
একজন খ্রিস্টান মিশনারী ও আমাদের দাওয়াতের কথা
আধুনিক খ্রিস্টান মিশনারী ও চীনের খ্রিস্টান ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় নাম রবার্ট মরিসন। মানুষটি জন্ম গ্রহণ করেছেন বিলেতে ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে। ছোট বেলা থেকেই ধর্মের প্রতি ছিলেন গভীর অনুরাগী। এক পর্যায়ে নিজেকে খ্রিস্ট ধর্মের একজন মহান সেবক হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে তার দৃষ্টি পতিত হয় আফ্রিকার দিকে। কিন্তু এক পর্যায়ে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন বিশাল জনগোষ্ঠী আর প্রাচীন সভ্যতার দেশ চীনের দিকে। কতটা নিষ্ঠা, উৎসাহ আর দরদ ছিল মানুষটির মাঝে তা দেখা যায় নিজের এক বন্ধুকে একাজে অংশ নেয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে মরিসনের লেখা একটি চিঠিতে।
সেখানে তিনি লেখেন, ‘এই সুমহান মিশনে তোমাকে আমার সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার বড় সাধ ছিল। একটু চোখ দিয়ে দেখো না চীনের ৩৫০ মিলিয়ন মানুষকে। মহান ত্রাতা যিশু খ্রিস্টের পরিচয় লাভের কোনো পথ যাদের সামনে খোলা নেই’।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরে মরিসন মনোযোগী হন চীনা ভাষা শেখার প্রতি। নেমে পড়লেন বিশ্বের অন্যতম বরং সবচেয়ে কঠিন ও দুরূহ ভাষা শেখার দুঃসাহসিক অভিযাত্রায়। শিক্ষক হিসেবে বেছে নিলেন চীনের ক্যান্টন সিটি থেকে আসা নিজের এক রুমমেটকে। আর এভাবেই বন্ধুকে শিক্ষক বানিয়ে দিন রাত মেহনত করে ধীরে ধীরে শিখে নিলেন চীনা ভাষা।
১৮০৭ সালে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে চীন যাওয়ার লক্ষ্যে প্রথমে বিভিন্ন কারণে পাড়ি জমান আমেরিকা। সেখানে প্রায় একমাস অবস্থান করার পর পেয়ে যান চীনের জাহাজ। ১১৩ দিন সমুদ্রে ভেসে একসময় এই মহান মানুষটি এসে পৌঁছেন কাঙিক্ষত মনযিল চীনের মাকাও রাজ্যে। কিন্তু মাকাওতে উপস্থিত হওয়ার পর অনেকেই তাকে মিশনারী কাজ করতে বারণ করেন। কেউ কেউ মৃতুদণ্ডের আশংকার কথাও বলে দেন। পাশাপাশি এখানে থাকা যাবে না বলেও সতর্ক করে দেন। একটু মাথা গুঁজারও কোনো ঠাই পান না বিশাল সেই ভূখণ্ডে। অবশেষে এক ইংরেজ ভদ্রলোক তার জন্য নিজ বাড়িতে একটি রুম ছেড়ে দেন। কিছুদিন পর গিয়ে অন্য এক আমেরিকান ভদ্রলোকের ফ্যাক্টরীতে উঠেন বিলেতের ধনীর এই দুলাল।
এ পর্যায়ে চরম ভোগান্তি আর অগ্নিপরীক্ষায় পড়েন তিনি। সরকার ও প্রশাসনের ভয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় নিজ রুমে জীবন কাটাতে হচ্ছিল তার। চীনা গৃহপরিচারক তার সঙ্গে প্রতারণা করে চলে যায়। চীনা ভাষা শেখানোর জন্য স্থানীয়রা তার কাছে বিশাল অংক দাবি করে। একজন তাকে কয়েকটি চীনা বই কিনে দেয়, কিন্তু বিনিময়ে হাতিয়ে নেয় চড়া মূল্য। এক পর্যায়ে খরচের বোঝা হুহু করে তার ঘাড়ে চেপে বসতে থাকে। দু’চোখে নেমে আসে রাজ্যের অন্ধকার।
কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন না। ঘরের ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজ প্রভুর কাছে ফরিয়াদ জানাতে থাকেন অবিরাম যেন তিনি চীনা ভাষা শিখতে পারেন ও তার মিশনারী উদ্দেশ্যে সফল হন। খ্রিস্টান মিশনারীদের সর্বত্র অনসৃত পথ ধরে তিনি স্কুল নির্মাণ ও চিকিৎসা সেবার পথ ধরেন। এক পর্যায়ে সফলতাও ধরা দিতে থাকে তার কাছে।
রবার্ট মরিসন সুদীর্ঘ ২৭ বছর চীনে খ্রিস্টধর্মের প্রচার-প্রসারে নিয়জিত থাকেন। এই ২৭ বছরে মাত্র একবার ছুটিতে তিনি বৃটেনে গিয়েছিলেন। কিছুদিন থেকে আবার চীনে ফিরে আসেন। কর্মময় জীবনে তিনি পৃথিবীতে অক্ষয় স্মৃতিস্বরূপ রেখে যান ১২ বছর কঠিন অধ্যাবসায় ও মেহনতে করা বাইবেবেলের চাইনিজ অনুবাদ ও ১৭ বছরের পরিশ্রমের ফসল চাইনিজ-ইংরেজি অভিধান! এছাড়াও রচনা করেন চাইনিজ ভাষায় অসংখ্য গ্রন্থ।
জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি লিখেছিলেন, ‘১৮০৭ সালে ক্যান্টন শহরকে আমি যে অবস্থায় দেখেছিলাম আজকের ক্যান্টন তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে আজ চীনা বিদ্বানগণ আছেন, মিশনারী কাজে নিয়োজিত একদল কর্মী আছেন, প্রকাশ্যে ঈশ্বরের উপাসনা হচ্ছে। আমি আমার জাতির সেবা করতে পেরেছি। যখন আমি চিরনিদ্রায় শায়িত হবো তখন ঈশ্বর অবশ্যই এগুলো সম্পর্কে জ্ঞাত থাকবেন’।
১৮৩৪ সালে তিনি চীনে মৃত্যুবরণ করেন এবং চীর জীবনের জন্য জন্মভূমি ছেড়ে চীনের মাটিতেই শায়িত হন।
আহ! দীনের জন্য একজন মানুষ আর কতটা ত্যাগ করতে পারে! আমাদের সাহাবায়ে কিরাম রা. ও পরবর্তীতে সালফে সালেহীনের যুগের কুরবানীর এ যেন পুনরাবৃত্তি। বর্তমান যুগে এমন কিছু দাঈ যদি ইসলামে জন্ম নিতো, তবে আজও ইসলামের পুনর্জাগরণের প্রত্যাশায় মুসলিম জাতিকে সুদীর্ঘ প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে হতো না। চীনে আজ মুসলমানদের সংখ্যা ২ কোটি আর খ্রিস্টানদের সংখ্যা ৫ কোটি থাকতো না। অথচ চীনে ইসলাম এসেছে এশিয়া থেকে আর খ্রিস্টধর্ম এসেছে সুদূর ইউরোপের পশ্চিম প্রান্ত থেকে। আল্লাহ আমাদের এই মহান মানুষটির জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে ইসলামের জন্য নিজেদের সবকিছু কুরবানীর মানসিকতা তৈরি করে দিন। আমীন।
25.03.2018
Mizan Harun
Riyadh, Saudi Arabia
Source: Facebook.com