
নাস্তিকতা যখন ফ্যাশন!!
মাঝে মধ্যেই আমার আমুসলিম বন্ধুদের সাথে ধর্ম, ঈশ্বর, পরকাল – এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা, তর্কবিতর্ক হয়। তো একদিন আমি বেদের মধ্যে একেশ্বরবাদের ধারণাটা এক অমুসলিম বন্ধুর কাছে তুলে ধরলাম। সাথে সাথেই সে বলে উঠলো, ‘আমি নাস্তিক, ঈশ্বর-টিশ্বরে বিশ্বাস করি না। সুতরাং এইসব রিলিজিয়াস বিষয়গুলোতে আমি মোটেই ইন্টারেস্টেড না’। বলেই কেটে পড়লো সে।
আসলে অনেকসময় হয় কি, যে অনেকে মুখে হয়তো নিজেদেরকে “atheist” বলে ক্লেইম করে, কিন্তু নিজেদের অজান্তেই অন্তরে ভগবান-ঈশ্বর এইগুলোতে ঠিকই বিশ্বাস করে। বিশেষ করে যখন কেউ কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয় তখন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আবার অনেকসময় অনেকে জেনেবুঝেই এরকমটা বলে শুধু শুধু নিজেদেরকে আধুনিক-লিবেরাল প্রমাণ করতে। কিংবা বলা চলে এটা এযুগের একধরনের ফ্যাশন বা হুজুগ!
তবে আমার মনে হয় এই হুজুগে না পড়ে একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলেই জিনিসটা একেবারে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত যে, এই সুবিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আপনা আপনি সৃষ্টি হতে পারে না, নিশ্চয় এগুলোর কোনো স্রষ্টা রয়েছেন। নিশ্চয় এগুলোকে কেউ একজন চারাগাছে প্রতিদিন জল দেওয়ার মতন আগলে রেখেছেন। নাহলে সবকিছু এতো সুন্দরভাবে, এতো সিস্টেমিক ওয়েতে চলছে কি করে? এতো orderly, organised ভাবে? কোথাও একটুও কোনো ভুল-চুক নেই, এদিক-ওদিক নেই, সবাই যেনো বাঁধাধরা নিয়ম মেনে কাজ করে চলেছে, কে যেনো ওদের বলে দিচ্ছে এটা এরকম কর, ওটা ওরকম কর! ওরা তো নিজেদের মন-মর্জি মতো চলতে পারতো, কোনো নিয়ম না মেনেই!
যেমন সবচেয়ে সহজ একটা উদাহরণ দিই। সালোকসংশ্লেষের নামটা আশাকরি আমরা সকলেই শুনেছি। কিন্তু এটা যে কতো জটিল একটা প্রক্রিয়া সেটা আমরা কজন জানি? সূর্যের আলো থেকে ফোটন কণা পড়লো ক্লোরোফিলের উপর, সাথে সাথেই সেখান থেকে একটা ইলেকট্রন বেরিয়ে গেলো, তারপর ইলেকট্রনটা লাফাতে থাকলো এর ঘাড় থেকে ওর ঘাড়ে। এই লম্ফঝম্প থেকে তৈরি হলো এটিপি, সেখান থেকে আবার জটিল এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়ে গেলো গ্লুকোজ! অবশ্য এর মাঝে আরো অনেক গল্প আছে, আমি অতো কিছু বললাম না। আচ্ছা এতো কিছু হয়ে গেলো নিজে নিজে? কারো কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না, কোনো প্ল্যানিং ছিলো না, সবাই কেবল অপ্রত্যাশিতভাবে ইচ্ছে-হলো-তাই কাকতালীয়ভাবে কাজগুলো করে গেলো? না এগুলোকে কেউ একজন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করাচ্ছেন?
