
মৌলবাদীদের অদ্ভুত ব্যাপার
মুসলিম বিশ্ব বর্তমানে প্রতিযোগী জাতি-রাষ্ট্রসমূহের জোড়াতালি বিশেষ, যেগুলি এমন সব বিচার বিভাগীয় ও রাজনৈতিক পদ্ধতি দ্বারা শাসিত যা কোনক্রমেই “ইসলামী” বলা যায় না। নিঃসন্দেহে অধিকাংশ দেশেই আল্লাহ তাঁর রাসূলের কাছে যা অবতীর্ণ করেছেন তার বিরোধী আইন বিদ্যমান। মনে হয় এসব জাতিগুলির একমাত্র ইসলামী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে তাদের মধ্যে মুসলিম রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের এক বিরাট অংশ গত প্রায় দুইশত বছর যাবত কোন না কোন ইউরোপীয় শক্তির শাসনাধীনে বা সংরক্ষণে ছিল, যারা ধীরে ধীরে শরীয়াকে (ইসলামী আইন) বিভিন্ন পশ্চিমা পদ্ধতিতে প্রতিস্থাপন করেছে। তথাকথিত “স্বাধীনতা” পাওয়ার পরও এ সমস্ত বহিরাগত রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগীয় পদ্ধতিসমূহ রয়ে গেছে অথবা অন্য কোন পশ্চিম-প্রভাবিত সংকর দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
তুরস্কের আতাতুর্কের “জাতীয়তাবাদ”, ইরাক ও সিরিয়ার ‘বাথবাদ”, মিশরের জামাল আবদুন নাসেরের “প্যান আরব জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্র”, এবং এর বিভিন্ন প্রজাতি যেমন গাদ্দাফীর “ইসলামী সমাজতন্ত্র”। এসমস্ত আন্দোলনসমূহ তাদের লক্ষ্যের সাথে সঙ্গত মনে হলেই অবাধে “ইসলামী” শ্লোগান ব্যবহার করে চলছে। সাধারণ জনতা নতুন পাওয়া “স্বাধীনতার” উৎসাহে উদ্দীপ্ত, এবং তা রক্ষা করার জন্য তাদেরকে বলা হয় যে তাদেরকে অবশ্যই “আধুনিক” হতে হবে। তথাকথিত “বুদ্ধিজীবী”দের কাছে এর অর্থ হচ্ছে অতীতের সবকিছুই বর্জন করা এবং নতুন সবকিছুকেই গ্রহণ করা। এভাবেই “মডার্নিস্ট” আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, মোহাম্মদ আবদুহু এর মত লোকেরা যার নেতৃত্বে ছিলেন, যে আন্দোলন নবী (সঃ) এঁর সমস্ত অলৌকিক ঘটনাবলীকে এবং এমনকি ইবাদতের বহু মৌল কর্মকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। প্রথমবারের মত রিবা (সুদ) বৈধ (?) ঘোষণা করা হয় এবং পশ্চিমা পোশাক ও জীবনযাত্রাকে উৎসাহিত করা হয়। ব্যক্তিগত ইজতিহাদ (বিচারের যুক্তি) ও আয়াতের ব্যাখ্যার ব্যাপারে মুসলিম আলিম সমাজের প্রচলিত পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে তারা এসব কিছুকেই গ্রহণযোগ্য করার প্রচেষ্টা চালান।
