
এবং হিমু যখন প্র্যাকটিসিং মুসলমান (পর্ব-৩)
কাঁটা মুক্তির যে আনন্দ এই বাড়িতে শুরু হল তার কাছে বিয়ে বাড়ির আনন্দ কিছুই না। ফুপু ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মরাকান্না শুরু করলেন। বাদল যতই বলে কি যন্ত্রণা মা , আমাকে ছাড় তো। তিনি ততই শক্ত করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন।
ফুপা আনন্দের চটে পীর বাবার দেয়া বিশেষ জিকিরে বসতে যাচ্ছেন। আজ বৃহস্পতিবার এমনিতেই তার জিকিরের দিন। ছেলের সমস্যার জন্যে ঠিক মতো বসতে পারছিলেন না। আজ সে মনে হয় সিদ্ধি টেনে বসবেন। সিদ্ধি অর্থাৎ গাঁজা। ডাক্তারের যে ওষুধ ফুপা জিকিরের আগে খান সেটা আসলে তার ঝিমুনি আনে না । ঝিমুনি আনে সিদ্ধি। সিদ্ধি টানলে নাকি জিকিরের সময় পীরবাবার দিদার হয়। জিকির হয় একশয়ে একশ। ফুপা আজকে সিদ্ধি টানবেণ। বেশ আয়েশ করেই টানবেণ।
ফুপা যে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছেন সংস্কৃত কবিরা সেই দৃষ্টিকে বলেন প্রেম নয়ন। শুধু ইরামের চোখ কঠিন। পাথরের চোখেও সামান্য তরল ভাব থাকে তার চোখে তাও ণেই। ক্লিন সেইভড ছেলেদের এমন কঠিন দৃষ্টি মানায় না। কেমন জেনো মেয়ে মেয়ে লাগে। অস্বস্তি কর।
রাতে ফুপার বাড়িতে থেকে গেলাম। আজ আমার থাকার জায়গা হল গেস্ট রুমে। এই বাড়ির গেস্ট রুম তালাবদ্ধ থাকে। বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর গেস্ট এলেই শুধু তালা খোলা হয়। আজ আমি বিশেষ শ্রেণীর একজন গেস্ট। ঘুমুতে যাবার আগে আগে আমার জন্যে কফি চলে এলো। এটিও বিশেষ ব্যবস্থার একটা অংশ। কফি নিয়ে এল ইরাম। ইরাম সম্পর্কে এ পর্যন্ত তথ্য যা সংগ্রহ করেছি তা হচ্ছে — ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকে পড়ে। কিছুটা নাস্তিক গোছের। কিছুটা না । পুরো পুরি আপাদমস্তক নাস্তিক গোছের। তার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। হলে পড়া শোনার সমস্যা হচ্ছে তাই এ বাড়িতে চলে এসেছে। ফুপার খালাতো ভাইয়ের বড় ছেলে। দারুণ নাকি ব্রিলিয়ান্ট। না পড়লেও নাকি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবে। তারপরেও পড়ছে, কারণ রেকর্ড মার্ক পেতে চায়।
ইরাম কফির কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল
আপনার ধারনা আজ আপনি আপনার বিশেষ এক অলৌকিক ক্ষমতা দেখালেন?
আমি কফির কাঁপে চুকুম দিতে দিতে বললাম, তোমার কি এরকম ধারনা?
‘অবশ্যই না। বাদল আপনাকে এবং আপনাদের আল্লাহকে অগাধ বিশ্বাস করে । তাই আপনাকে দেখে সে রিল্যাক্সড বোধ করেছে। সহজ হয়েছে। ভয়ে আতংকে তার গলার মাংসপেশি শক্ত হয়ে গিয়েছিল, সেই ভাবও দুর হয়েছে। তারপর আপনি তাকে ভাত খাওয়ালেন সহজেই কাঁটা বের হয়ে এলো । আমি কি ভুল বলছি।
‘ না আমার ক্ষমতা সম্পর্কে ভুল বল নি। তবে আল্লাহর সম্পর্কে তোমার ধারনা খুবই ভুল।
আল্লাহর ব্যপার নিয়ে আমি আপনার সাথে এখন কথা বলতে চাচ্ছি না। আপনার ব্যপারটাই বলতে চাই । আপনি নিতান্তই লৌকিক একটা ব্যপার করে সেটাকে অলৌকিক ফ্লেবার দিয়ে ফেলেছেন এটা কি ঠিক হচ্ছে ?
