
তাগুতের অর্থ এবং কুফর, বিচারব্যবস্থা ও সরকারের সাথে এর সম্পর্ক
তাগুতের অর্থ এবং কুফর , বিচারব্যবস্থা ও সরকারের সাথে এর সম্পর্ক
-আবু খাদিজা আব্দুল ওয়াহিদ
পূর্ববর্তী উলামাদের মতে তাগুতের অর্থ এবং এটা সব সময় কুফরকে বুঝায় এমন নয়
কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় তাগুত[১] শব্দটির উল্লেখ রয়েছে । কিছু চরমপন্থী ধর্মপ্রচারকারী এর অর্থকে বিকৃত করে কাফির ও মুশরিকদের বুঝিয়ে থাকে । অনেক বড় বড় উলামাদের কেউ কেউ তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন যে , যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা দ্বারা বিচার করে না তারা তাগুত । তারা (চরমপন্থী ধর্মপ্রচারক) এ থেকে এ সিদ্বান্ত দেয় যে , সুতরাং সকল বিচারকই (সরকার) কাফির ।
কিন্তু বাস্তবতা হল , তাগুত শব্দটি একজন কাফিরকেও বুঝাতে পারে আবার মুসলিমদের মধ্যে থেকে বিভ্রান্ত নেতাদেরও বুঝাতে পারে । এই বিষয়টি আমি পূর্ববর্তী বড় বড় উলামাদের থেকে প্রমাণ করবো । ইমাম আল জাওহিরি আস-সিহাহ তে বলেনঃ
“ আত-তাগুতঃ গণক , শয়তান এবং সকল বিভ্রান্ত নেতা ” [২]
আরবী ভাষার অনেক বড় শ্রদ্ধেয় আলেম , ইবন মানসুর বলেনঃ
“ আত-তাগুতঃ আল্লাহ আজজা অজজাল ব্যতীত অন্যান্য যেসবের ইবাদাত করা হয় এবং প্রতিটি বিভান্ত নেতা হল তাগুত ” [৩]
তিনি আরো বলেনঃ
“ আবু ইসহাক বলেছেনঃ আল্লাহ আজজা অজজাল ব্যতীত যেসবের ইবাদত করা হয়
সেগুলো সবাই জাদুকর এবং তাগুত । এখানে বলা হচ্ছে , ‘[আল্লাহ ছাড়া যেসব
কিছুর ইবাদাত করা হয়:] জাদুকর , তাগুত , গণক এবং প্রত্যেক বিভ্রান্ত নেতা….’
আশ-শা’বি , আ’তা ও মুজাহিদ সবাই বলেছেনঃ ‘ জাদুকর । তাগুত হলঃ শয়তান ,
গণক এবং প্রত্যেক বিভ্রান্ত নেতা’ ” [৪]
ইমাম মালিক (মৃত্যু ১৭৯ হি. , রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ
“ আত-তাগুতঃ আল্লাহ ব্যতীত যেসকল কিছুর ইবাদাত করা হয় ” [৫]
ইবন আল-জাওযী বলেছেনঃ
“ ‘তাগুত’ শব্দটি তুগইয়ান থেকে এসেছে এবং এটা বলতে এমন কিছুকে বুঝায় , যা
তার নির্ধারিত সীমাকে অতিক্রম করেছে;” [৬]
আল্লাহর এই বাণীঃ
“এবং আমরা প্রতিটি জাতির কাছে রাসূল প্রেরণ করেছি যেন তারা আল্লাহর ইবাদাত করে এবং তাগুতকে বর্জন করে ”, বিখ্যাত তাফসীরকারক আল কুরতুবী বলেন ,
“ অর্থঃ আল্লাহ যারা যেসকল কিছুর ইবাদাত করা হয় যেমন- শয়তান , গণক ,
মূর্তি এবং সবকিছু যা বিভ্রান্তির দিকে ডাকে তাদের সবাইকে বর্জন কর ” [৭]
এবং ইমাম আশ-শাওকানী একই কথা বলেছেন তার তাফসীর , ফাতউল কাদীর এ । [৮]
রাসূল (স) এর সীরাতের বিখ্যাত লেখক ইবন হিশাম বলেন,
“ আত-তাগুতঃ যা সত্যের পথ থেকে বিভ্রান্ত করে তার সবই ” [৯]
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া(মৃত্যু ৭২৮ , রহিমাহুল্লাহ) তাগুত সম্পর্কে বলেন,
“ এটা একটা সাধারণ শব্দ যার অন্তর্গত হলঃ শায়তান , মূর্তি , গণক , দিরহাম ,