অন্যদের কাছে ইসলাম নিজে শুধুমাত্র প্রগতির শত্রু, বিশেষ করে সোভিয়েট ইউনিয়নে যেখানে ঘোমটা পোড়ানো হয়েছিল, মসজিদগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছিল এবং জ্ঞানীদের সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। রাস্তার দেওয়ালগুলিতে রং দিয়ে লিখে দেওয়া হয়েছিল এই শব্দগুলি: “কোন খোদা নেই এবং লেনিন হচ্ছেন তাঁর নবী।” মুসলিম বিশ্বের নানা স্থানে মসজিদগুলো শূন্য হয়ে গেছে এবং মিনি স্কার্ট পরা মহিলারা রাস্তায় হাঁটছে। পরিবর্তন শুরু হয়েছে। পশ্চিমা এবং কমিউনিস্ট শক্তি, ভেষজশাস্ত্র ও যন্ত্রবিদ্যার যাদুকরী উৎকর্ষ, চাঁদে মানুষের উপস্থিতি এবং মানচিত্রকে কয়েক দিনেই প্রদক্ষিণ করার যোগ্য বিমান, বিপুল ধ্বংসযজ্ঞে সক্ষম মারণাস্ত্র যা একত্রে বিশ্বকে সতের বার ধ্বংস করতে সক্ষম হবে, কম্পিউটার চিপ এবং সেসব জাতিসমূহ যেগুলি আপাতঃ দৃষ্টিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বস্তুগত সমৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারী-এসবের মুখেও ইসলামের প্রতি একটা ধীরগতির তবুও অপরিহার্যভাবে লক্ষণীয় প্রত্যাবর্তন দেখা যায়। মনে রাখা দরকার শুধুমাত্র অশিক্ষিত দারিদ্র্যপীড়িত কৃষকদের মধ্যে নয়, শিক্ষিত, ধনী, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাঝেও। বিশেষতঃ এটা শুধুমাত্র পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের জন্য মসজিদে ফেরা নয়, বা নারীদের জন্য ঘোমটাও নয়, এটা হচ্ছে সামগ্রিকভাবে ইসলামে ফিরে যাওয়া-আরেকবারের জন্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়া। ইকোনমিস্টের জরিপের মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার বহু পূর্বেই মুসলিম জ্ঞানীজনের কাছে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান ছিল যে কার্যতঃ ইসলাম ব্যক্তিগত ও সর্বসাধারণের মাঝে, ধর্মীয় ও রাজনৈতিকের মাঝে কোন পার্থক্য করে না। এটা বাস্তবে একেবারেই স্পষ্ট যে সংকর সামাজিক-রাজনৈতিক-বিচার বিভাগীয় পদ্ধতির মুসলিম দেশগুলির আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ইসলামের মূল বৈশিষ্ট্যের বিপরীতমুখী। তাই মুসলিমদের সঠিক অবস্থানে আনার জন্য নানা ধরনের আন্দোলন শুরু হয়েছে। অবশ্যই এই আন্দোলনসমূহ এসব পদ্ধতির সমর্থক সরকারগুলির বিশেষ বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। এই বিরোধিতা, আগেও ছিল, এখনও আছে, কখনও বা চরমভাবে বর্বররূপে। এই সরকারগুলি তাদের পশ্চিমা ও কমিউনিস্ট তত্ত্বাবধায়কদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনুমোদন পেয়েছে, যারা বাস্তবে বর্তমান অবস্থায় এবং তাদের নিজস্ব কার্যকর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রাধান্যের ব্যাপারে-যা তারা অর্জন করতে এত কঠোর চেষ্টা করেছে-এ ধরনের মুসলিম পুনর্জাগরণের সম্ভাব্য হুমকি সম্পর্কে অধিক সচেতন ছিল। তারা মোটেও যা চায় না তা হলো মুসলিমদের আবার উঠে দাঁড়ানো দেখতে। তবু পুনর্জাগরণ চলছেই….
