
ইসলামের সোনালী যুগের কয়েকটি উদাহরণ
ইসলামের সোনালী যুগ যে কত বরকতময় ও সুখশান্তিময় ছিলো তার কিছু উদাহরণ এই গল্পগুলোর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়া মুসলিম উম্মাহর ইমামগণের প্রজ্ঞা ও তাদের সুকৌশল ও বিভ্রান্তপন্থীদের মোকাবেলায় তাদের অবস্থানও সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
লেখাটি সোনালি পাতা থেকে সংকলন করেছেন : মাকসুদ বিন আমাল
সম্পাদনায়: সম্পাদনা পরিষদ
তাঁরা বলাবলি করতে ছিল যে, মনে হয় সে শয়তান না হলে আমাদের সামনেই সে এই খোলা মাঠে ছিল অথচ এখন তাকে দেখছি না। মূলতঃ আল্লাহ তাদেরকে কিছু সময়ের জন্য অন্ধ করে দিয়েছিল। তারা আমার সামনে দিয়েই গেল আবার ফিরেও আসল, আর জায়গাটিও ছিল খোলা জায়গা সেখানে আড়াল হওয়ার মতও কোন কিছু ছিল না।
আসলে আল্লাহ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, তাই স্বীয় ফজল ও করমে আমাকে বাঁচালেন, আর সত্য কথা তাই রাখে আল্লাহ মারে কে?
খারেজীঃ আবু হানিফা! আমরা আপনাকে দুইটি প্রশ্ন করব, যদি আপনি সঠিক উত্তর দিতে পারেন তাহলে ঠিকই আছে। অন্যথায় আমরা আপনাকে কতল করে ফেলব।
ইমাম আবু হানিফাঃ তোমাদের তলোয়ার কোষবদ্ধ কর, কেননা ঐ দিকে চোখ পড়লে আমি ঐ ব্যাপারেই ব্যস্ত থাকব।
খারেজীঃ আমরা আমাদের তলোয়ার কখনো কোষবদ্ধ করব না। এটাতো আপনার রক্ত পিপাষু।
ইমাম আবু হানিফাঃ ঠিক আছেঃ জিজ্ঞেস কর।
খারেজীঃ দরজায় দুইটি জানাযা রাখা হয়েছে, তাঁর মধ্যে একটি হল ঐ ব্যক্তির যে মদ পান করে চোখ বন্ধ করেছে এবং মাতাল অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছে। দ্বিতীয়টি ঐ মহিলার যে, ব্যভীচারের মাধ্যমে গর্ভধারণ করেছে এবং ঐ অবস্থায় তাওবা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করেছে। এরা দু’জন মোমেন না কাফের?
খারেজীদের এ গ্রুপ যারা ইমাম আবু হানিফার নিকট প্রশ্ন করতে এসেছে, তাদের বিশ্বাস মোতাবেক কবীরা গোনাহগার কাফের, এমতাবস্থায় ইমাম আবু হানিফা যদি তাদেরকে মোমেন বা মুসলমান বলে ফতোয়া দিতেন তাহলে তাদের দৃষ্টিতে তিনি হত্যার উপযুক্ত হয়ে যেতেন। তাই ইমাম সাহেব তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ বল তারা কি কোন মাযহাব মানত না ইয়াহুদী ছিল?
খারেজীঃ না।
ইমাম আবু হানিফাঃ তারা কি নাসারা (খ্রিস্টান) ছিল?
খারেজীঃ না।
ইমাম আবু হানিফাঃ তাহলে অগ্নিপূজক?
খারেজীঃ না।
ইমাম আবু হানিফাঃ মূর্তিপূজক?
খারেজীঃ না।
ইমাম আবু হানিফাঃ তাহলে কোন মাযহাবের অনুসারী ছিল?
খারেজীঃ মুসলমান ছিল।
ইমাম আবু হানিফাঃ তোমরাই বলছ যে তারা মদখোর ও ব্যভিচারী, মুসলমান ছিল, তাহলে যে মুসলমান তাকে তোমরা কিভাবে কাফের বলবে?
খারেজীদের গ্রুপঃ তারা কি জান্নাতী না জাহান্নামী?
