
পূজারী ও পূজিত কতই না দূর্বল!
অনুগল্পঃ “পূজারী ও পূজিত কতই না দূর্বল!”
.
[এক]
.
গৌরাঙ্গ ও ফয়সাল দুজন একই ক্লাসে পড়ে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের হলেও দুজনের মধ্যে একটা জায়গায় মিল – দুজনেই যথাসাধ্য ধর্ম পালন করার চেষ্টা করে। ফয়সাল নিয়মিত সালাত আদায় করে, আর গৌরাঙ্গ নিয়ম করে দুবেলা মন্দিরে যায়। সামনে গৌরাঙ্গদের পূজো। সবচেয়ে বড় দেবীর পূজো। দেবীর নাম দূর্গা। এই দূর্গা ছাড়াও তাদের আরও দেবী আছে, যেমনঃ কালী, শরশ্বতী, লক্ষ্মী ইত্যাদি। তারা সাধারণত এই নারী দেবীগুলোর পূজাই ধুমধাম করে পালন করে।
.
ফয়সাল ভেবে পায় না, পূজো কেবল নারীর হবে কেনো? পুরুষরা কি দোষ করলো? ওদের ধর্মে তো অর্জুন, রাম, লক্ষণ, যুধিষ্ঠির, নারায়ণ, বিষ্ণু ইত্যাদি নামের পুরুষ দেবতাও আছে। কিন্তু ঐগুলোর পূজো তো এত ধূমধাম করে পালন করা হয় না? কেন? গৌরাঙ্গ সবসময় নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলে। কিন্তু পূজোর বেলায় কেবল নারী দেবীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। তাহলে এখানে তো নারী পুরুষের সমতা রক্ষা হলো না!
ফয়সালের মাথায় এইসব চিন্তা জট পাকিয়ে যায়। মনে মনে ভাবে গৌরাঙ্গকে একদিন জিজ্ঞেস করে এর উত্তর জেনে নেবে। অবশ্যি জিজ্ঞেস করার মত সুযোগ ফয়সালের আর হয়ে উঠে নি।
.
[দুই]
.
আজ নবমী। আজ বাদে কাল বিজয় দশমী। কাল গৌরাঙ্গদের দূর্গা মা’কে ডুবানো হবে। ডুবানোর পূর্বে গায়ের যত গয়না ছিলো সব খুলে ফেলা হবে। এরপর বাদ্য বাজাতে বাজাতে দেবীকে পানিতে ভাসিয়ে দেবে।
‘আচ্ছা! যে দেবতাকে পানিতে ডুবিয়ে ফেলা যায়, যার নিজ হাতে নিজেকে বাঁচানোর ক্ষমতা নেই, যে নড়াচড়া করতে অক্ষম; সে কী করে সবচেয়ে বড় ভগবানের আসনে বসে থাকে?’ ফয়সালের মনে এমন চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাত পেছন থেকে গৌরাঙ্গের আওয়াজ শোনা গেলো।
“কিরে ফয়সাল, কেমন আছিস?” গৌরাঙ্গ জিজ্ঞেস করলো।
“ভালো।” ফয়সাল জবাব দিলো।
– “কাল আমাদের বিজয় দশমী। আসবি কিন্তু?”
– “নারে, আসতে পারবো না।”
– “কেন। কোন সমস্যা?”
– “হ্যাঁ।”
– “কী।”
– “আমাদের ধর্মে নিষেধ আছে।”
– “আরে রাখ। উৎসবের বেলায় আবার ধর্ম কী-রে? উৎসব তো উৎসবই। জানিস না, ধর্ম যার যার উৎসব সবার।”
.
ফয়সাল কিছু বলতে যাবে এমন সময় আযানের শব্দ শোনা গেলো। আযান শেষ হলে ফয়সাল গৌরাঙ্গের হাতটা শক্ত করে ধরলো। এরপর তাঁকে মসজিদের আঙ্গিনায় নিয়ে গেলো। গৌরাঙ্গ চিৎকার করতে করতে বললো, “ছাড়, ছাড়। এ-কি করছিস?”
– “আজ কি বার জানিস?”
– “হুম জানি। শুক্রবার।”
– “আজ আমদের একটা উৎসবের দিন। শুক্রবার হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন। কেননা আমাদের নবীজী (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা মুসলামানদের জন্যে এই দিনটিকে ঈদের দিন বানিয়েছেন।” [১]
– “তো আমি কী করবো?”
– “বললাম না, আজ আমাদের উৎসবের দিন। তোকে এনেছি আমাদের উৎসবে যোগ দেয়ার জন্যে। আর হ্যাঁ, তুই কিন্তু না বলতে পারবি না।”
– “আমি তোদের উৎসবে কী করবো?”
– “কী করবি আবার? তুই আমাদের উৎসবে যোগ দিবি। এই না কিছুক্ষণ আগে বললি – ধর্ম যার যার উৎসব সবার।”
গৌরাঙ্গ কিছুটা হতভম্ব হয়ে বললো, “দেখ ফয়সাল এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!”
– “এতে বাড়াবাড়ির কী দেখলি?”
– “তোর আর আমার জাত আলাদা। আমি অন্য জাতের হয়ে তোদের উৎসবে যোগ গিতে পারি না। আর তুই ও আমাকে তোদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বলতে পারিস না। কেননা তোদের ধর্মে বলা আছে, ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন – যার যার ধর্ম তার তার’।”
ফয়সাল গৌরাঙ্গের হাত ছেড়ে দিলো। এরপর বললো, “এই কথাটা তোর কিছুক্ষণ আগে মনে ছিলো না?”
গৌরাঙ্গ ফয়সালের প্রশ্নের জবাব দিলো না।
.
[তিন]
.
বিজয় দশমী শেষ হলো। পরদিন সকালবেলা ফয়সাল নদীর ধারে হাঁটতে বের হলো। নদীর স্নিগ্ধ হাওয়ায় অবগাহন করার মজাই আলাদা। নদীটা আজ বড়ই অচেনা লাগছে। ফয়সাল জবুথবু হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলো। কাল যে দূর্গার মূর্তিগুলো পানিতে ডুবানো হয়েছে, আজ তা ভেসে উঠেছে। আর মূর্তিগুলোর চারিদিকে মাছি ভ্যান ভ্যান করছে। মূর্তিগুলোর এই অবস্থা দেখে ফয়সালের একটি আয়াতের কথা স্মরণ হলো।
“হে মানুষ! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে, সেটা মনোযোগ দিয়ে শোন। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজো করো, তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না। যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের নিকট হতে কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তবে তারা তার (মাছির) কাছ থেকে তা উদ্ধারও করতে পারবে না। পূজারী ও পূজিত কতই না দূর্বল!” [২]
আয়াতটি স্মরণ হতেই ফয়সাল মনে মনে বললো, “মহান আল্লাহ সত্য বলেছেন।”
.
.
তথসূত্রঃ
১) ইবনু মাযাহ, আস-সুনান, ১/৩৪৯, আলবানী, সহীহুত তারগীব, ১/১৭২।
২) সূরা আল-হাজ্জঃ ৭৩।