
এবং হিমু যখন প্র্যাকটিসিং মুসলমান (পর্ব-১)
রাত দুইটা … আমার কাছে তেমন কোণ রাত না… বলা যেতে পারে রাতের শুরু। The night has only started .. কিন্তু ঢাকা শহরের মানুষগুলি আমার মতো না। রাত দুইটা তাদের কাছে অনেক রাত। বেশির ভাগ মানুষই শুয়ে পড়েছে। যাদের সামণে SSC HSC পরীক্ষা তারা বই সামণে নিয়ে ঝিমুচ্ছে। আর কিছু যুবক যুবতি কম্পিউটারের দিকে দুই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ফেইসবুকিং করছে।
আমি হাঁটছি । বলা যেতে পারে একরকম হন হন করেই হাঁটছি। গভীর রাতে সবাই অজান্তেই দ্রুত হাটে, পশুদের ব্যপারটা ভিন্ন। তারা হাঁটে মন্থর গতিতে। তবে আমার এই হন হন করে হাঁটার পেছনে বিশেষ কারণ আছে। নবিজি (সাঁ) তাহাজ্জুত নামাযে নাকি এক রাকাতে দাঁড়িয়ে এতো বড় তেলাওয়াত করতেন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতেন। আজকে আমিও তাই চেষ্টা করতে গিয়েছিলাম। বড় সুরা গুলো এখনও ভালো মতো আয়ত্ব করতে পারি নি। আমার মুখস্ত আছে ৯১ নম্বর সুরা থেকে শুরু করে ১১৪ নম্বর সুরা পর্যন্ত। এই সুরা গুলো দিয়েই মাসজিদের বারান্দায় নামায শুরু করেছিলাম ।
টার্গেট ছিল এতো ধীরে এবং কন্সান্ট্রেশন দিয়ে আজকে দুই রাকাত তাহাজ্জুদের নামায আদায় করবো যাতে মিনিমাম এক ঘণ্টা সময় লাগে। আমি যখন নামায শুরু করেছিলাম তখন রাত একটা চল্লিশ। বেশ ধীর গতিতে নামায শেষ করে মাসজিদের বারান্দায় খাঁচায় তালা বদ্ধ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুইটা বাজে মাত্র। এতো ধীরে পরেও সময় লাগলো মাত্র বিশ মিনিট। ঠিক তখন বুঝতে পারলাম আমার খিদে পেয়েছে। প্রচণ্ড খিদে । আমি বেড়িয়ে পরলাম। কিছু রেস্টুরেন্ট এখনো খোলা। কড়া কড়া ভাত , টক হয়ে যাওয়া বিরিয়ানি হয়তোবা পাওয়া যাবে। তবে খেতে হবে নগদ পয়সায়। নিশিরাতে খদ্দেরকে কোন হোটেলওয়ালা বিনা পয়সায় খাওয়া য় না। আমার সমস্যাটা হচ্ছে আমার গায়ে যেই জোব্বাটা আছে তাতে কোন পকেট ণেই। পকেট হীন এই জোব্বা রুপার বাবা কিনে দিয়েছে। বেশ বাহারি জিনিস । গোল গলা , গলার কাছে সূক্ষ্ম সূতোর কাজ। সমস্যা একটাই পকেট ণেই। জোব্বাটার এই ত্রুটির দিকে রুপার বাবার দৃষ্টি আকর্ষন করাতেই তিনি বললেন। পকেটের তোমার দরকার কি?
মুরুব্বিদের প্রায় সব যুক্তিই আমার কাছে খুব কঠিন যুক্তি বলে মনে হয়। কাজেই আমিও বললাম তাই তো পকেটের দরকার কি!
