
নষ্ট হলো বন্ধুত্ব
শেফালী ও শারমীন। দুই বান্ধবী। খুবই ঘনিষ্ট। পরস্পর দেখা না করে, কথা না বলে একদিনও থাকতে পারেনা। তাই স্কুল জীবন থেকে শুরু করে কর্মজীবনেও ওরা একসঙ্গে আছে। একই কোম্পানিতে চাকরি করে। ভিন্ন দুটি কোম্পানিতে আরো উচুঁমানের চাকরি দু’জনই পেয়েছিল। কিন্তু একত্রে থাকার বাসনায় সেই চাকুরীতে না গিয়ে একই কোম্পানিতে চাকুরী নেয়। ওদের আশা, দুই বান্ধবী আজীবন একই সাথে থাকবে। বিয়ে করলেও একই গ্রামে করবে! যেন প্রতিদিনই দু’জনের দেখা হয়, কথাবার্তা হয় !!
কিছুদিন পর মাসউদ নামের এক ছেলের সঙ্গে মোবাইলে পরিচয় হয় শারমীনের। তারপর তাদের মাঝে প্রায়ই কথা হয়। এভাবে কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে তা প্রেমের রূপ ধারণ করে। একজন আরেক জনকে ভালোবাসতে থাকে গভীর থেকে গভীরভাবে। স্বপ্ন দেখতে থাকে ঘর বাঁধার।
প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠার পর শারমীনের সঙ্গে মাসউদের প্রতিদিনই কথা হয়। একদিন কথা না বলতে পারলে তাদের ভালো লাগে না। এমনকি রাতে বিছানায় গিয়ে ঘুমও আসে না!
হঠাৎ একদিন শারমীনের মোবাইল ফোনটা নষ্ট হয়ে যায়। চিন্তায় পড়ে যায় শারমীন। কেননা, মাসউদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমই হলো এই মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোন ছাড়া মাসউদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। কারণ মাসউদ ইটালী প্রবাসী। অন্তত পাঁচ বছর আগে দেশে ফিরার কোনো চিন্তা-ভাবনা তার নেই।
শারমীনকে চিন্তামগ্ন দেখে শেফালী জিজ্ঞেস করল- কিরে! কী হয়েছে? এভাবে মুখ ভার করে বসে আছিস কেন? কোনো অসুখ-বিসুখ হয়নি তো?
না। অসুখ-বিসুখ কিছু নয়। মনটা খারাপ অন্য কারণে!
কী সেই কারণ সেটা জানার অধিকার কি আমার আছে ?
র্তো জানার অধিকার না থাকলে কার থাকবে বল্। তুই আর মাসউদ ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কে-ই বা আছে!
ঠিক আছে। এত প্যাচাঁল না পেরে এখন বল্ কী হয়েছে?
গতকাল মোবাইল ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই মাসউদের সাথে আমার কথাবার্তা একদম বন্ধ। আমার হাতে এখন টাকাও নেই যে, আজই আরেকটা মোবাইল কিনতে পারব। আজই বলি কেন, আগামী একমাসের মধ্যেও মোবাইল কেনা সম্ভব হবে না। কারণ আজ মাত্র এপ্রিল মাসের চার তারিখ। আগামী মাস শুরু না হলে টাকা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া এখন তো তোর কাছেও টাকা নেই। সেকথা তো গতকাল তুই আমাকে বলেছিস।
একটুকু বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শারমীন। তারপর আবার বলতে থাকে- জানিস শেফালী ! ফোনটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে গতরাত আমার ভালো ঘুমও হয়নি। গোটা রাত কেবল এপাশ-ওপাশ করেছি। প্রথম প্রথম তোর সাথে কথা না বললে আমার যে অবস্থা হতো, আজ রাতে আমার সে অবস্থাই হয়েছিল। তাই এখন এখানে বসে মনে মনে ভাবছিলাম, কিভাবে মাসউদের সাথে কথা বলব? কিভাবে তার সাথে যোগাযোগ করব। বেশ হতাশ কণ্ঠে কথাগুলো বলল শারমীন।
ও সেই কথা! তা আমাকে আগে জানাস্নি কেন ? যাহোক চিন্তার কোনো কারণ নেই। এখন থেকে মাসউদের সাথে আমার মোবাইল দিয়ে কথা বলিস্। তাকে বলে দিস্- যখনই মনে চায় সে যেন আমার মোবাইলে ফোন করে। বান্ধবীকে আশ্বাস দিয়ে বলল শেফালী।
এরপর থেকে শেফালীর মোবাইল দিয়ে মাসউদের সঙ্গে কথা বলে শারমীন। মাসউদও শেফালীর মোবাইলে রিং দিয়ে শারমীনকে ডেকে দিতে বলে। এভাবে কথাবার্তা চলে দশ বার দিন।
যেহেতু মাসউদ শেফালীর মোবাইলে ফোন করে সেহেতু মাঝে মাঝে শেফালীর সাথেও কথা হয় মাসউদের। এভাবে আস্তে আস্তে শেফালীর সঙ্গেও সখ্যতা গড়ে উঠে ওর। আগে মাসউদের ফোন আসলে রিসিভ না করেই শারমীনের হাতে মোবাইল তুলে দিত শেফালী। কিন্তু এখন রিসিভই শুধু করে না, কয়েক মিনিট কথা বলে তারপর শারমীনকে মোবাইল দেয়।
শারমীন এ বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নেয়নি বা নিতে পারেনি। তার বক্তব্য হলো, মাসউদ আমার! একান্তই আমার!! অতএব শেফালী ওর সাথে মিঠে মিঠে আলাপ করবে কেন ? কেন সে আমার অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে?