ইমাম আবু হানিফাঃ আমি তাদের ব্যাপারে ঐ কথাই বলব যা আল্লাহর খলীল ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে বলেছিলেন যে, এদের চেয়েও বড় গোনাহগার ছিলঃ
“যে আমার অনুসরণ করবে, সে আমার দলভুক্ত। আর কেউ যদি আমার অবাধ্য হয় তাহলে আপনি তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।” (সূরা ইব্রাহিমঃ ৩৬)
সাথে সাথে আমি ঐ কথাও বলব যা বলেছিল রুহুল্লাহ ঈসা (আলাইহিস সালাম) এদের চেয়ে বড় গোনাহগারের ব্যাপারেঃ
“তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি প্রদান কর, তবে ওরা তো তোমার বান্দা আর যদি তাদেরকে ক্ষমা কর তবে তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা মায়েদাহঃ ১১৮)
একথা শুনে খারেজীরা তাদের তরবারী কোষবদ্ধ করে ফিরে চলে গেল এবং তারা ইমাম সাহেবের কোন ক্ষতি করল না।
সূত্রঃ সোনালী পাতা, পৃষ্ঠা ২৭০-২৭১।
ঘটনাক্রমে ঐ রাতে তার বন্ধুর পাশের এলাকা থেকে কোন জরুরী কাজে তাকে ডাকা হল , সে বলল যে, তুমি আমার জন্য অপেক্ষা কর, আমি একটু পরেই ঘুরে আসছি।
এ মুহূর্তে ঘরের মধ্যে ঐ সুন্দর যুবক আর বন্ধুর স্ত্রীই ছিল। সময়টি ছিল শীতকাল তার উপর আবার বৃষ্টিও হচ্ছিল, আর ঐ দেশে ঠাণ্ডার সময় রাত খুব লম্বা ও অন্ধকার হয়। ঘরে যুবকটি তার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকল কিন্তু সে আসতেছিল না। এ দিকে বাড়ীর গেইট বন্ধেরও সময় আসল, তার বন্ধুর কোন জরুরী কাজ থাকায় সে আর ফিরে আসতে পারে নি।
এদিকে তার স্ত্রীর দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেল যে, তার স্বামী রাতে আর ফিরবে না। তাই সে সাজ- সজ্জা করে ঐ যুবকের নিকট চলে আসল এবং নিজেকে পেশ করল; কিন্তু পরহেযগার যুবক তা প্রত্যাখ্যান করল। মহিলা বারংবার তাকে পাপে লিপ্ত হতে আহ্বান জানাতে থাকল যুবকটি একবার প্রলোভিত হয়ে সাথে সাথেই নিজেকে সংবরন করে নিল। ঘরে তখন লাইট জ্বলছিল, তখন যুবকটি তার হাত লাইটের উপর রেখে আবার সরিয়ে নিল। সে তখন মনে মনে বলতে লাগল, দুনিয়ার এ সামান্য আগুনের তাপ সহ্য করতে পারতেছি না অথচ জাহান্নামের আগুনের তুলনায় এ আগুন কিছুই না। মহিলাটি আবারও তাকে পাপে লিপ্ত হতে আহ্বান জানাল , যুবকটি আবার নিজেকে আগুনের নিকটবর্তী করল শরীরে একটু তাপ লাগার পর সে আবার দূরে সরে আসল এভাবে যখনই তাকে পাপে লিপ্ত হতে বলা হয় তখনই সে নিজেকে আগুনের নিকটবর্তী করে এবং কিছু তাপ লাগার পর আবার নিজেকে সরিয়ে নেয়।
মূলকথাঃ সমস্ত রাতই সে এভাবে জেগে থেকে তাওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে কাটিয়ে দিল , সকাল হতে হতে তার বৃদ্ধাঙ্গুলিটি আগুনের তাপে কালো হয়ে গিয়েছিল।
সূত্রঃ সোনালী পাতা, পৃষ্ঠা ৪৩।
এক মদ্যপায়ী এক আলেমে দ্বীনকে প্রশ্ন করলঃ আচ্ছা বলুন তো যদি আমি খেজুর খাই তাহলে কি এতে ইসলামে কোন নিষেধ আছে?
আলেমঃ না কোন নিষেধ নাই।
মদ্যপায়ীঃ এর সাথে যদি কোন ঔষধী বৃক্ষের মূল মিশিয়ে খাই তাতে কি কোন সমস্যা আছে?
আলেমঃ না নেই।
মদ্যপায়ীঃ এর সাথে যদি আমি পানি মিশিয়ে খাই তাহলে ?
আলেমঃ তৃপ্তি সহকারে খাও।
মদ্যপায়ীঃ যখন এ সমস্ত জিনিসই জায়েয এবং হালাল, তাহলে মদকে কেন হারাম বলে। অথচ এর মধ্যে তো ঐ বস্তু সমূহই রয়েছে যাকে খেতে ও পান করতে আপনি নির্দেশ দিতেছেন। অর্থাৎ খেজুর, পানি আর কিছু ঔষধী বৃক্ষের মূল।
আলেমঃ মদ্যপায়ীকেঃ যদি তোমার উপর পানি নিক্ষেপ করা হয় এতে কি তোমার কোন সমস্যা হবে?