হয়তো যে কারণে ইসলামী মৌলবাদের এই উত্থান এত বিস্ময়কর তা হচ্ছে যে মৌলবাদীরাই এটাকে তা করেছে, অর্থাৎ, মৌলিক! সবকিছুর পরও, যখন একজন মুসলিম এ সম্পর্কে সচেতন হয় যে আল্লাহর প্রদর্শিত প্রতিষ্ঠিত আইন ও বিধান ছাড়া অন্য কোন ধরনের আইন ও বিধানের স্থায়িত্বের উপর আস্থা রাখার অর্থই হচ্ছে ক্ষমার অযোগ্য পাপ “শিরকে” লিপ্ত হওয়া, তখন, যেমন কুরআনে বলা হয়েছে,
“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন বিশ্বাসী পুরুষ কিংবা বিশ্বাসী নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না।” (সূরা আল আহযাব, ৩৩:৩৬)
“তখন তারা তো কেবল এ কথাই বলে, ‘আমরা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম।’ (সূরা আন নূর, ২৪:৫১)
নিঃসন্দেহে এটাই একজন মুসলিমকে সে যা তা হিসাবে চিহ্নিত করে: এমন কেউ যে তার নিজেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করে। অবশ্যই সরকার গুলির অদক্ষতা, দুর্নীতি ও বর্বরতা, তাদের আদর্শের অবধারিত ব্যর্থতা, এবং তাদের পুনঃ পুনঃ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লাঞ্ছনা মৌলবাদীদের কাজকে সহজ করে দিয়েছে। তবুও এই ধারণা নিতান্তই সাধারণ যে এসবই মৌলবাদের উত্থানকে শক্তি যুগিয়েছে। নিশ্চিতভাবেই, মুসলিম জনগণের দারিদ্র ও অসহায় অবস্থা তাদেরকে অত্যন্ত আগ্রহের সাথেই “আধুনিকীকরণ”, “পশ্চিমাকরণ” এবং “গণতন্ত্রের” পথে ঠেলে দেওয়ারই কথা ছিল, তাদের দেশগুলো যেগুলির উজ্জ্বল উদাহরণ কদাচিত ছিল বলা চলে! নিঃসন্দেহে, সবচেয়ে সাধারণ কৃষকও প্রতিদিন টেলিভিশনের (সবচেয়ে দীনহীন ঘরেও যা একটি বিছানার মতই প্রয়োজনীয় জিনিসে পরিণত হয়েছে) পর্দায় পশ্চিমা বিশ্বের বস্তুতান্ত্রিক সাফল্যের চিত্রের প্রতিচ্ছবিই প্রতিদিন দেখতে পায়!
ইসলামী সচেতনতার এই ক্রমাগত বৃদ্ধির পেছনে সত্যিকার যে কারণ রয়েছে, তা সেগুলি নয় যা পশ্চিমা বিশ্লেষকরা সবসময় উল্লেখ করে থাকে। এই ব্যাপারটি বুঝতে তাদের অক্ষমতার আংশিক কারণ হচ্ছে নির্ভেজাল বস্তুবাদে তাদের নিমজ্জিত হওয়া। তারা বিশ্বাস করে যে বিজ্ঞান ও “বিবর্তনবাদ” প্রমাণ করেছে যে মানুষ অন্ততঃপক্ষে অগ্রসর জন্য ছাড়া আর কিছু নয়, কোন প্রগতিশীল বানর বলা যায়, এবং মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহ যেমন: খাদ্য, পানীয়, অজানা প্রাণী থেকে নিরাপত্তা, যৌনকামনা আমাদের ধরে নেওয়া পূর্বপুরুষদের থেকে সামান্যই ভিন্ন। এসবের পরিতৃপ্তি ঘটলেই মানুষের চরিতার্থতা। মুসলিম বিশ্ব কমবেশী মানবীয় অবস্থার বাস্তবতার সাথে সংস্পর্শ রেখেছে যে, সুখ একটি পার্থিব বস্তু নয়, বরং আরো গভীর কোনকিছু, এবং এর জ্ঞান থাকাটা প্রয়োজন, শুধুমাত্র বস্তুর চাহিদা মিটানোর চেয়ে মানবীয় অবস্থার ভালর জন্য হয়তো বেশীই প্রয়োজন। বস্তুবাদী মনোভাবের অশুভ ফলাফল আজ পশ্চিমা সমাজের পচন ধরা সামাজিক অবস্থায় অত্যন্ত প্রকট। মুসলিম দেশসমূহেও এর ফলাফল আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয় যে কারণটির জন্য ইসলামী পুনর্জাগরণ এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তা হলো, আজ বহু মুসলিম বিশেষ করে অধিক স্বাক্ষর ও শিক্ষিতদের কাছে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে পশ্চিম নিজেই সত্যি সত্যি “গণতন্ত্র” বা এ ধরনের অন্য কোন আদর্শে, যেমন “বাক স্বাধীনতা”, “মানবাধিকার” ইত্যাদিতে বিশ্বাসী নয়, যা সে এত যত্নে লালন করেছে বলে দাবী করে-যতক্ষণ না সেগুলি তাদের স্বার্থরক্ষা করে। এই দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি কেবল মৌলবাদীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। কার্যতঃ বর্ধনশীল হারে পশ্চিমারা অনুরূপ মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করেছে। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমাদের কাছে অতীত পরাজয়, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা, অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজ সরকার-এর কোনটাই ইসলামের বিস্ময়কর উত্থানের গ্রহণযোগ্য কারণ নয়। সামপ্রতিক হিসাবে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডেই গড়ে প্রতিদিন তিনজন ইসলাম গ্রহণ করছে। আমেরিকায় এই সংখ্যা আরো বেশি এবং এসবই ঘটছে, ইসলামের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদ ও প্রচারমাধ্যমগুলির অবিরত বিকৃতি ও জালিয়াতি সত্ত্বেও। কার্যত যে সমস্ত দেশে দর্শনীয়ভাবে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ছে (মিশর ও আলজিরিয়া), সেখানে সরকার, বেতার, টিভি এবং সংবাদ সংস্থা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে। এতদসত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে (আক্ষরিক অর্থে) চৌদ্দশত বছর পুরনো এক বইয়ের প্রতি ফিরে যাওয়ার জন্য। কিভাবে এটা সম্ভব? নিশ্চয়ই “বিজ্ঞান” এবং “যুক্তি” কুরআন এবং ইসলামকে মারণাঘাত করেছিল যেভাবে তা বাইবেল ও খৃষ্টানত্বকে করেছিল? মনে হচ্ছে ব্যাপারটি তা ঘটেনি, এবং কেন নিশ্চয়ই তার কোন উপযুক্ত কারণ আছে!
সেটিই হচ্ছে তৃতীয় কারণ এবং আসলে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেন মৌলবাদের এবং ইসলামের এই বিরাট উত্থান সম্ভব হলো? ইকোনমিস্টের প্রবন্ধে বলেছে:
“…বিংশ শতকের শেষভাগে এসে কেন অনেকের কাছে মুসলিম বিশ্বের সংস্কৃতিকে পশ্চিমের একমাত্র বাস্তব আদর্শিক প্রতিযোগী মনে হচ্ছে তার একটি উপযুক্ত কারণ রয়েছে। কনফুসিয়ানদের বিপরীতে, এবং আরো বেশী করে ল্যাটিন আমেরিকান, স্লাভ ও জাপানীদের বিপরীতে-ইসলাম দাবী করে যে তা অতিপ্রাকৃত নিশ্চয়তার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই নিশ্চয়তা হচ্ছে আল্লাহর বাণী, যা প্রতিটি শব্দাংশে মুহাম্মাদের কাছে অবতীর্ণ হয়েছে। অধিকন্তু, এবং যা অন্য কোথাও ঘটছে না-নতুনেরা এই নিশ্চয়তার দাবীতে যোগ দিতে ভীড় জমাচ্ছে।” (পৃ. ৪, অ ২)
তাহলে এই জরিপ, মুসলিমদের বাস্তবে তাদের দ্বীন ত্যাগ করে ক্ষমার অযোগ্য পাপ “শিরক” করতে বলার আগে-আল্লাহর আইনকে মানব-রচিত আইন দিয়ে প্রতিস্থাপন করে-কুরআনকে “আল্লাহর বাণী” নয়, অন্ততঃ এর কিছু অংশ নয়, একথা ঘোষণা করল না কেন, যাতে এখানে সেখানে কিছু জোড়াতালি দিয়ে আগে যা ঘটেছিল তার সাথে সমতা রক্ষা করা যায়? অন্ততঃ বাইবেলের ব্যাপারে এ কাজটি তো দক্ষতার সাথে সম্পাদন করা গেছে। সমপ্রতি বিশ্বের প্রথম সারির বাইবেল বিশেষজ্ঞদের একটি প্রতিনিধি দল বলেছেন যে যীশুর কথা বলে দাবী করা