
সূফীবাদ বনাম ইসলাম
সূফীবাদ বনাম ইসলাম
সম্মানিত মুসলিম ভাই বোনেরা! এ প্রবন্ধে আমরা প্রচলিত সূফীবাদ তথা পীর-মুরীদী নিয়ে আলোচনা করব কারণ আমাদের আলোচ্য বইয়ের লেখক ও তাবলীগী জামা’আতের প্রতিষ্ঠাতা উভয়েই পীর ও সূফী ছিলেন। যারা কারণে আমরা দেখতে পাই তাবলীগী নিসাবে সূফীবাদের অনেক আলোচনা আছে। যা দেখলে মনে হয় তাবলীগওয়ালারা দ্বীন ইসলামের দা’ওয়াতের নামে প্রকান্তরে সূফীবাদের দিকেই আহ্বান করেছে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ হল জাম’আতের প্রতিষ্ঠাতা জনাব ইলিয়াস নিজে সূফী ছিলেন। তার পীর ছিলেন বিখ্যাত সূফী দেওবন্দী হানাফী আলিম রশীদ আহমাদ গাঙ্গোহী (মৃত ১৩১৩ হিঃ, ৮ জমাদিউস সানী) –(তারীখে মাশারিখে চিশ্ত ২৮৫ পৃষ্ঠা)।
তার পীর ও মুর্শিদ ছিলেন ভারতবর্ষের পীরদের অন্যতম হাজী ইমদাদুল্লাহ মহাজির মাক্কী তার তাবলীগী নিসাবের লেখক শায়খ যাকারিয়াও ঐ একই খান্দানী পীর ও সূফী। তার লিখিত ফাজায়েলে আমাল বা তাবলীগী নিসাব গ্রন্থ অধ্যয়ন করলে আপনারা বাসরী,বায়েজিদ বোস্তামী, রাবেয়া বসরী, জুনায়েদ বাগদাদী গাযালী, ইত্যাদি সূফীদের কথা। এ সকল সূফী কারা এদের আক্বীদাহ বিশ্বাস কী ছিল এবং সূফীবাদ ইসলামে গ্রহনযোগ্য কিনা আমরা এখন কুরাআন-সহীহ হাদীসের মানদন্ডে যাচাই করে দেখব।
এ মর্মে আল্লাহ সুবাহানহু তা’আলা পবিএ কুরআনে পরিষ্কারভাবে সূরা হাদীদ-এর ২৭নং আয়াতে ঘোষনা করেনঃ
‘’আর বৈরাগ্য তারা নিজেরা প্রবর্তন করে নিল, আমি তাদের উপর তা (বৈরাগ্য) বিধিবদ্ধ করিনি, যদিও তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য (নিজেদের ইচ্ছাঅনু্যায়ী) এ অবস্থা অবলম্বন করেছিল কিন্তু তারা যথোপযুক্তভাবে এর সংরক্ষণ করেনি। (সূরা আল-হাদীদ ২৭)
যে ইবাদত বা যিক্র আল্লাহ ও তাঁর রসূল দেননি সে ইবাদত বা আমাল পরিত্যাজ। সংসারত্যাগী হয়ে, নাফ্সের উপর চরমভাবে সংযম চালিয়ে নিজেদেরকে শুদ্ধ করতে চেষ্টা কর সুন্নাতের পরিপন্থী। এ সম্পর্কে সহীগুল বুখারী এসেছেঃ
আনাস ইবনু মালিক (রাযি.) বর্ণনা করেন , তিন ব্যক্তির একটি দল, রসূলুল্লাহ (স.) এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য আগমন করল। তাদেরকে এ সম্পর্কে অবগত করানো হলো। নবী (স.) এর ইবাদতের পরিমাণ কম মনে করে তারা বললঃ আমরা নবী (স.) এর ইবাদতের পরিমাণ কম মনে করে তারা বললঃ আমরা নাবীর সমকক্ষ হই কি করে যার আগের ও পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।
এ সময় তাদের মধ্য থেকে একজন বললঃ আমি বিরতহীনভাবে সারা বছর সিয়াম পালন করব। অন্য জন বললঃ আজীবন সারা রাত সালত পড়তে থাকব। তৃতীয় ব্যক্তি বললঃ আমি ইবাদতের জন্য সর্বদা নারী বিবর্জিত থাকব এবং কখনও বিবাহ করব না। (এ কথা শুনে) নাবী (স.) তাদের কাছে আসলেন এবং বললেনঃ তোমরা কি সেই লোক যারা এরূপ কথাবর্তা বলেছ ? আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহর প্রতি তোমাদের চেয়ে বেশী অনুগত এবং তাকে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি। অথচ তা সত্ত্বেও আমি সিয়াম পালন করি আবার বিরতিও দেই। রাতে নিদ্রাও যাই, সলাতও পড়ি। আর বিবাহও করি। সুতরাং যারা আমার সুন্নাতের প্রতি বিরাগ পোষন করবে তারা আমার উম্মাতের মধ্যে অর্ন্তভুক্ত নয়।