একদিন শারমীন মাসউদকে বলল- তুমি শেফালীর সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। তুমি আমার। শুধুই আমার। তুমি আর কারো হতে পারো না!
জবাবে মাসউদ শারমীনকে বুঝাতে চেষ্টা করল। বলল- শারমীন! শেফালী হয়তো মোবাইল রিসিভ করে ভদ্রতার খাতিরেই আমার সাথে দু’চারটা কথা বলে। আমিও সেই ভদ্রতাবশতই তার কথার জবাব দেই। এতে তুমি মনে কিছু নিও না। বিশ্বাস করো, আমি তোমার আছি, তোমার হয়েই আজীবন থাকব!
কিন্তু এসব কথা শারমীনের কর্ণে প্রবেশ করে না। সে শেফালীকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। এতে ধীরে ধীরে দুই বান্ধবীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এমনকি এক পর্যায়ে একজন আরেকজনকে প্রতিপক্ষ ভাবতে থাকে। ফলে মাসউদকে কেন্দ্র করে উভয়ের মধ্যে প্রায়ই বিরাট ঝগড়া হয়। তর্ক-বিতর্ক হয়। কথা কাটাকাটি হয়!
এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর দুই বান্ধবীর সম্পর্ক একদম নষ্ট হয়ে যায়। শেষ হয়ে যায় হৃদয়ের সব টান। শত্রুতে পরিণত হয় দু’জন দু’জনার। শুধু তাই নয়, কয়েকদিন পর শারমীন কোম্পানির চাকুরী ছেড়ে দিয়ে অন্য একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি নেয় !
এরপর থেকে শারমীন ও শেফালীর কোনো যোগাযোগ নেই। আজ আট বছর পার হয়ে গেল। কে, কিভাবে আছে, কোথায় আছে- কিছুই তাদের জানা নেই। আর জানার প্রয়োজনও তারা বোধ করেনি। যেন দু’জন দু’জগতের বাসিন্দা!!
প্রিয় পাঠক! শুনলেন তো মোবাইল প্রেমের কারণে দুই বান্ধবীর মধুর সম্পর্ক কিভাবে নষ্ট হয়ে গেল। কিভাবে তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলো। কিভাবে একে অপর থেকে শুধু মনের দিক থেকেই নয়, শারীরিক ভাবেও পৃথক হয়ে গেল!
মুহতারাম পাঠক-পাঠিকা! এখানে তো শুধু সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। অনেক সময় এমনও হয় যে, জীবনটাই নষ্ট হয়ে যায়। প্রেমের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে অনেক ছেলে-মেয়ে আত্মহত্যাও করে। একটু চিন্তা করে বলুন তো! যে প্রেম- বন্ধু বান্ধবের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি করে, যে প্রেম মহামূল্যবান জীবন ধ্বংস করে, যে প্রেম আত্মহত্যা করতে উদ্ধুদ্ধ করে- সে প্রেম কি কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ করতে পারে? না, পারে না, কখনোই না। চোখের সামনে এসব লোমহর্ষক ঘটনা দেখেও, পত্র-পত্রিকা ও বই-পুস্তকে এত শিক্ষণীয় ঘটনা পাঠ করেও, এত ওয়াজ-নসিহত ও উপদেশের পরেও যেসব ছেলে মেয়ে প্রেম করে- তাদের ব্যাপারে নিদির্¦ধায় বলা যায়, তাদের জ্ঞানের কমতি আছে, বুদ্ধির অভাব আছে। অথবা বলা যায়, তাদের চেতনাশক্তি ও বুদ্ধি-বিবেক লোপ পেয়েছে!!
তাই সবশেষে আবারও বলি, ভয়ঙ্কর এ পথে কেউ পা বাড়াবেন না। কারণ এ পথ দেখতে বড় মসৃন মনে হলেও বাস্তবে তা ভয়াবহ কণ্টকাকীর্ণ। দোয়া করি, আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের সবাইকে অবৈধ প্রেম-ভালোবাসার কবল থেকে হেফাজত করেন। আমীন।
মোবাইল ফোন ব্যবহার : বৈধতার সীমা কতটুকু ? বই থেকে সংগৃহীত