শব্দের প্রায় ৭০% ভাগই তার কথা নয়, এবং ধর্মযাজকগণ কোন ঝুঁকি ছাড়াই বলছেন যে বাইবেলের কোন কোন অধ্যায়, যেমন সোডোম ও গোমোরা শহরে সমকামীদের আল্লাহ কর্তৃক ধ্বংস হওয়া, আল্লাহর বাণী নয়। কার্যতঃ বিজ্ঞান ও আধুনিক বাইবেল বিশেষজ্ঞগণ বাইবেলের বাণীর সত্যতা সম্পর্কে মোটের উপর এতই সংশয় বিস্তার করেছে যে যারা বাইবেল “আল্লাহর বাণী” এই অসমর্থনীয় মতকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়, তাদের সম্পর্কে একটা ক্ষতিকর শব্দ বানানো হয়েছে: মৌলবাদী! আসলে খৃষ্টান মৌলবাদীরা বাইবেল সম্পর্কে সেই দাবীই করে যা মুসলিমরা কুরআন সম্পর্কে করে থাকে। তাহলে খৃষ্টানদের দাবী কেন সমানভাবে শক্তিশালী শক্তি এবং অনুরূপ আদর্শিক প্রতিযোগী হিসাবে গণ্য হয় না? কারণ হচেছ যে দাবী করলেই কোন কিছুর ভিত্তি তৈরী হয় না। দাবী প্রমাণ করতে হয়, এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা দাবীর শক্তিস্বরূপ। খৃষ্টানদের পক্ষে বাইবেল “আল্লাহর বাণী” এই দাবীতে অটল থাকা কঠিন, কারণ সাক্ষ্যপ্রমাণ এর বিরুদ্ধে যায়।
“ইনজিলের” সত্যতার মোহ মধ্যযুগে বজায় রাখা সম্ভব ছিল, কারণ খুব কম সংখ্যক লোকের কাছেই তা সহজলভ্য ছিল, এবং তারা ছিল পাদ্রীরা! পোপের হুকুমে অন্যদের তা পড়া নিষেধ ছিল, এমনকি কখনও তা পড়ার জন্য মৃত্যুযন্ত্রণা পেতে হয়েছে। শিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে এবং “আলোকিত যুগের” শুরুর সময় বাইবেল সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছায়। এর আভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য এবং বৈজ্ঞানিক অসামঞ্জস্য প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে তা সম্মান হারিয়ে ফেলে।
“বিজ্ঞানই” হচ্ছে আধুনিক বিশ্বের নিশ্চয়তার দাবী, যা, এই দাবী করে যে তা হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং কারিগরি বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণ। এর ফলাফল হচ্ছে এর প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ, এবং “গণতন্ত্রের” ডানার আশ্রয়ে এই ফলাফল অর্জিত হয়েছে। এভাবে এই দুটো পরস্পর জড়িত। “গণতন্ত্রের” সপক্ষে যুক্তিসমূহের একটি হচ্ছে বিগত পঞ্চাশ বছরে গণতান্ত্রিক জাতিগুলির মধ্যে বড় কোন দ্বন্দ্বের অনুপস্থিতি, এবং অপরটি হচ্ছে এর দ্বারা অর্জিত বস্তুগত সমৃদ্ধি। আসলে, আমার মনে পড়ছে যে আমি ইকোনমিস্টে পড়েছি: “অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় পশ্চিমা জাতিগুলি অধিক হারে মানুষের বস্তুগত চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়েছে।” সব যুক্তিই অত্যন্ত শক্তিশালী। এভাবে দাবী তৈরী হলো এবং একে সমর্থনের প্রমাণও যোগাড় করা হলো। (আমরা ইনশাল্লাহ, পরবর্তীতে এই দাবীর যৌক্তিকতা বিচার করবো।) যাহোক, এখানেই শেষ হলো না। দাবী এবং আনুষঙ্গিক সাহায্যকারী প্রমাণ থেকে আদর্শকে রূপদান করা হলো, তা না হলে জরিপের লেখক কাউকে এই পরামর্শ (মুসলিম বিশ্ব ছাড়াও) দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাতেন না যে তাঁর ধারণাগুলি গ্রহণ করা উচিত, তিনি বলেছেন বলেই! তিনি বিশ্বাস করেন যে “আধুনিক জীবনযাত্রার” সপক্ষে তাঁর