
একজন ঈমানদার দা‘ঈর বর্জিত গুণাবলি পর্ব ৬
১ম পর্ব ২য় পর্ব ৩য় পর্ব ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব
লেখক:মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম
লোভ-লালসা
লোভ-লালসার পরিচয় ও হুকুম
লোভ-লালসার আরবী প্রতিশব্দ হলো : হিরছ (حرص)। যার আভিধানিক অর্থ লোভ, লালসা, লিপ্সা, কামনা, প্রলোভন, কার্পণ্য ইত্যাদি।
পরিভাষায়,
কারো কোন জিনিস দেখে তা লাভের আশা করা যা মানুষকে সর্বদাই আল্লাহ্ বিমূখ করে দেয় এবং দুনিয়া মুখী করে দেয় তাই-ই হিরছ।
লোভ-লালসার হুকুম
হিরছ দুই প্রকার। একটি হলো সৎ উদ্দেশ্যে। যার মধ্যে খোদাদ্রোহী কোন বিষয় সম্পৃক্ত নয়। অপরটি হলো অসৎ উদ্দেশ্যে। যার মধ্যে দুনিয়াবী কার্যক্রমকে প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রথম প্রকারে হিরছ সর্বসম্মতক্রমে বৈধ। দ্বিতীয় প্রকারের হিরছ সর্বসম্মতিক্রমে হারাম।
লোভ-লালসা কারণ
হিরছের একমাত্র কারণ হলো মানুষর বড় হওয়ার প্রবল আকাঙ্খা করা। এখানে উল্লেখ্য যে, বড় হওয়া বলতে এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, যে জিনিসের অধিকার আমি নই বা যা আমার প্রাপ্য নয় তার আশা করাই হলো হিরছের প্রধান ও অন্যতম কারণ। এ ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য যে, বৈধ ভাবে মানুষ যদি বড় হতে চায় যেমন : কোন ছাত্র ইচ্ছা করলো সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে এটি তার জন্য হারাম নয়। মূলকথা হলো এমন কোন লোভ-লালসা করা যা আল্লাহর স্মরণ থেকে ব্যক্তিকে বিরত রাখে।
লোভ-লালসা পরিণতি
হাসান (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেন :
নিশ্চয়ই হিংসা-বিদ্বেষ নেকীসমূহকে নি:শেষ করে দেয়, যেমনিভাবে আগুন শুকনো কাঠকে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।৮০
রাসূল ﷺ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন : সাবধান শুনে নাও! আল্লাহর নিয়ামতেরও কিছু শত্রু রয়েছে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু কারা? রাসূল সা. বললেন : আল্লাহ্ স্বীয় অনুগ্রহে মানুষকে যে নিয়ামত দান করেছেন, তার কারণে মানুষকে যে হিংসা করে, সে আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু।
বিশ্ববিখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা আবু লাইস আস-সমরকন্দী রহ. বলেন : তিন ব্যক্তির দু‘আ কবুল হয় না।
এক. হারাম ভক্ষণকারীর দু‘আ,
দুই. বেশি গীবতকারীর,
তিন. হিংসুকের দু‘আ।
লোভ-লালসা থেকে বাঁচার উপায়
মানুষের একান্ত প্রয়োজনীয় বস্তুসমূহের মধ্যে অর্থসম্পদ অন্যতম। অর্থসম্পদ ব্যতীত মানুষের জীবনধারণ একেবারেই অসম্ভব। জীবন এবং সম্পদ একটি আরেকটির পরিপূরক। সম্পদ ছাড়া যেমন জীবনধারণ সম্ভব নয়, তেমনি প্রাণহীন ব্যক্তির জন্য অর্থেরও কোন মূল্য নেই। অর্থসম্পদ মূলত: আল্লাহ্ তৈরীই করেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য কিন্তু এ অর্থই আবার কখনও কখনও অনর্থের কারণ হয়ে থাকে। বিত্ত-বৈভব যেমন মানুষের প্রভূত কল্যাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে অনুরূপভাবে তা আবার মানুষের ক্ষতিকর কাজেও ব্যবহার হয়ে থাকে। এটি নির্ভর করে সম্পদের সঠিক ও অপব্যবহার এবং সুসম ও অসম বণ্টন ব্যবস্থার উপর। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সকল মতবাদ প্রচলিত আছে, তার সবগুলোই সম্পদ সঠিক ব্যবহার ও সুসম বণ্টনের মাধ্যমে সকল মানুষের সার্বিক কল্যাণে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। হিরছ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় দুটি। এক. হালাল পন্থায় উপার্জন করা দুই. হারাম পেশা ত্যাগ করা। নিম্নে এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হলো :
