
রাসূল (সা)-এর নাতনী উমামা বিনত আবিল ‘আস (রা)
রাসূল (সা)-এর নাতনী উমামা বিনত আবিল ‘আস (রা)
লেখক: ড. মুহাম্মদ আব্দুল মা‘বুদ
অনুলিখন: মাকসুদ বিন আমাল
হযরত উমামার বড় পরিচয় তিনি হযরত রাসূলে কারীমের (সা) দৌহিত্রী । তার পিতা আবিল ‘আস (রা) ইবনে রাবী এবং মাতা যায়নাব (রা) বিনত রাসূলিল্লাহ (সা) । উমামা তার নানার জীবদ্দশায় মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তার জন্মের অনেক আগেই তাঁর নানী উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা) ইন্তেকাল করেন। উমামার দাদী ছিলেন হযরত খাদীজার ছোট বোন হালা বিনত খুওয়ায়লিদ । হিজরী ৮ম সনে উমামার মা এবং দ্বাদশ সনে পিতা ইন্তেকাল করেন।১
নানা হযরত রাসূলে কারীম (সা) শিশু উমামাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। সব সময় তাকে সংগে সংগে রাখতেন। এমনকি নামাযের সময়ও কাছে রাখতেন। মাঝে মাঝে এমনও হতো যে, রাসূল (সা) তাকে কাঁধের উপর বসিয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। রুকূ’তে যাওয়ার সময় কাঁধ থেকে নামিয়ে দিতেন। তারপর সিজদায় গিয়ে তাকে মাথার উপর বসাতেন এবং সিজদা থেকে উঠার সময় কাঁধের উপর নিয়ে আসতেন। এভাবে তিনি নামায শেষ করতেন। এ আচারণ দ্বারা উমামার প্রতি তাঁর স্নেহের আধিক্য কিছুটা অনুমান করা যায়।
রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবী হযরত আবু কাতাদা (রা) বলেন, একদিন বিলাল আযান দেওয়ার পর আমরা জুহর, মতান্তরে আসরের নামাযের জন্য অপেক্ষায় আছি , এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সা) উমামা বিনত আবিল ‘আসকে কাঁধে বসিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হলেন । রাসূল (সা) নামাযে দাঁড়ালেন এবং আমরাও তাঁর পিছনে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলাম। আর উমামা তখনও তাঁর নানার কাঁধে একইভাবে বসা।
রাসূল (সা) রুকূ’তে যাবার সময় তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখেন। তারপর রুকূ’-সিজদা শেষ করে আবার যখন উঠে দাঁড়ান তখন আবার তাঁকে ধরে কাঁধের উপর উঠিয়ে নেন। প্রত্যেক রাক’আতে এমনটি করে তিনি নামায শেষ করেন।২
উম্মুল মু’মিনীন হযরত ‘আইশা (রা) বর্ণনা করেছেন। হাবশার সম্রাট নাজ্জাশী রাসূলুল্লাহকে (সা) কিছু স্বর্ণের অলঙ্কার উপহার হিসেবে পাঠান, যার মধ্যে একটি স্বর্ণের আংটিও ছিল। রাসূল (সা) সেটি উমামাকে দেন।৩
উমামার প্রতি রাসূলুল্লাহর (সা) স্নেহের প্রবলতা আরেকটি ঘটনার দ্বারাও অনুমান করা যায়। একবার রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট মুক্তা বসানো স্বর্ণের একটি হার আসে। হারটি হাতে করে ঘরে এসে বেগমদের দেখিয়ে বলেনঃ দেখ তো, এটি কেমন? তাঁরা সবাই বলেনঃ অতি চমৎকার! এর চেয়ে সুন্দর হার আমরা এর আগে কখনো দেখি নি। রাসূল (সা) বললেনঃ এটি আমি আমার পরিবারের মধ্যে যে আমার সবচেয়ে বেশী প্রিয় তাঁর গলায় পরিয়ে দেব। ‘আইশা (রা) মনে মনে ভাবলেন, না জানি তিনি এটা আমাকে না দিয়ে অন্য কোন বেগমের গলায় পরিয়ে দেন কিনা। অন্য বেগমগণও ধারণা করলেন, এটা হয়তো ‘আইশার (রা) ভাগ্যেই জুটবে। এদিকে বালিকা উমামা তাঁর নানা ও নানীদের অদূরেই মাটিতে খেলছিল। রাসূল (সা) তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁর গলায় হারটি পরিয়ে দেন।