আমি কোন ফ্লেবার দেই নি ইরাম। এটা তুমি কল্পনা করছ।
আপনি না দিলেও অন্যরা দিচ্ছে , বাদল দিচ্ছে। আপনার ফুপা ফুপু দিচ্ছেন।
তাই নাকি।
ইরাম কঠিন গলায় বলল, আমাদের সমাজে কিছু কিছু প্রতারক আছে , যারা হাত দেখে গ্রহ নক্ষত্র বিচার করে পাথর দেয়, মন্ত্র তন্ত্র পড়ে। আপনি কি তাদের চেয়ে আলাদা? আপনি আলাদা না , আপনি তাদের মতই একজন।
হতে পারে। কিন্তু তুমি আমাদের ওপর আল্লাহর করুণাকে ভুলভাবে দেখছো। আর বাই দ্যা ওয়ে আমার ওপর এতো রেগে আছো কেনো তুমি?
আপনি যে শুরু থেকেই আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন সেটাও আমার খারাপ লাগছে। আমি তো স্কুলে পড়া বাচ্চা ছেলে না । আপনি আমাকে চেনেনও না। প্রথম দেখাতেই আপনি আমাকে তুমি বলবেন কেন?
ভুল হয়েছে । তবে একবার যখন বলে ফেলেছি সেটাই বহাল রাখি । মানুষ আপনি থেকে তুমিতে যায়। তুমি থেকে আপনিতে যায় না। নিয়ম ভাঙ্গা কি ঠিক হবে ?
আমার বেলায় নিয়মটা ভাঙলেই আমি খুশি হবো।
এখন থেকে আপনি করে বলবো।
ধন্যবাদ। আরেকটা কাজ কি দয়া করে করবেন ?
অবশ্যই করবো । বলুন।
বাদলকে ডেকে একটু কি বুঝিয়ে বলবেন তার গলারকাঁটাটা কি ভাবে গেলো ? ওর মন থেকে অধি ভৌতিক ব্যপারগুলি দুর করা দরকার। আপনি বুঝিয়ে বলে দিন। আমার বলায় সে কনভিন্সড হবে না ।।
ডেকে নিয়ে আসুন যা সত্য আমি তাই বলে দেবো। ইন শা আল্লাহ ।
ইরাম বাদলকে নিয়ে ঢুকলো। আমি বললাম বাদল তুই স্থির হয়ে আমার সামণের চেয়ারটায় বোস। ইরাম, আপনিও বসুন। তবে আপনাকে স্থির হয়ে না বসলেও চলবে। আপনি ইচ্ছা করলে নাড়াচাড়া করতে পারেন।
ইরাম তাকাচ্ছে তীব্র চোখে। আমি তার সেই চোখ সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে বাদলের দিকে তাকিয়ে বললাম, বাদল শোন, তুই যদি ভেবে থাকিস আমি আমার মহান ক্ষমতা বলে তোর গলার কাঁটা গলিয়ে ফেলেছি , তাহলে তুই বোকার স্বর্গে বাস করছিস। তোর এই কাঁটা যাওয়ার ব্যপারে আমার কোনই ক্রেডিট ণেই । সব আল্লাহর ইচ্ছা বুঝলি । আল্লাহ তার করুণা দিয়ে তোকে সাহায্য করেছেন। বল আলহামদুলিল্লাহ …
বাদল সঙ্গে সঙ্গে বলল আলহামদুলিল্লাহ
আর শোণ তোর কাঁটা যাওয়ার দুনিয়াবি যে লজিকাল এক্সপ্লেনেশনটা আছে সেটা ইরাম খুব সুন্দর করে ব্যখ্যা করে তোকে বুঝিয়ে দেবেণ। তুই তার কাছ থেকে ব্যপারটা পুরো পুরি জেনে নিস। ব্যাখ্যা শুনে তারপর ঘুমুতে যাবি। তার আগে না । মনে থাকবে?
থাকবে।
যা ভাগ।
বাদল হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়েছে। ইরাম এখনো তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে। মপ্নে হচ্ছে সে খুব অপমানিত বোধ করছে। ছেলেটাকে খেয়াল করে দেখলাম । সুদর্শন ছেলে। এরকম একটা ছেলে ফিজিক্স পড়ছে দেখে ভালো লাগলো আজকাল তো বিবি এ এমবিয়ে নিয়েই ছেলেরা পরে থাকে।
আমি চাদর মুরি দিয়ে শুয়ে পরলাম, ফোম বিছানো গদি– আরামের বিছানা। এতো আরামের বিছানায় কি ঘুম আসবে? তবু একটু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে হবে । ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত। ফজর পড়তে হবে ঘুম থেকে উঠে । ফ্রেশ হয়ে।
হিমু জেগে আছিস?