এক. হালাল পন্থায় উপার্জন করা
বৈধ পন্থায় উপার্জনের জন্য আমরা সর্বদা চেষ্টা-প্রচেষ্টা করি। কীভাবে আমরা আমাদের রিযিক বৈধ্য পন্থায় উপার্জন করতে পারি? কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য অন্যতম একটি শর্ত হলো বান্দাহর উপার্জন হালাল পন্থায় হওয়া। কেননা রিযিক যদি হালাল পন্থায় উপার্জিত না হয় তাহলে তার কোন দু‘আ-ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার দরবারে কবুল হয় না। আর আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনও হালাল রিযিকের খেয়ে জীবনধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা আল-কুর’আনে ঘোষণা করে বলেন :
“ আমি তোমাদের জন্য যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে পবিত্রতম বস্তু তোমরা ভক্ষণ কর।”
আর বৈধ পেশায় নিয়োজিত থেকে সম্পদ উপার্জনের জন্য পবিত্রতম ও হালাল বস্তুর খোঁজ করার নির্দেশও আল্লাহ্ তা‘আলা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
“হে মু’মিনগণ! জুমু‘আর দিনে যখন সালাতের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি কর। সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়ায়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও। যখন তোমরা দেখলে ব্যবসায় ও কৌতুক তখন তারা তোমাকে দাঁড়ান অবস্থায় রেখে উহার দিকে ছুটে গেল। বল: আল্লাহর নিকট যা আছে তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যবসায় অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ রিয্কদাতা।”৮১
এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, ইবনে উমর (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ﷺ) বলেছেন :
“পৃথিবী মিষ্ট ও শ্যামল। এখানে যে ব্যক্তি হালাল সম্পদ উপার্জন করবে এবং ন্যায়সংগত পথে তা ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যে ব্যক্তি হারাম সম্পদ উপার্জন করবে এবং তা অন্যায় পথে ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে অপমানজনক স্থানে নির্বাসিত করবেন। আর হারাম সম্পদ হস্তগতকারী ব্যক্তিরা কিয়ামতের দিন আগুনে জ্বলবে।”৮২
দুই. হারাম পন্থায় উপার্জন থেকে বিরত থাকা
পৃথিবীতে দু’ধরণের উপার্জন পরিলক্ষিত হয়। একটি হলো হালাল তথা বৈধ পন্থায় উপার্জন। আর অপরটি হলো হারাম তথা অবৈধ পন্থায় উপার্জন। মানবজীবনে এ অবৈধ পন্থায় উপার্জনকে কুর’আন ও হাদীসে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا.
“হে মু’মিনগণ! তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু।”৮৩
রাসূল (ﷺ) বলেছেন : “এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলিধুসরিত দেহ নিয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে “হে প্রভু! হে প্রভু! বলে মুনাজাত করে, অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারাই সে পুষ্টি অর্জন করে। তার মুনাজাত কিভাবে কবুল হবে?”৮৪
৮০. আবূ দাউদ
৮১. সূরা আল-জুমু‘আহ, ৯-১১
৮২. ইবনে হিব্বান, আস-সহীহ, (দারুল ফিকর, তা.বি.), খ. ১০, পৃ. ৩৭০, হাদীস নং-৪৫১২
৮৩. সূরা আন-নিসা, ২৯
৮৪. ইমাম মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ ইবনে মুসলিম, আস-সহীহ, (বৈরূত : দারুর যাইল, তা.বি.), খণ্ড ৩, পৃ. ৮৫, হাদীস নং-২৩৯৩