আচ্ছা, ওই ফোটনের কোনোদিন মনে হয়না যে, আজ ক্লোরফিলের বাড়িতে যাবোনা? কেনো যাবো প্রতিদিন, আমার কি কোনো লাজ-লজ্জা নেই? কিংবা ইলেকট্রন যদি বলে, ফোটন আসবে আসুক, আমি কিন্তু আজ নিজের জায়গা ছাড়ছি না। তারপর আবার এর ঘাড় থেকে ওর ঘাড়ে লাফিয়ে বেড়াও, আমার কি কোনো কাজ নেই? আচ্ছা ইলেকট্রন নাহয় লাফালো, কিন্তু এরকমটা কোনোদিন হয়না যে, যার ঘাড়ে ওর পড়ার কথা ছিলো সে শয়তানি করে সরে পড়লো, ব্যস বেচারা ইলেকট্রন আছড়ে পড়লো মাটিতে? এরপর তো আবার গ্লুকোজ তৈরি হওয়ার পালা, সে-ও তো আরেক কান্ড! ৬টা কার্বন, ১২টা হাইড্রোজেন, আর ৬টা অক্সিজেন মিলে এর-ওর হাতে হাত ধরে বন্ড তৈরি করো, সেটাও আবার নিজের ইচ্ছে মতো নয়, আকারটা যেনো ষড়ভুজাকার হয়, আরো কতো জটিল সব কায়দা-কানুন! আচ্ছা কার্বনের সাথে হাইড্রোজেনের কোনোদিন ঝগড়া হয় না? কিংবা হাইড্রোজেনের সাথে অক্সিজেনের? এতোদিন একসাথে ঘর-সংসার করলে তো হতেই পারে। কার্বন যদি হঠাত করে বলে বসে, আমি আর হাইড্রোজেনের সাথে বন্ড-ফন্ড করতে পারবোনা, আমি একাই থাকবো, তখন? না, কিন্তু এরকমটা তো কখোনো হয়না!
আচ্ছা, ওরা তাহলে এতো নিয়ম-কানুন মেনে চলতে শিখলো কিভাবে? তাছাড়া এই নিয়ম-কানুনগুলো কি ওরাই তৈরি করলো? না এর পেছনে কেউ একজন আছেন, যিনি নিজের প্ল্যান মোতাবিক সবকিছু করাচ্ছেন? তিনিই সবাইকে এক-একটা কাজ দিয়েছেন, যেটা সকলে টুঁ শব্দ না করে যার যেরকমটা করা উচিত ঠিক সেইভাবেই করে যাচ্ছে?
যাকগে, তো এই ফটোসিন্থেসিসের ব্যাপারটা তো সবচেয়ে পাতি একটা উদাহরণ। সারা ব্রহ্মাণ্ডে এরকম হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ জটিল সব প্রক্রিয়া রয়েছে, যেগুলো প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম-কানুন মেনে। সেটা ক্ষুদ্র একটি কোষের মধ্যে ডিএনএর রেপ্লিকেশান বা ট্রান্সলেশান হোক, কিংবা একটি পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনের ঘূর্ণন হোক, কিংবা হোক এই সুবিশাল আকাশগঙ্গায় লক্ষ-কোটি গ্রহ-নক্ষত্রের আবর্তন! সবগুলোই কি শুধু একটা কো-ইন্সিডেন্স মাত্র? নিজে নিজে ঘটে যাওয়া খামখেয়ালিপনা?
আশাকরি আমরা যারা একটু বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, আমরা একটু ঠান্ডা মাথায় এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কিছুটা চিন্তা-ভাবনা করলে আমাদের ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধে হবে না।
আমার এই মুহূর্তে কুরআনের একটি আয়াতের কথা মনে পড়ছেঃ
“নিশ্চয় নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্যে। যারা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় ঈশ্বরকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টির বিষয়ে, (আর তারা বলে) হে আমাদের প্রতিপালক! সৃষ্টিজগতের কোনোকিছুই তুমি অনর্থক সৃষ্টি করোনি।” (কুরআন ৩:১৯০-১৯১)