
ঋতুবতী নারীর ইফতার ও কাযা
মুয়াযাহ বিনতে আব্দুল্লাহ আল-আদাবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন: আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলি: “ঋতুবতী কেন সওম কাযা করে, সালাত কাযা করে না? তিনি বললেন: তুমি কি হারুরি? আমি বললাম: আমি হারুরি না, কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করছি, তিনি বললেন: আমাদের এমন হত, অতঃপর আমাদেরকে শুধু সওম কাযার নির্দেশ দেয়া হত, সালাত কাযার নির্দেশ দেয়া হত না”।[1]
মুয়াযাহ থেকে ইমাম তিরমিযির এক বর্ণনায় আছে, সে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলে: “আমাদের প্রত্যেকে কি ঋতুকালীন সালাত কাযা করবে? তিনি বললেন: তুমি কি হারুরি? আমাদের কারো ঋতুস্রাব হলে, কাযার নির্দেশ দেয়া হত না”।[2]
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ঋতুবতী হতাম, অতঃপর পবিত্রতা অর্জন করতাম, তিনি আমাদেরকে সওম কাযার নির্দেশ দিতেন, কিন্তু সিয়াম কাযার নির্দেশ দিতেন না”। এ হাদীস ইমাম তিরমিযি বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন হাদিসটি হাসান। অতঃপর তিনি বলেন: “এ হাদিস অনুযায়ী আহলে ইলমের আমল, অর্থাৎ ঋতুবতী নারী সিয়াম কাযা করবে, সালাত কাযা করবে না। এ ব্যাপারে তাদের দ্বিমত সম্পর্কে জানি না”।[3]
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা “তুমি কি হারুরি” বলে, এ প্রশ্নের প্রতি অনীহা ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। হারুরি খারেজি সম্প্রদায়ের একটি গ্রুপ।কুফার নিকটে অবস্থিত হারুরা শহরে তাদের বসতি, এ জন্য তাদেরকে হারুরি বলা হয়, সেখান থেকে তাদের উৎপত্তি। তাদের মধ্যে ছিল দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও কঠোরতা।[4] তাদের কেউ হাদিস ও ইজমার বিপরীত ঋতুবতী নারীর উপর ঋতুকালীন সালাতের কাযার নির্দেশ দিত।[5] এ জন্য তিনি বিরক্তি প্রকাশক শব্দ দ্বারা তাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, তুমি কি তাদের কেউ?
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি ও কঠোরতা হারাম। কুরআন-হাদিসের সীমারেখায় অবস্থান করা ও সে অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব। আল্লাহর দেয়া শিথিলতা বা রুখসত গ্রহণ করা। দ্বীনের ব্যাপারে যেরূপ বাড়াবাড়ি খারাপ, অনুরূপ বাহানা তালাশ নিন্দনীয়। মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উত্তম, অর্থাৎ কুরআন-হাদিসের ওপর আমল করা।
দুই. দ্বীনের ব্যাপারে কঠোরতা আরোপকারীদের নিষেধ করা বৈধ, যেন সঠিকভাবে শরিয়তের বাস্তবায়ন হয় এবং কোন সমস্যার সৃষ্টি না হয়।
তিন. কোন প্রশ্নের কারণে প্রশ্নকারী সম্পর্কে যদি মুফতির মনে খারাপ ধারণা জন্মায় তাহলে প্রশ্নকারীর ব্যাখ্যা দেয়া উচিত যে, তিনি গোড়া নন বরং জানতে ইচ্ছুক, যেমন মুয়াযাহ বলেছেন: “আমি হারুরি নই, কিন্তু প্রশ্ন করছি” তখন মুফতির কর্তব্য দলিল দ্বারা তার প্রশ্ন দূর করা, যেমন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা করেছেন।