দিনার (বিনিময়ের মাধ্যম) এবং অন্যান্য ” [১০]
শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালিহ বিন উসাইমিন (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ
“ ইবন কাইয়্যুম এটা(আত-তাগুত) সম্পর্কে যা যা বলা হয়েছে তা একসাথে
করেছেন। যা হলঃ এমন কিছু , কোনো বান্দা যাকে নিয়ে (দাসত্বের) সীমা
অতিক্রম করেছে; হতে পারে তা কোনো উপাস্য অথবা অনুসৃত ব্যক্তি অথবা
আনুগত্যকৃত সত্তা। ” [১১]
শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব এর মতে তাগুতের অর্থ
এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে বর্তমান সময়ের চরমপন্থীরা শাইখ মুহাম্মাহ ইবন আব্দুল ওয়াহাব (রহিমাহুল্লাহ) এর কথাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে তাদের যুক্তিকে প্রমাণের জন্য । তিনি এমন একজন উলামা ছিলেন যিনি সর্বদা মুসলিম সরকারকে তাকফীর করা এবং তাদের অবাধ্য হওয়ার থেকে সতর্ক করেছেন , এমনকি যদিও খুবই অবিচারক , অত্যাচারী খারাপ শাসক হোক না কেন , যা তিনি আল কাসিমের লোকদের কাছে তার চিঠি , আর রিসালাহ ইলা আহলিল-কাসিম [১২] এ বলেছেন ।
আত তাগুত সম্পর্কে শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহাব বলেনঃ
“ বস্তুত তাগুতের সংখ্যা অনেক। তবে এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে পাঁচটি:
(১) শয়তান (তার উপর আল্লাহর অভিশাপ নিপতিত হোক)।
(২) যার উপাসনা করা হয় এবং সে উক্ত উপাসনায় সম্মত।
(৩) যে নিজের উপাসনার দিকে মানুষদের আহ্বান জানায়।
(৪) যে ব্যক্তি গায়েবী জ্ঞান আছে বলে দাবী করে।
(৫) যে ব্যক্তি আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত বিচার ফয়সালা করে।
এর প্র্রমাণ আল্লাহর বাণী,
“দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো প্রকার জবরদস্তি বা বল প্রয়োগ নেই, নিশ্চয় হেদায়াত থেকে বিভ্রান্তি স্পষ্টরূপে পৃথক হয়ে গেছে। তাই যে ব্যক্তি “তাগুতকে” অমান্য করল এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনল, নিশ্চয় সে এমন একটি সুদৃঢ় বন্ধন বা অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরল যা কোনো দিন ছিন্ন হবার নয়। বস্তুত আল্লাহ হচ্ছেন সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।” (সূরা আল-বাকারাহ, ২৫৬)
আর এটাই হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর অর্থ ও তাৎপর্য। [১৩]
সুতরাং কেউ কেউ এ থেকে ভাবতে পারেন যে , যে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত বিচার ফয়সালা করে তাকে শাইখ কাফির বলেছেন । কিন্তু তা নয় । এর কারণ দুটিঃ প্রথমত , আব্দুল বার একটি ইজমা বর্ণনা করেছেন যে , আল্লাহর বিধান ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা বিচার করা ছোট কুফর যা ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয় না ( আত তাহমিদ- আব্দুল বার , ৫/৭৪-৭৫)। দ্বিতীয়ত , আত-তাগুত বড় কুফরকে নির্দেশ করে না , যা শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের উক্তি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়ঃ