প্রদত্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের যথার্থতা তাঁর পরামর্শগুলিকে জোরদার করতে যথেষ্ট। অংশত যা “গণতন্ত্র”কে গণতন্ত্র হিসাবে তৈরী করেছে তা হচ্ছে আপোষকামিতার নীতি এবং বাস্তবধর্মীতা যা মানবীয় অজ্ঞতা এবং দোষের আলোকে সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত। সমস্যা এই যে ইকোনমিস্টের জরিপ আশা করে যে ইসলাম অনুরূপ কাঠামোতে কাজ করবে। ইসলাম, অপরপক্ষে, এই নিশ্চয়তার উপর ভিত্তি করে তৈরী যে তা সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ। এর অনুসিদ্ধান্ত সমূহের মধ্যে সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে আল্লাহ মানুষের মত অজ্ঞ এবং দোষত্রুটিপূর্ণ নন, বরং তিনি সর্বজ্ঞানী ও সম্পূর্ণভাবে ত্রুটিহীন, এবং সেজন্যই আল্লাহর বাণীর ব্যাপারে আপোষের কোন প্রশ্ন নেই, নেই প্রয়োগবাদের দর্শন – বিশেষভাবে অনুমোদিত ক্ষেত্র ছাড়া।
সবকিছুই ব্যাখ্যা করা সম্ভব, এই যুক্তিতে জরিপে এইসমস্ত বাধাবিঘ্ন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু আসলে আল্লাহ ইতোমধ্যেই এই সম্ভাব্য ছিদ্রপথ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্ধ করে দিয়েছেন যখন তিনি চৌদ্দশত বছর পূর্বে একজনের মাধ্যমে ইসলাম অবতীর্ণ করেছিলেন যাতে তিনি তাঁর আয়াতসমূহ ব্যাখ্যা করেন:
“আমরা তোমার প্রতি গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি, এবং তোমাকে নিযুক্ত করেছি মানুষকে তা বোঝাবার জন্য।” (সূরা আন্তনাহল, ১৬:৪৪)
অতএব কুরআনের পাঠ্যাংশের ব্যাখ্যার জ্ঞান বিশেষভাবে মুহাম্মাদ (সঃ) কেই দেওয়া হয়েছিল, এবং এখানেই শেষ করা হয়নি। কুরআন আরো বলছে:
“যে কেউ রাসূলের বিরোধিতা করে এবং বিশ্বাসীদের পরিবর্তে অন্য পথ বেছে নেয়, তাহলে আল্লাহ তাদেরকে তাদের নির্বাচিত পথে চলার জন্য ছেড়ে দেবেন এবং তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন, কতই না মন্দ আশ্রয় সেটা!”
বিশ্বাসীদের পথ কি? নবী (সঃ) ব্যাখ্যা করেছেন: “যার উপর আমি ও আমার সাহাবারা আছে”। নবী (সঃ) আরো বলেছেন মুসলিমরা যেন তাঁর ও হিদায়াত প্রাপ্ত অনুসারীদের পথ আঁকড়ে ধরে থাকে। এই সাহাবারা বংশ পরম্পরায় জ্ঞান এবং পথ বর্ণনা করে গেছেন বর্তমান সময় পর্যন্ত; ঠিক যেভাবে নবী (সঃ) বলেছিলেন তাঁরা করবেন:
“এই উম্মাতের ভিতর থেকে সবসময় একটি দল থাকবে যারা সত্যের উপর দৃঢ় হবে, তাদের বিশ্বাসে অক্ষত থাকবে তাদের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও।”
এটা হচ্ছে ঠিক সেই ধরনের উপলব্ধির ক্ষমতা যা ইসলামকে সমালোচকদের কাছে হতাশাব্যঞ্জক ও অনুগামীদের কাছে প্রত্যয়ী করে তোলে। এবং এই উপলব্ধির ক্ষমতা ইসলামের বিভিন্ন দিক ও বিভাগে বিস্তার লাভ করে। ইসলামের এই দাবী যে এটা এই নিশ্চয়তার উপর ভিত্তিশীল যে এটা সর্বজ্ঞানী সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে, এটা কেবল দাবীই নয়, বরং এই দাবীর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী প্রমাণ। এর অনুগামীদের জন্য এই প্রমাণ যথেষ্ট শক্তিশালী যা আধুনিক বিশ্ব কর্তৃক প্রদত্ত প্রমাণের উপর অগ্রগণ্য।
http://bnislam.com/…/…/17/proof-quran-revelation-of-allah-3/
মূল লিখাঃ আবদুর রহিম গ্রীন