
আল-বাত্তানী : যিনি ভুল প্রমাণ করেন টলেমির দেয়া তত্ত্ব
একজন মুসলিমের ধ্রুপদ অবদানসূত্রে নবম শতাব্দী স্বতন্ত্র হয়ে ধরা পড়ে। নবম শতাব্দীকে স্মরণের আনলেই এই মুসলিম মনীষী আমাদের স্মরণে আঘাত হানেন। তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞানী-দার্শনিক-দরবেশ। সায়েন্টিস্ট-ফিলোসফার-সেইন্ট। নাম আবু আবদুল্লাহ ইবনে জাবির ইবন সানান আল-বাত্তানী আল-হারানী। তিনি মানব জাতিকে উপহার দিয়ে গেছেন সৌর বছরের সঠিক পরিমাপ। তিনি হিসেব করে দেখান ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে এক সৌর বছর। এ সম্পর্কিত হালনাগাদ হিসাব এই পরিমাপের কাছাকাছি। সে কারণে সত্যিকার অর্থে সৌর বছরের আবিষ্কারক হিসাবে স্বীকৃতি পাবার যোগ্য হচ্ছেন আল-বাত্তানী।
পণ্ডিতবর আল-বাত্তানী একজন দরবেশতুল্য মানুষ ছিলেন। হারান রাজ্যে তাঁর জন্ম। জন্মেছেন ৮৬৮ খৃষ্টাব্দে। কারও কারও মতে, হারান রাজ্যের বাত্তান নামের এক স্থান তার জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন একজন বিশিষ্টজন। বাত্তানী তাঁর প্ৰাথমিক শিক্ষা নেন তাঁর বাবার কাছে। তার বাবার নাম ছিল জাবির ইবনে সানান আল-বাত্তানী। তিনিও তার সময়ের একজন বড় বিজ্ঞানী ছিলেন। আবু আব্দুল্লাহ রাক্কাতে যান মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্যে। ইউফ্রেটিস নদীর তীরে রাক্কা ছিল জ্ঞানার্থীদের জন্যে এক তীর্থস্থান। জ্ঞানান্বেষণে সাগ্রহীরা রাক্কায় যেতেন। এটা ছিল পণ্ডিতদের এক নগরী। জ্ঞানী-গুণী আর প্রাজ্ঞ জনেরা সেখানে বসবাস করতেন। আব্দুল্লাহ নিজের জন্যে সেখানে একটা স্থান করে নিতে সক্ষম হন। তিনি সেখানে একজন সর্বজনগ্রাহ্য পণ্ডিতরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
নবম শতাব্দীর শুরুতে তিনি চলে যান সামারাহতে। সেখানে তিনি বাকি জীবন বসবাস করেন। তিনি বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিভিন্ন রাজ্যে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ জ্যোতির্বিদ। তখন তাঁর সমতুল্য জ্যোতির্বিদ কেউ ছিলেন না। সেই সাথে তিনি ছিলেন বড় মাপের গণিতবিদ। তিনি একটানা ৪২ বছর এক্ষেত্রে নানা গবেষণা চালিয়ে যান। তিনি গবেষণা চালান গণিত আর জ্যোতির্বিদ্যার নানা শাখায়। এসব গবেষণার মাধ্যমে তিনি মানব জাতির সামনে অসাধারণ সত্য উদঘাটন করে গেছেন। তিনি টলেমীর অনেক তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেন। সূর্য ও পৃথিবীর সর্বোচ্চ অবস্থান সম্পর্কিত টলেমীর একটি তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করে আমাদের কাছে তিনি প্রকৃত সত্য উদঘাটন করেন। সঠিকভাবে পরিমাপ করে দেখান, এটা হচ্ছে ১৬ দশমিক ৬৭ ডিগ্রি।
এ আবিষ্কার সূর্যের গতি ও সময়ের সমীকরণে সামান্য পরিবর্তন আনে। কপারনিকাস সূর্যের ইকুইটারিয়েল গতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু আল-বাত্তানী তা কখনও বিশ্বাস করতেন না। আল-বাত্তানী গ্রহণের সময়ের সূর্যের ও চাঁদের সঠিক পরিমাপ নির্ণয় করেন। তিনি ঋতুর সময়-পরিধিও নির্ণয় করেন। সঠিকভাবে সূর্যের কক্ষপথে পরিভ্রমণ পরিস্থিতি তুলে ধরতে সক্ষম হন। তিনি এর সবচে’ কম গড়ও নির্ধারণ করেন।
আল-বাত্তানী সম্পূর্ণভাবে সূৰ্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কিত টলেমীর ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেন। তিনি উল্লেখ করেন, সূর্যের কৌণিক অবস্থান পরিবর্তনীয়। তিনি বার্ষিক সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্ৰগ্ৰহণ সম্পর্কিত তথ্য আমাদের জানান। আসলে তিনি তৎসময়ের চন্দ্ৰ-সূৰ্য-গ্ৰহ সম্পর্কিত সকল বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আনেন। বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন প্রকৃত সত্য। সত্য ধারণার প্রতিফলন ঘটান। তিনি ১৭৩৯ খৃষ্টাব্দে নতুন চাঁদ দেখার সঠিক পদ্ধতির সূচনা করেন। জ্যোতিষী দানত্রোনে সফলতার সাথে আল-বাত্তানী পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে গেছেন। গ্লোবোলার ত্রিকোণোমিতির নানা সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন আল-বাত্তানী।
গণিতের বিষয়েও তিনি ছিলেন একজন অগ্রদূত। তিনি গ্ৰীকদের সিম্ফোনি সিস্টেমের বিনাশ সাধন করেন। এর পরিবর্তে সূচনা করেন বিশুদ্ধ বানান বিদ্যা বা অর্থে গ্রাফি। তাঁর এ পদ্ধতি আরও উন্নততর বলে প্রমাণিত হয়।
আব্দুল্লাহ আল-বাত্তানী জ্যোতির্বিদ্যা ও ত্রিকোণোমিতি বিষয়ে অনেক বই লিখে গেছেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বই হচ্ছে : Geej। এটি লাতিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। রোমের ভ্যাটিকানে এর মূল কপি পাওয়া যায়। রেনেসাঁ-পূর্ব ইউরোপকে তাঁর আবিষ্কার ও ধারণা ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত করতে পেরেছিল। তাঁর বইগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। জ্যোতিবির্দ্যা ও ত্ৰিকোণোমিতি সম্পর্কিত তার আবিষ্কার-উদ্ভাবন ছিল শিক্ষণীয়। বিজ্ঞানের এই দু’টি শাখার উন্নয়নে তাঁর অবদান আমাদের জন্যে প্রেরণার উৎস।