“ বস্তুত তাগুতের সংখ্যা অনেক। তবে এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে পাঁচটি:
(১) প্রথম হল শয়তান ।
(২) অত্যাচারী শাসক ।
(৩) যে ঘুষ নেয় ।
(৪) যার উপাসনা করা হয় এবং সে উক্ত উপাসনায় সম্মত।
(৫) যে ব্যক্তি জ্ঞান অনুযায়ী আমল করে না ” [১৪]
সুতরাং তার মতে মূল তাগুত হলঃ অত্যাচারী শাসক , যে ঘুষ নেয় এবং যে জ্ঞান অনুযায়ী আমল করে না – এই বিষয়গুলো ছোট কুফরের (আল-কুফর আল-আসগর) অন্তর্ভুক্ত । প্রকৃতপক্ষে এটা উলামাদের ইজমা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে , যে ঘুষ নেয় সে কাফির নয় , যতক্ষণ না সে এটাকে হালাল মনে করে । সুতরাং এটা পরিষ্কার যে শাইখ এবং তার পূর্ববর্তী আলেমগণ তাগুত শব্দকে শুধুমাত্র কাফিরদের জন্যই নির্দিষ্ট করেন নি , বরং শব্দটি সেসকল মুসলিমদের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে যারা পাপী বা অত্যাচারী অথবা যারা জ্ঞান অনুযায়ী আমল করে না বা যে বিভ্রান্ত এবং অন্যকেও বিভ্রান্ত করে যেমন খারেজীদের আদর্শিক নেতা ।
এ থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে , কাফির , বিভ্রান্ত ও বিদাতি নেতা – এ সবই তাগুতের অন্তর্ভুক্ত । সুতরাং এটা কখনোই জায়েজ হবে না যে , এত স্পষ্টভাবে প্রমাণের পরও শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহাবের তাগুত নিয়ে উক্তিগুলো তুলে ধরে তার নামে বলা যে তিনি অত্যাচারী শাসক এবং যারা আল্লাহর বিধান দ্বারা যারা বিচার করে না তাদেরকে কাফির বলেছেন । এবং আব্দুল ওয়াহাবের ক্ষেত্রে যা বললাম তা অন্যান্য উলামাদের কথার ক্ষেত্রেও বলা যাবে ।
তথ্যসূত্র :
১। একবচনঃতাগুত, বহুবচনঃ তাওয়াগিত
২। দেখুন মুখতার আস-সিহাহ , প.২৬৫
৩। লিসান আল আরব , ৮/১৪৪
৪। লিসান আল আরব , ১৫/৯
৫। ইবন আবি হাতিম থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত , ২/৪৯৫,৩/৯৭৬
৬। যাদ আল-মাসির , ২/১২৫
৭। তাফসীর আল-কুরতুবী , ১০/১০৩
৮। ৩/১৬১
৯। আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ , ৩/১০০
১০। মাজমু আল ফাতাওয়া , ১৬/৫৬৫-৫৬৬
১১। আল-কওল আল মুফিদ , ১/১০-১২
১২। শারহ আক্বীদা আল ইমাম আল মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব , ব্যাখ্যা- শাইখ সালিহ আল ফাওযান – কিছুদিন আগে প্রকাশিত । ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে , The Aqeedah of Muhammad ibn Abdul Wahhab নামে । সুন্নাহ পাবলিশিং , মিসিগান , ইউএসএ এটি প্রকাশ করেছে ।
১৩। আদ দুরুর আস সানিইয়্যা , ১/১৩৬
১৪। আদ দুরুর আস-সানিইয়্যা , ১/১৩৭
ইংরেজী আর্টিকেল থেকে অনুবাদকৃত।
অনুবাদকরণে : ফাওযুল আহসান আবীর