(সহীহ বুখারী হাঃ নং ৪৬৯০ আ.প্র.)।
উপরোক্ত কুরআনের বাণী ও রসূলুল্লাহ (স.) এর সহীহ হাদীস মোতাবেক এটাই পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয় যে, সংসার ত্যাগ করে, দেহের উপর চরম কষ্ট দিয়ে সূফী সেজে বা বৈরাগ্য জীবন যাপন ইসলাম পরিপন্থী অ সুন্নাত বিরোধী পদ্ধতি যা কখনও কল্যানকর নয়। সুফী মতবাদ বা সূফী দর্শন তাসাউফপন্থী তাপস বা সাধকদের তৈরি অর্থাৎ মানুষের তৈরী।
সুফীদের বিশ্বাস আল্লাহ তাদের অন্তরে, শুধু তাদের নয় সমস্ত জগতে যত প্রান আছে সেই প্রাণে পরম সত্তা বা পরমত্মা অর্থাৎ আল্লাহ বিরাজমান। সমস্ত প্রাণ আত্নার মধ্যে আল্লাহ লীন হয়ে আছেন – তারা সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত স্বীকার করে – নাউযুবিল্লাহ।
অথচ কুরআন বলে আল্লাহ আরশে (সূরা আস-সাজদাহ ৩২/৮) অবস্থান করেছেন। সুতরাং সূফীদের ধ্যান-ধারণা ইসলামের পরিপন্থী।
সূফীদের আক্বীদা (বিশ্বাস) হলো ‘ফানাফিল্লাহ’ আল্লাহর সত্তায় বিলীন হয়ে যাওয়াই তাদের সাধনার প্রধান লক্ষ্য এবং এটাই তাদের জান্নাত।
সূফীদের ধর্মীয় সাধক আত্তারের ভিতর দিয়ে তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইরানে সূচিত হয়েছিল এক নব চেতনা-উদ্বেলিত সূফীবাদের প্রবল প্রসার। সূফী সাধক আত্তার বলতেন, আমি কাশফের বলে দুনিয়ার সব কিছু দেখতে পাই, অদৃশ্যের পর্দা উঠিয়ে ফেলি, দূরকে আমি আনি চোখের সম্মুখে।
তিনি আরও বলতেন – কি-ই বা প্রয়োজন হাজার মাইলের ব্যবধানে কায়িম শ্রমে মক্কায় গিয়ে কা’বার চতুর্দিকে শারী’আতের আচার অনুযায়ী সাত চক্কর দিয়ে এতে কতটুকুই বা পাবে! যা পাবে তা তো খুবই নগণ্য। কেননা তুমি কা’বাকে (সাধনার বলে) উঠিয়ে এনে হৃদয়ের পবিএ স্হানে বসিয়ে দিন-রাত তাওয়াফ করে অশেষ পুণ্যের অধিকারি হও।
ইরানের বিস্ত্বম শহরে আবূ ইয়াজিদ বিস্তামী (মৃত্যু ২৬১ হিঃ) ওরফে বায়েজীদ বোস্তামী ঐ মবাদের একজন খ্যাতনামা সূফী সাধক ছিলেন। ‘’আল-ফিকরূ সূফী’’ কিতাবের ৬৫ পৃঃ এবং ইসলামী বিশবকোষের ২য় খন্ড ১৪৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে ইরানের কুমিস প্রদেশের বুস্তাম শহরে তার জম্ম এবং সেখানেই তার মৃত্যু। ইলখানী সুলতান মুহাম্মাদ খদাবন্দ ১৩১৩ খৃস্টাব্দে তার কবরের উপরে একটি গম্বুজ বা কুবা তৈরি করেন, যা আজও আছে। (কথিত আছে, বায়েজীদ বুস্তামী একবার পূর্ব ভারত পর্যন্ত সফরে গিয়েছিলেন) তাহলে চট্টগ্রামের বায়েজীদ বুস্তামীর মাজার নামে যে পীর পূজারীদের টাকা- পয়সা আয়ের গাদীটি কি ভন্ডামীর আস্তানা নয় ? সে যা-ই হোক, বায়েজীদ বুস্তামী বলতেনঃ প্রেমিক অ প্রেমাস্পদ একই সত্তা উভয়ের অস্তিত্বে কোন পার্থক্য নেই।
- তিনি বলেন, ‘’ মহা পবিএ আমি, মহা পবিএ আমি, আমার কতই না বড় মর্যাদা।‘’
- তিনি তার আস্তানায় সাধনায় মশগূল থাকতে কেউ যদি তার দরজায় খটখট (knock) করতো তিনি ভেতর থেকে উত্তর দিতেন
‘’আল্লাহ ছাড়া বাড়ীতে কেউ নেই।‘’
