহাবাদের চরিত্রে কালিমা লেপন করার চেষ্টা করে লাভ নেই। তাহলে কী করা যায়?? তারা নিজেদের লোকেদের কাছে ইসলামের কেবল কঠোর দিকগুলো তুলে ধরে ভুল ধারনা দিয়েছে, আর মুসলিমদের কাছে রাসূলের কঠোর দিকগুলো সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে ইসলামকে ভুলভাবে তুলে ধরেছে। তারা মুসলিমদের কাছে তুলে ধরেছে ইসলাম হল শান্তির ধর্ম, এতে মারামারি রক্তপাত ইত্যাদি নেই। মারামারি, রক্তপাত এসব অধর্ম, ইসলামে এর কোন স্থান নেই। দেখবেন ছোটবেলা থেকে রাসূলের (সা) জীবনের যা কিছু আমাদের শেখানো হয় তাতে শুধু ক্ষমা আর ভালোবাসা, এর বাইরে কিছু নেই। কাঁটা দেওয়া বুড়িকে মাফ করার (যদিও কাহিনীটির ভিত্তি নেই) গল্প শেখানো হয় কিন্তু একই রাসূল (সা) যে গুপ্তহত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং যারা তাতে অংশ নিয়েছিল তাদের জন্য কিয়ামতের দিন মুখ উজ্জ্বল হবার দু’আ করেছিলেন, সেটা সম্পূর্ণ অমিট করা হয়। মক্কা বিজয়ের পর সবাইকে মাফ করে দেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা হয় কিন্তু ইবন খাতালাকে যে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয় সেটা কোথাও উল্লেখ করা হয় না। ইবন খাতালার অপরাধ ছিল সে আল্লাহ্ ও রাসূলের বিষেদগার করে গান লিখত।
যে রাসূল (সা) কে আমরা প্রেমের আধার বলে জানি তিনিই কিন্তু বলেছেন “জান্নাত তরবারীর ছায়াতলে” কিংবা “আমার রিযিক আসে আমার বর্শার নিচ থেকে।” এই তিনিই কিন্তু কমবেশি ২৭টি যুদ্ধে সশস্ত্র অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এই ব্যাপারগুলো আমাদের জানানো হয় না, যেন আমরা ইসলাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারনা না পাই। কাফিরদের সাথে কঠোর হওয়া যে মুসলিমের বৈশিষ্ট্য এটা মাথায় ঢোকে না বলেই লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে মেরে পশ্চিমারা হাত রঞ্জিত করলেও আমরা ভাবি তাদের কাছে ইসলামের প্রেমের দাওয়াত পৌঁছে দিতে হবে, আর মুজাহিদীনরা সন্ত্রাস করছে !! কাফিররা যেন আমাদের খারাপ না ভাবে সে চিন্তায় দিন গুজরান করি, অথচ জানার চেষ্টা করি এসব ব্যাপারে তাদের প্রতি রাসূল (সা) এর স্টান্স কতটা কঠোর ছিল।
ফলাফল চোখের সামনে। যে কাফিররা কোন মুসলিম নারীর দিকে চোখ তুলে তাকাতে সাহস পেত না তারা আজ হাজার হাজার মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করছে, বোন ফাতিমাদের দিনে নয়বার করে ধর্ষণ করেছে, হত্যা করেছে, লক্ষ লক্ষ শিশুদের জবাই করছে, তারপরও গলা উঁচিয়ে কথা বলার সাহস দেখাচ্ছে। কারণ একটাই- আমরা “ইসলাম শান্তির ধর্ম” বলে মুখে ফেনা তুলতে থাকছি, অথচ সাহাবাদের তরিকায় কঠোর হলে আজ মুসলিমদের নামে জালিমের সিংহাসন থরথর করে কেঁপে ওঠার কথা। এই “কঠোর” হওয়ার মানসিকতা আমাদের থেকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছে ইসলামের অসম্পূর্ণ শিক্ষাকে মগজে ঢুকিয়ে দিয়ে। আর তাই আজ কাফিররা বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের নিয়ে খেলছে, আমরা ব্যস্ত আছি মেসি বড় না রোনালদো বড় তা নিয়ে।
সীরাতের ওপর হস্তক্ষেপের আরেকটা রূপ আছে। প্রথমে পশ্চিমারা রাসূল (সা) আর সাহাবাদের (রা) চরিত্রে কালিমা লেপনের চেষ্টা করেছিল, পারে নি। এরপর পশ্চিমা মিডিয়া আর তাদের নির্দেশিত সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের সামনে তাঁদেরকে অতিপ্রাকৃত হিসেবে তুলে ধরেছে। এভাবে যে তাঁরা ছিলেন মহা মহামানব, অন্য গ্রহের মানুষ, তাঁরা জগতের সব সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে ছিলেন, তাই তাঁরা অমন পেরেছিলেন। আমরা যেহেতু মহামানব নই, কাজেই আমরা তাঁদের মত হতে পারব না, সে চেষ্টা করেও লাভ নেই। সুতরাং ইসলামের রাস্তায় না গিয়ে সমাধান খুঁজতে হবে পশ্চিমাদের শিখিয়ে দেওয়া মেথডে।
তাই রাসূল (সা) এবং তাঁর সাহাবাদের আমরা নিজেদের জীবনের সাথে রিলেট করতে পারি না। উমার (রা) এর শাসনব্যবস্থা আমাদের কাছে রূপকথার মত মনে হয়। ‘এ যুগে অমন নিখুঁত শাসন সম্ভব না’- না চাইলেও মাথায় স্থান পেয়ে যায় বিষয়টা। তাঁদের জীবন যেন আমাদের কাছে তাই কল্পকাহিনী হয়ে থাকে, যেমনটা থাকে গ্রিক মিথ বা আরব্য রজনীর নায়কেরা। বইয়ের পাতা থেকে তাঁদের শিক্ষাকে নিজের জীবনে নিয়ে আসা হয় না। তাই তাঁদেরকে আমরা Admire করতে পারি, কিন্তু Follow করতে পারি না।
আর তাই খিলাফাহকে কেউ Utopia (perfect state) বলে বর্তমান যুগে সম্ভব নয় বললে আমরা মাথা নেড়ে সায় দেই। ভাবি ঠিকই তো বলেছে।
এ অবস্থা থেকে মুক্তির একটাই উপায়, রাসূল (সা) ও তাঁর সাহাবাদের সীরাত বেশি বেশি অধ্যয়ন করা। রাসূল (সা) এর জীবনের কোমল ও কঠোর দুটি দিক সম্পর্কেই ধারনা লাভ করা।
[চলবে..]
লেখক : জুবায়ের হোসাইন
উৎসঃ ফেসবুক