রুপার বাবা তীর্যক হেসে বললো তুমিতো নবী(সাঁ) এবং সাহাবিদের সেই প্রাচীন জামানার ইসলাম পালন করতে চাও? তা তারা যে জোব্বা পড়তো তাতে কি পকেট থাকতো।
রুপার বাবা কথাটা বলেছেন বিদ্রূপের শুরে কিন্তু ব্যপারটা সত্যিই আমি জানি না… আসলেই তো? নবিজি (সাঁ) এবং সাহাবিরা যেই পোশাক পড়তেন তাতে কি আমাদের মতো এই রকম পকেটের ব্যবস্থা ছিলো? আমি মুরুব্বির কথার বিপরীতে কিছু বললাম না । শুধু চোখে এর উত্তর জানিনা টাইপ ভাব এনে ক্যাবলা মারকা হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম যে পকেট না থাকলেও জোব্বাটা আমার মনে ধরেছে। আমি খুশি খুশি পকেট ছাড়া জোব্বাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছি। তারপর মুরুব্বির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেছি। আর তারপর থেকেই না খেয়ে আছি।যখন পকেটে টাকা থাকে তখন নানা ধরনের বন্ধু বাঁধবের সঙ্গে দেখা হয় । তারা চা খাওয়াতে চায় সিঙ্গারা খাওয়াতে চায়।আজ যেহেতু পকেট ণেই। কাজেই পরিচিত কারও সাথে দেখাও হয় নি। বুঝতে পারছি আল্লাহর পরীক্ষা। ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্যশীলদের আল্লাহ পছন্দ করেন।
আমি এখন অবশ্য বড় ফুপার বাসায় যেতে পারি। রাত শোয়া দুইটার দিকে কলিংবেল টিপে তাদের ঘুম ভাঙ্গালে কি নাটক হবে তা আগে ভাগে বলা মুশকিল। বড় ফুপা তার বাড়িতে আমার যাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন । কাজেই আমাকে দেখে তিনি খুব আনন্দিত হবেণ এরকম মনে করার কোনই কারণ ণেই। সম্ভাবনা শতকরা ষাট ভাগ যে তিনি বাড়ির দরজা খুললেও গ্রিল খুলবেণ না। গ্রিলের আড়াল থেকে হুংকার দেবেন গেট আউট। গেট আউট। পাচ মিনিটের মধ্যে আউট হও না হয় বন্দুক বের করবো। বন্দুক বের করা তার কথার কথা না । ঢাকার এডিশনাল আই জি তার বন্ধু মানুষ তাকে দিয়ে তিনি সাম্প্রতিক বন্ধুকের একটা লাইসেন্স করিয়েছেন এবং একটা টু টু ব্যারেলের রাইফেল কিনেছেন। সেই রাইফেল তার এখনও ব্যবহার করার সুযোগ হয় নি। তিনি বেশ আগ্রহ নিয়েই সুযোগ্যার অপেক্ষায় আছেন।
বাকি থাকে সুরমা ফুপু। ‘সূর্যের চেয়ে বালি গরম’ এর মতো , বড় ফুপুর চেয়ে তিনি বেশি গরম। ঢাকার এডিশনাল আইজির সাথে তার বন্ধুত্ব থাকলে তিনি একটা মেশিন গানের লাইসেন্স নিয়ে ফেলতেন।
তবে ভরসার কথা আজ বৃহস্পতি বার । দেওয়ান বাগির মুরিদ বড় ফুপা বৃহস্পতিবার রাতে আয়োজন করে খানিক জিকির আজগার করেন। খুব আগ্রহ নিয়ে করেন। কিন্তু ডাক্তারের দেয়া পাওয়ার ফুল ঘুমের ঔষধের কারণে প্রায়ই অল্প কিছু পর ঝিমিয়ে পরেন। বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে তখন বিড় বিড় করে জিকির বাদ দিয়ে হিন্দি কাওয়ালি গানের সুর ধরেণ।
এতো রাতে কলিংবেলের শব্দ শুনলে তারা কেউ দরজা খুলতে আসবে না … আসবে বাদল এবং সে একবার দরজা খুলে আমাকে ঢুকিয়ে ফেললে আর কোন সমস্যা হবার কথা না।
বড় ফুপার বাড়ির কাছা কাছি এসে টহল পুলিশের মুখোমুখি হয়ে গেলাম। তারা দলে চারজন। আগে দুজন দুজন করে টহলে বেরুতো। ইদানীং বোধ হয় দুজন করে বের হতে সাহস পাচ্ছে না … চার জন করে বের হচ্ছে। আমাকে দেখেই তারা থমকে দাড়ালো এবং এমন ভঙ্গি করলো জেনো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টেরোরিস্ট পাওয়া গেছে । দলের একজন (সম্ভবত সবচেয়ে ভিতুজন , কারণ ভিতুরাই বেশি কথা বলে) চেঁচিয়ে বলল, কে যায়? পরিচয়?
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম এবং অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, আসসালামু আলাইকুম। আমি হিমু। আপনারা কেমন আছেণ? ভালো?
পুলিশের পুরো দলটাই হকচকিয়ে গেলো। খাকি পোশাক পরা মানুষদের সমস্যা হচ্ছে, কুশল জিজ্ঞেস করলেই এরা ভোরকে যায়। যে কোন ভড়কে যাওয়া প্রাণীর চেষ্টা থাকে অন্যকে ভরকে দেয়ার। কাজেই পুলিশদের একজন আমার দিকে রাইফেল বাগিয়ে ধরে কর্কশ গলায় বলল, পকেটে কি?