- ‘’ষাট বছর ধরে আমি আল্লাহকে খুঁজছি, এখন দেখছি আমিই তিনি।‘’ অর্থাৎ আমি সেই আল্লাহ। [(আন-নকশাবন্দীয়াহ ৭৫-৭৭ পৃষ্ঠা)]
এ সূফী মতবাদের আর একজন অন্যতম সাধক ছিলেন হুসাইন বিন মানসুর হাল্লাজ [(মৃত্যু ৩০৯ হিঃ)]। যিনি নিজেকে সরাসরি আল্লাহ বলে দাবী করায় মুরতাদ হওয়ার কারণে তাকে শুলে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়।[(মাদখালী, হাক্বীক্বাতুস সূফীয়াহ ২৯ পৃঃ)]।
তিনি যিক্র করে বিভোর হয়ে আল্লাহতে বিলীন হয়েছেন বিলীন হয়েছেন বিশ্বাসে, আল্লাহ ও নিজের সম্পর্কে তিনি বলতেনঃ ‘’আমার
দু’টি রূহ একটি দেহে লীন হয়েছি।‘’ এজন্যই তিনি নিজে বলতেনঃ ‘’ আমি সত্য’’ অর্থাৎ ‘’আমি আল্লাহ’’।
তিনি আরও বলতেন, আমার মধ্য হতে আল্লাহই কথা বলেন, আমি তো আল্লাহতেই বিলীন হয়ে আছি।
[(আন-নকশাবন্দীয়াহ ৬৪, ৭৪-৭৫ পৃষ্ঠা)]।
এমনি আর একজন সূফী সাধক হলেন বলখের ইবরাহীম আদহাম তিনি তার এক ভক্তকে সূফীতত্ত্ব শিক্ষা দিতে উদাহারণ দিয়ে বুঝালেন, এক কলসী পানির মধ্যে এক মুঠো লবণ ছেড়ে দিলে লবণ যেমন পানির সাথে মিশে বিলীন হয়ে যায়, তদ্রূপ যিক্র করে আল্লাহকে নিজের ক্ব্লবের মধ্যে লীন করে ফেলতে হবে।
মাওঃ যাকারিয়া হল মাওঃ ইলিয়াসের কন্যার জামাতা ও ফাজায়েলে আমা’ল, সাদাকাত,দরূদ ও ফাজায়েলে হজ্জ পুস্তকের প্রণেতা। তিনি সুফীবাদ সম্পর্কে অত্যন্ত সুবিদিত এবং মাওঃ খলিল আহ্মাদ শাহ্রানপুরী হতে চার ত্বরিকাহ্র উপরই খিলাফাত প্রাপ্ত। (মাশায়েখ-ই-চিশত পৃঃ ৩০৪-৩০৭ )।
তাবলীগের মুরুব্বী – মাওঃ যাকারিয়া স্বীয় পীর রশীদ আহ্মাদ গাংগুহীর একটি পত্র ফাজায়েলে সাদাকাত নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন। সে পত্রে মাওলানা গাংগুহী স্বীয় পীর এমদাদ উল্লাহ মক্কীকে সম্বোধন করেছেন ‘হে আমার দুই জাহানের আশ্রয়স্হলে।
হে আল্লাহ! সব তোমারেই ছায়া, তোমারই অস্তিত্ব , আমি কি , কিছুই নই এবং আমি যাহা রহিয়াছি উহাও তুমি। আমি এবং তুমি স্বয়ং শিরকের ভিতের শিরক। (ফাজায়েলে সাদাকাতের ২য় খণ্ড, ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদ , পৃষ্টা নং – ২২১-২২২)।
সুফী মতবাদ অনুযায়ী আল্লাহ সূফীদের অন্তরেই বিরাজমান,সমস্ত প্রানী আত্মার মধ্যেই আল্লাহ বর্তমান, সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টার অস্তিত্ব যদি স্বীকার করা হয়, তাহলে হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ বেদান্তের বাণী – যত জীবঃ তত শিবঃ অর্থাৎ যেখানেই জীব আছে (প্রাণ) আছে সেখানেই শিব (ভগবান) আছে। উপনিষদ গ্রন্থে আছেঃ নরঃ নারায়ন অর্থাৎ নরই নারায়ণ মানে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে নারায়ণ বা ভগবান মূর্ত হয়ে আছেন।
তাহলে সূফী মতবাদ এবং উপনিষদ বৈদান্তিক হিন্দুমত কি একই বলে বিবেচিত হয় না ?? সূফী মতবাদ আর হিন্দু বৈদান্তিক দর্শনে মূলতঃ কোন পার্থক্যই নেই।
এছাড়াও ঐসব সূফী ছিন্তাচেতনা ইসলাম পরিপন্থী, এটা ইসলাম সমর্থন করে না। যা আল্লাহ ও রসূল পরিপন্থি তা ইসলামে হারাম। আল্লাহ যেন আমদের ঐসব ইসলাম পরিপন্থী – সূফী ও পীরদের বাতিল বিশ্বাস,কথা,কাজ,দল,মত,পথ ইত্যাদি থেকে হিফাজত করেন। আমিন।