চারা. শরিয়তের মূল ভিত্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ। এ জন্য আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাকে বলেছেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সওম কাযার নির্দেশ দিতেন, সালাত কাযার নির্দেশ দিতেন না। অর্থাৎ যদি সালাতের কাযা ওয়াজিব হত, তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই তাদের কাযা করার নির্দেশ দিতেন। কারণ তিনি ছিলেন উম্মতের সবচেয়ে হিতাকাঙ্খি, তিনি উম্মতের জন্য প্রত্যেক বিষয় স্পষ্ট করে গেছেন।[6] মুসলিমের কর্তব্য আল্লাহর নির্দেশে পরিপূর্ণ সোপর্দ হওয়া, তার শরিয়তকে সম্মান প্রদর্শন করা ও দলিলের সামনে থেমে যাওয়া। আদেশগুলো বাস্তবায়ন করা, যেহেতু শরিয়তের আদেশ, নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকবে, যেহেতু শরিয়তের নিষেধ, কারণ বুঝা যাক বা না যাক।
পাঁচ. ইব্ন আব্দুল বার রহ. বলেছেন: “ঋতুবতী নারী সিয়াম পালন করবে না, বরং কাযা করবে, তবে সালাত কাযাও করবে না। এ বিষয়ে উম্মতের ইজমা রয়েছে। আল-হামদুলিল্লাহ। সকল মুসলিম যেখানে একমত, সেটা সঠিক ও চূড়ান্ত সত্য”।[7]
ছয়. নারীর ওপর ইসলামি শরিয়তের ছাড় এই যে, তাদেরকে সালাত কাযার নির্দেশ দেয়া হয়নি, কারণ সালাত দিনে একাধিক বার, যার কাযা খুব কষ্টকর। এ জন্য নারীদের উচিত আল্লাহর শোকর আদায় করা।
সাত. নারী যদি ফজর উদিত হওয়ার সময় পাক হয়, তাহলে সে দিনের সওম তার শুদ্ধ হবে না, কাযা করা জরুরী, কারণ যখন ফজর উদিত হয়েছে, তখন সে ঋতুবতী। নারী যদি সূর্যাস্তের সামান্য আগে ঋতুবতী হয়, তাহলে তার সওম বাতিল, কাযা করা ওয়াজিব।[8]
নয়. নারী যদি সূর্যাস্ত যাওয়ার সামান্য পর ঋতুবতী হয়, তাহলে সে দিনের সওম শুদ্ধ।
দশ. নারী যদি সওম অবস্থায় রক্ত আসা অথবা তার ব্যথা অনুভব করে, সূর্যাস্তের আগে বের না হয়, তাহলে তার সওম শুদ্ধ।[9]
এগার. এ হাদিস থেকে বুঝায় অসুস্থ ব্যক্তি সওম ভঙ্গ করতে পারবে, যদিও তার সওমের ক্ষমতা থাকে, যদি রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। কারণ ঋতুবতী নারী একেবারে দুর্বল হয় না, বরং রক্ত বের হওয়ার কারণে তার ওপর সওম কষ্টকর, আর রক্ত বের হওয়া একটি রোগ।[10]
তথ্যসূত্র :
[1] বুখারি: (৩১৫), মুসলিম: (৩৩৫)
[2] তিরমিযি: (১৩০)
[3] তিরমিযি: (৭৮৭)
[4] ফাতহুল বারি: (১/৪২২)
[5] দেখুন: আল-মুগনি: (১/১৮৮), হাশিয়া সিনদি আলা সুনানে নাসায়ি: (৪/১৯১), উমদাতুল কারি: (৩/৩০০)
[6] উমদাতুলকারী: (৩/৩০১)
[7] তামহিদ: (২২/১০৭)
[8]ফাতাওয়া লাজনায়ে দায়েমা: (১০/১৫৫), ফাতাওয়া নং: (১০৩৪৩)
[9]“ফাতাওয়া আল-জামেয়াহ লিল মারআল মুসলিমাহ” লি ইব্ন উসাইমিন: (১/৩২৫)
[10] শারহু ইব্ন বাত্তাল আলাল বুখারি: (৪/৯৭-৯৮)
**** ইবরাহিম ইব্ন মুহাম্মাদ আল-হাকিল রচিত রমযানের বিষয়ভিত্তিক হাদিস : শিক্ষা ও মাসায়েল বই হতে সংগৃহীত।