আমি আগের চেয়ে বিনয়ী গলায় বললাম, আমার পকেটই ণেই।
ফাজলামি করিস? হারাম জাদা ! থাবড়া দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো।
দাঁত ফেলতে চান ফেলবেণ । পুলিশ এবং ডেন্টিস্ট এরা দাঁত ফেলবে না তো কে ফেলবে। তবে দাঁত ফেলার আগে দয়া করে একটু পরীক্ষা করে দেখুন সত্যিই পকেট ণেই।
একজন পরীক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলো। সারা শরীর হাতাপিতা করে বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গীদের বলল। ওস্তাদ আসলেই পকেট ণেই।
যাকে ওস্তাদ বলা হচ্ছে সে সম্ভবত দলের প্রধান এবং সবচে জ্ঞ্যানী।সে বললঃ এইটা তো রিজেক্টেড জোব্বা। এই বেকুব সস্তায় কিনে পকেট ছাড়া জোব্বা পরে ঘুরতেসে। এই চল থানায় চল।
আমি তৎক্ষণাত বললাম জ্বি চলুন। আপনারা কোন থানার আন্ডারে রমনা থানা?
পুলিশের দলটা পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেলো। থানায় যাবার ব্যপারে আমার মতো আগ্রহী কোন টেরোরিস্ট তারা বধহয় খুব বেশি পায় না।
কি নাম বললি?
হিমু।
যাস কই?
ভাত খেতে যাই।
রাত দুইটায় ভাত খেতে যাস?
ভাত সব সময় খাওয়া যায়।
ওস্তাদ যাকে বলা হচ্ছে সেই ওস্তাদ এগিয়ে আসছে। পেছন থেকে একজন বলল, ওস্তাদ, বাদ দেন। পীর ফকিরের মুরিদ মনে হয়। দুটা থাবড়া দিয়ে চলে আসেন।
ওস্তাদের মনে হয় সেই রকমই ইচ্ছা। বলে কিক মারার আনন্দ আর গালে থাবড়া মারার আনন্দ প্রায় কাছাকাছি। টহল পুলিশের ওস্তাদ এই অনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে কেন?
জোরালো একটা থাবড়া খেলাম। চোখে অন্ধকার দেখার মতো থাবড়া। মাথা ঝিম ঝিম করে উঠলো । ‘আল্লাহু আঁকবার’ বলে চিৎকার দিতে গিয়েও দিলাম না। এদেরকে আর ভরকে দিয়ে লাভ ণেই। ওস্তাদ থাবড়া দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। আমি আন্তরিক ভাবে বললাম আরেকটা থাবড়া দিয়ে যান , শুনসি এক থাবড়ায় খালে পরার সম্ভাবনা … যদিও ইসলামে এইসব কথার ভিত্তি নাই। তারপরও একটা যখন দিয়েছেন আরেকটাও কষ্ট করে দিয়েই যান।আধুরা কাজ রাখবেণ কেনো।
পুলিশের দল থেকে একজন বলল ওস্তাদ , চলে আসেন।
স্পষ্টতই ওরা ঘাবড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ঘাবড়ে গেছেন ওস্তাদ। আমি বললাম নিরীহ মানুষকে চড় থাপ্পড় দিয়ে চলে যাবেন এটা কেমন কথা।
ওস্তাদ দলের কাছে চলে যাচ্ছে। আমিও যাচ্ছি তার পেছনে পেছনে। যদিও উল্টো দিকে যাওয়াই নিয়ম। পুলিশের দল জেনো কিছু হয় নি এই ভঙ্গিতে হাঁটা শুরু করেছে। আমি ওদের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব রেখে হাটছি। তারা আমার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রাস্তা ক্রস করলো। আমিও রাস্তা ক্রস করলাম।
এই , তুই চাস কি?
আমি আন্তরিক ভঙ্গিতে বললাম, আরেকটা থাপ্পড় দিয়ে দিন বাসায় চলে যাই। পুলিশের দল কিছু না বলে আবার হাঁটা শুরু করেছে। আমিও তাদের অনুসরণ করছি। মানুষের ভয় চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে, এদেরও বাড়ছে। চারজন পুলিশ , দুজনের হাতে রাইফেল। অথচ ওরা এখন আতংকে আধমরা। আমার মজাই লাগছে। আমি একটা আরবি শুরেলা নাসিদ মনে করার চেষ্টা করলাম । মনে আসছে না। ক্ষুধার্ত অবস্থায় নাসিদ টাসিদ মাথায় আসতে চায় না। তবু চেষ্টা করে যাচ্ছি। আরবি একটা নাসিদ আমি ভালোই গাইতে পারি। জুন্দুল্লাহ।
নাসিদে টান দেবার কারণে খিধে মনে হয় একটু কমেছে। বড় ফুপার বাড়ি দেখা যাচ্ছে। পুলিশের দল হুট করে একটা গলিতে ঢুকে পরল।
আমি প্রায় দৌড়ে গলির মুখে গিয়ে বললাম, ভাইজান, আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে। ফির মিলেঙ্গে। এরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে । আমার সামান্য বাক্য দুটির মর্মার্থ নিয়ে তারা চিন্তা ভাবনা করবে। আজকের রাতের টহল তাদের ভালো হবে না । আজ তারা ভয় পাবে।
(চলবে ইন শা আল্লাহ … )
লেখক- আলী আব্দুল্লাহ ভাই