৪ হযরত উমামার (রা) পিতা আবিল ‘আস ইবনে রাবী (রা) হিজরী ১২ সনে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর মামাতো ভাই যুবাইর ইবনে আল-‘আওয়ামের সাথে উমামার বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছার কথা বলে যান। এদিকে উমামার খালা হযরত ফাতিমাও (রা) ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি স্বামী ‘আলীকে বলে যান, তাঁর পড়ে তিনি যেন উমামাকে বিয়ে করেন। অতঃপর উমামার (রা) বিয়ের বয়স হলো। যুবাইর ইবনে আল-‘আওয়াম (রা) হযরত ফাতিমার (রা) অন্তিম ইচ্ছা পূরণের জন্য উদ্যোগ হলেন। তাঁরই মধ্যস্থতায় ‘আলীর (রা) সাথে উমামার (রা) বিয়ে সম্পন্ন হলো। তখন আমীরুল মু’মিনীন ‘উমারের (রা) খিলাফতকাল।
হিজরী ৪০ সন পরর্যন্ত তিনি ‘আলীর (রা) সাথে বৈবাহিক জীবন যাপন করেন। এর মধ্যে ‘আলীর (রা) জীবনের উপর দিয়ে নানা রকম ঝড়-ঝঞা বয়ে যায়। অবশেষে হিজরী ৪০ সনে তিনি আততায়ীর হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। এই আঘাতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি স্ত্রী উমামাকে বলেন, আমার পরে যদি তুমি কোন পুরুষের প্রয়োজন বোধ কর, তাহলে আল-মুগীরা ইবন নাওফালকে বিয়ে করতে পার। তিনি আল-মুগীরাকেও বলে যান, তাঁর মৃত্যুর পরে তিনি যেন উমামাকে বিয়ে করেন। তিনি আশংকা করেন, তাঁর মৃত্যুর পরে মু’আবিয়া (রা) উমামাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন। তাঁর এ আশংকা সত্যে পরিণত হয়। তিনি ইন্তেকাল করলেন। উমামা ‘ইদ্দত তথা অপেক্ষার নির্ধারিত সময় সীমা অতিবাহিত করলেন। হযরত মু’আবিয়া (রা) মোটেই দেরী করলেন না। তিনি মারওয়ানকে লিখলেন, তুমি আমার পক্ষ থেকে উমামার নিকট বিয়ের পয়গাম পাঠাও এবং এ উপলক্ষে এক হাজার দীনার ব্যয় কর। এ খবর উমামার (রা) কানে গেল। তিনি সাথে সাথে আল-মুগীরাকে লোক মারফত বললেন,
যদি আপনি আমাকে পেতে চান, দ্রুত চলে আসুন। তিনি উপস্থিত হলেন এবং হযরত হাসান ইবন ‘আলীর (রা) মধ্যস্থতায় বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়।৫
এই আল-মুগীরার স্ত্রী থাকা অবস্থায় মু’আবিয়ার (রা) খিলাফতকালে তিনি ইন্তেকাল করেন। ‘আলীর (রা) ঘরে উমামার কোন সন্তান হয় নি। তবে আল-মুগীরার ঘরে তিনি এক ছেলের মা হন এবং তাঁর নাম রাখেন ইয়াহইয়া।৬ তবে অনেকে বলেছেন, আল- মুগীরার ঘরেও তিনি কোন সন্তানের মা হননি। তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহর (সা) কন্যাদের মধ্যে একমাত্র ফাতিমা (রা) ছাড়া আর কারো বংশধারা অব্যাহত নেই। হতে পারে আল-মুগীরার ঔরসে ইয়াহইয়া নামের এক সন্তানের জন্ম দেন, কিন্তু শিশুকালেই তাঁর মৃত্যু হয়। উমামার মৃত্যুর মাধ্যমে নবী দুহিতা যায়নাবের (রা) বংশধারার সমাপ্তি ঘটে। কারণ তাঁর পূর্বেই যায়নাবের পুত্রসন্তান আলীর মৃত্যু হয়।৭
তথ্যসূত্র:
১. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়াতিন নুবুওয়াহ্-৫৩৬-৫৩৭
২. সুনানু নাসাঈ- ২/৪৫, ৩/১০; তাবাকাত- ৮/২৩২; আল ইসাবা- ৪/২৩৬; হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৮২
৩. নিসা’ মিন ‘ আসর আন-নুবুওয়াহ্-২৮৯
৪. আল-ইসতী‘আব–৪/২৩৮; উসুদুল গাবা-৫/৪০০;আস-সীরাহ্ আল-হালাবিয়্যাহ্-২/৪৫২; দুররুস সাহাবা ফী মানাকিব আল-কারাবাহ্ ওয়াস সাহাবা-৫৩৫; আ‘লাম আন-নিসা’-১/৭৭
৫. আল-ইসাবা-৪/২৩৭
৬. প্রাগুক্ত; উসুদুল গাবা – ৫/৪০০; আ‘লাম আন-নিসা’ ১/৭৭
৭. তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়াতিন নুবুওয়াহ্-৫৩৮; নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্-২৮০
উত্স: মাসিক পৃথিবী।