মদ্যপায়ীঃ না কখনো না। পানি পরলে কি সমস্যা হবে!
আলেমঃ আচ্ছা ঐ পানির সাথে যদি মাটি গুলিয়ে দেয়া হয় তাহলে কি তুমি মরে যাবে?
মদ্যপায়ীঃ জনাব কাদার আঘাতে কাউকে কোন দিন মরতে দেখি নাই ।
আলেমঃ যদি মাটি, পানি এক সাথে করে একটা ইট বানিয়ে তাকে শুকিয়ে যদি তোমার উপর মারি, তাতে কি তোমার কোন সমস্যা হবে?
মদ্যপায়ীঃ জনাব এতে তো আপনি আমাকে কতল করে ফেলবেন।
আলেমঃ মদেরও একই অবস্থা।
সূত্রঃ সোনালী পাতা, পৃষ্ঠা ৪৬
খলীফা মো’তাসেম সামনে এসে বললঃ
হে আহমাদ তুমি শুধু বলে দাও যে, কুরআন সৃষ্টি তাহলে আমি নিজ হাতে তোমার বাঁধন খুলে তোমাকে মুক্ত করে দিব এবং তোমাকে এত এত ধন সম্পদ দান করব। উত্তরে ইমাম আহমাদ রহঃ শুধু বললঃ
কুরআনের কোন আয়াত বা কোন একটি হাদীসের দলীল এ ব্যাপারে পেশ কর। তাহলে সাথে সাথে আমি আমার রায় পরিবর্তন করব। খলীফা মো’তাসেম দাত কামড়িয়ে জল্লাদকে বললঃ সে আমার কথা মানছে না তোমার হাত ভেঙ্গে যাক তুমি তার উপর আরো কঠোরতা প্রয়োগ কর। আরও বেশী মার। জল্লাদ পূর্ণ শক্তি দিয়ে নতুন ভাবে মারতে থাকল ইমাম সাহেবের শরীরের গোশত ফেটে গেল রক্তের ফোয়ারা বইতে থাকল। খলিফার সভাসদ এক আলেম বলে উঠল । আহমাদ বিন হাম্বল! আল্লাহ কি বলে নাইঃ
“তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে কতল করো না।”
কেন তুমি অনর্থক খলীফার কথা না মেনে নিজেকে ধংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছ?
ইমাম আহমাদ রহঃ বলেনঃ
বাহিরে বের হয়ে দরজার সামনে গিয়ে দেখ কি অবস্থা?
সে আঙ্গিনা থেকে একটু বাহিরের দিকে ঝুকে দেখল অসংখ্য মানুষ কাগজ কলম হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে? সভাসদ আলেম তাদেরকে জিজ্ঞেস করল তোমরা কি জন্য অপেক্ষা করছ? তাঁরা বললঃ
আমরা অপেক্ষা করছি যে, খালকে কুরআনের ব্যাপারে ইমাম আহমাদ কি উত্তর দিচ্ছে তা লেখার জন্য। এ সভাসদ আলেম এসে যখন ইমাম আহমাদকে রহঃ সংবাদ দিল তখন তিনি বললেনঃ
আমি কি তাদের সবকে পথভ্রষ্ট করব? নিজে নিজেকে কতল করা মেনে নেয়া যায়; কিন্তু তাদেরকে পথভ্রষ্ট করা মেনে নেয়া যায় না।
ইমাম আহমাদ রহঃ এর প্রতি আল্লাহ অসংখ্য রহম করুন। আমীন।
সূত্রঃ সোনালী পাতা, পৃষ্ঠা ১৯২-১৯৩
পাদরীরা তাঁকে বললঃ তুমি তোমার প্রথম দ্বীনে ফিরে যাও কেননা সেটাই উত্তম; কিন্তু এই দুর্ভাগা ইসলামে ফিরে আসল না এবং খ্রিস্টান অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করল। আমরা আমাদের শেষ পরিণতি যেন ভাল হয় এজন্য দু’আ করছি।
সুফিয়ান সাওরী রহঃ বলেনঃ আমি এক ব্যক্তিকে কা’বা ঘরের গিলাফ ধরে বলতে দেখেছিঃ হে আল্লাহ! আমাকে নিরাপত্তা দাও, হে আল্লাহ আমরা চার ভাই, আমার তিন ভাই ইন্তেকাল করেছে এবং মৃত্যুর সময় তাঁরা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল । শুধু আমিই বাকী আছি, জানি না শেষ সময়ে আমার কি হবে!