ফুপার জড়ানো গলা। ইতিমধ্যে তিনি সিদ্ধির টানে বেশ উপড়ে উঠে গেছেন। উঁচু তারে নিজেকে বেধে ফেলেছেন বলে মনে হচ্ছে। ফুপাকে ঘরে ঢোকানো এখন বিপদ জনক হবে। তিনি উঁচু থেকে আরও উঁচুতে চড়তে থাকবেন তারপর হঠাত করে নিচে নামবেন । বমি করে ঘর ভাসাবেন। সিদ্ধি খেয়ে খুব কম মানুষ বমি করে । ঐ অল্প সংখ্যক মানুষগুলোর একজন আমার এই ফুপা।
হিমু হিমু।
জ্বি।
তোর সঙ্গে কিছু গল্প গুজব করা যাক — ম্যান টু ম্যান টক। তুই আজ ভারি ভেল্কি দেখালি। দরজা খোল । হিমু হিমু।
গঞ্জিকার নেশা অনেক বেশি চড়ে গেছে মনে হচ্ছে। দরজা না খুলে নিস্তার পাওয়া যাবে না। ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকবে। কাজেই দরজা খুল্লাম। বড় ফুপার হাঁতে সিগারেট জ্বলছে। তবে তার গন্ধ বলে দিচ্ছে তামাকের বদলে সেটায় রয়েছে অন্য কিছু। তিনি সেই জিনিস হাঁতে নিয়েই ঢুকে পরলেন।
‘তোর ফুপু ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব টেনশোন গেছে তো , এখন আরামে ঘুমুচ্ছে। আমি ভাবলাম ‘কণ্টক মুক্তি’ টা পীর বাবার নামে একটু সেলিব্রেট করা যাক। কণ্টক মুক্তি শব্দটা কেমন লাগছে ?
ভাল লাগছে।
কণ্টক মুক্তির ইংরেজী কি হবে? Freedom from Thorn?
ফুপা আপনি দ্রুত টানছেন। আমার মনে হয় এখন উচিত শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া।
তোর সঙ্গে গল্প করতে এসেছি। গল্প করতে ভালো লাগছে। আমার ধারনা তোর উপর ইন জাস্টিস করা হয়েছে। তোকে যে আমি বা তোর ফুপু দেখতে পারি না এটা অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়। তোর অপরাধ কি? আমি পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ভেবেছি।
তোর নেগেটিভ দিক গুলো কি–
এক, তোর চাকরি বাকরি ণেই। এটা কোন ব্যপার না পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ লোক আছে যাদের চাকরি ণেই ।
দুই, তুই পথে পথে ঘুরিস। মাঝে মাঝে তাবলীগে যাস আবার আহলে হাদিস মাসজিদেও তোকে দেখা যায়। বিভিন্ন হালাকাও তুই এটেইন করিস। ওয়াহাবি দেওবন্দি আলেমরাও নাকি তোকে পছন্দ করে। মিলাদ পীর ফকির দের রিজেক্ট করিস। কেমন জেনো টেররিসট টেরিরিস্ট মনে হয় তোকে।
আর খাবেন না ফুপা।
কথার মাঝেখানে কথা বলিস না হিমু। আমি কি যেন বলছিলাম?
টেররিস্ট সম্পর্কে কি যেন বলছিলেন।
কোন টেররিস্ট ? জর্জ বুশ? জর্জ বুশের কথা খামাখা বলবো কেনো?
আর না টানলে হয়না ফুপা?
হয়। হবে না কেন? তবে আনন্দ পরিপূর্ন হয় না। জর্জ বুশের কথা কি বলছিলাম ?
আমার ঠিক মনে পরছে না ফুপা।
শোন হিমু, তুই খারাপ না। এবং তোর ক্ষমতা আছে । বাদল যে তোর নাম বলতে অজ্ঞান হয়ে যায়, বাদলের কোন দোষ ণেই । I Like you himu.
‘থ্যাংক ইউ ফুপা । তবে আমার কোনই ক্ষমতা ণেই । সব ক্ষমতা আল্লাহর । সব তিনিই করেন।
তোর একটাই অপরাধ তুই সবকিছুর মধ্যে ইসলামকে টেনে নিয়ে আসিস। ধর্মকে সব জায়গায় টেনে আনার কি দরকার। অবশ্য টেররিস্ট জর্জ বুশও তো ইসলামকে জোড় করে সব জায়গায় টেনে আনতো। আচ্ছা আমি এতক্ষণ ধরে জর্জ বুশকে টেরোরিস্ট কেনো বলছি কিছুই বুঝতে পারছি না।
ফুপা চোখ মুখ উল্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপর হড় হড় শব্দ হতে লাগলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার কিছু করার ণেই। ফুপা বিছানাতে বসেছিলেন বিছানা এবং আমার শরীরের এক অংশ তিনি বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছেন। এখন গা এলিয়ে দিয়ে বিড় বিড় করে কোন এক হিন্দি কাওয়ালি গাইছেন।
(চলবে ইন শা আল্লাহ)
রচনায় : আলী আবদুল্লাহ