
আন্দালুস ব্যতীত পুরো বিশ্বই যিনি ভ্রমণ করেছেন!
আজ আমরা এমন একজন ইমামকে নিয়ে আলোচনা করবো যিনি একইসঙ্গে হাদীসের হাফিয, মুহাদ্দিস এবং একইসঙ্গে তিনি ফকীহ। তিনি হচ্ছেন হাফিয ইমাম ফযল ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুল মুসায়্যিব আল-বাইহাক্বী আশ-শা’রানী (২৮২ হি) রহিমাহুল্লাহ। হাফিযে হাদীসদের জীবনীগ্রন্থ ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ [১] ও ‘তাবাক্বাতুল হুফফায’- [২] এ তাঁর জীবনচরিত উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর প্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল জাওযী (৫০৮-৫৯৭ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
كان أديبا فقيها عابدا، كثير الرحلة في طلب الحديث، فهما عارفا بالرجال. سمع بمصر، والحجاز، والشام، والكوفة، والبصرة، وواسط، والجزيرة، وخراسان، وسأل يحيى بن معين عن الرجال، وسأل على بن المديني، وأحمد بن حنبل عن العلل وأخذ اللغة عن ابن الأعرابي، وقرأ القرآن على خلف بن هشام، وكان ثقة صدوقا.
“তিনি ছিলেন সাহিত্যিক, ফকীহ ও ইবাদাতগুজার। হাদীস অন্বেষণে তিনি প্রচুর সফর করেছেন। একজন বুদ্ধিমান মানুষ। রিজালশাস্ত্রে (হাদীসের বর্ণনাকারীদের বিধান পর্যালোচনা শাস্ত্র) তিনি অভিজ্ঞ ব্যক্তি। মিসর, হিজায, শাম, কূফা, বসরা, (ইরাকের) ওয়াসিত্ব, জাযীরা (জাযীরাতুল আরব বা আরব ভূখন্ড), খোরাসান প্রভৃতি অঞ্চলে তিনি (হাদীস) শ্রবণ করেছেন। ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন (১৫৮-২৩৩ হি – রহিমাহুল্লাহ) এর কাছে তিনি রিজালশাস্ত্র নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, আলী ইবনুল মাদীনী (১৬১-২৩৪ হি – রহিমাহুল্লাহ) এর উপরও প্রশ্ন রাখেন, আহমাদ ইবনু হাম্বাল (১৬৪-২৪১ হি – রহিমাহুল্লাহ) এর কাছে জানতে চান ই’লাল (হাদীসের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ত্রুটি নিয়ে আলোচিত শাস্ত্র) সম্পর্কে, ইবনুল ‘আরাবী (১৫০-২৩১ হি – রহিমাহুল্লাহ) হতে আরবী ভাষার দীক্ষা নেন এবং খালাফ ইবনু হিশাম (১৫০-২২৯ হি – রহিমাহুল্লাহ) এর কাছে তিনি কুরআন পাঠ করেন (ক্বিরাআত সম্পর্কে ধারণা নেন)। আর (হাদীসের ক্ষেত্রে) তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত, সত্যবাদী।” [৩]
ইতিহাসখ্যাত তাঁর কয়েকজন উস্তাদের নাম আমরা শুনলাম। এর বাইরেও বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি বড় বড় মুহাদ্দিসদের নিকট হাদীস শ্রবণ করেছেন। এর মধ্যে মিসরে হাফিয সাঈদ ইবনু আবী মারইয়াম (১৪৪-২২৪ হি) রহিমাহুল্লাহ, বসরায় ইমাম সুলাইমান ইবনু হার্ব (১৪০-২২৪ হি) রহিমাহুল্লাহ, কূফায় ইমাম আহমাদ ইবনু ইউনুস (১৩২-২২৭ হি) রহিমাহুল্লাহ, মদীনায় ইমাম ইসমাঈল ইবনু আবী উয়াইস (১৩৯-২২৬ হি) রহিমাহুল্লাহ এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ইমাম সুনাইদ ইবনু দাঊদ (২২৬ হি) রহিমাহুল্লাহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। [৪]
শুধু তাই নয়, তিনি এমন কিছু মহামূল্যবান গ্রন্থ চোখে দেখেছেন যা আজ পৃথিবীবাসীর চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছে। ইমাম যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
تَفَرَّدَ بِرِوَايَةِ كُتُبٍ لَمْ يَرْوِهَا أَحَدٌ بَعْدَهُ: (التَّارِيْخ الكَبِيْر) عَنْ أَحْمَدَ، وَ (التَّفْسِيْر) عَنْ سُنَيْدٍ، وَ (القِرَاءات) عَنْ خَلَفٍ، وَ (التَنْبِيْهِ) عَنْ يَحْيَى بنِ أَكْثَمَ، وَ (المَغَازِي) عَنْ إِبْرَاهِيْمَ الحِزَامِيِّ، وَ (الفِتَن) عَنْ نُعَيْمِ بنِ حَمَّادٍ
“তিনি এমন কিছু কিতাবের কথা এককভাবে বর্ণনা করেছেন, তাঁর পরবর্তীতে যা আর কেউই বর্ণনা করেননি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আহমাদ (১৬৪-২৪১ হি – রহিমাহুল্লাহ) হতে (তারীখুল কাবীর), (আত-তাফসীর) সুনাইদ (২২৬ হি – রহিমাহুল্লাহ) হতে, খালাফ (১৫০-২২৯ হি – রহিমাহুল্লাহ) হতে (আল-ক্বিরাআত), (আত-তানবীহ) ইয়াহইয়া ইবনু আকছাম (২৪২ হি – রহিমাহুল্লাহ) হতে, ইবরাহীম আল-হিযামী হতে (আল-মাগাযী) এবং (আল-ফিতান) নু’আইম ইবনু হাম্মাদ (২২৮ হি – রহিমাহুল্লাহ) হতে।” [৫]
ইমাম ইবনু কাছীর (৭০০-৭৭৪) রহিমাহুল্লাহ তাঁর সম্পর্কে বলেন,
تلميذ يحيى بْنِ مَعِينٍ، رَوَى عَنْهُ الْفَوَائِدَ فِي الْجَرْحِ وَالتَّعْدِيلِ وَغَيْرَ ذَلِكَ
“তিনি ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন (১৫৮-২৩৩ হি – রহিমাহুল্লাহ) এর ছাত্র। তাঁর কাছ থেকে তিনি ‘আল-ফাওয়ায়িদ ফীল জারহি ওয়াত তা’দীল’ এবং এর বাইরেও বহু বিষয় বর্ণনা করেছেন।” [৬]
উপরোল্লিখিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে আমাদের জানামতে বর্তমানে নু’আইম ইবনু হাম্মাদ রহিমাহুল্লাহর ‘আল-ফিতান’ গ্রন্থটিই শুধুমাত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
ইল্মের সকল স্রোত যেন এক ফোয়ারায় এসে মিলিত হয়েছে। ইল্মের সমুদ্রতুল্য এতো এতো আলিম আর ইল্মের বহরতুল্য এতো এতো কিতাবের দেখা তিনি কিভাবে পেলেন? ইমাম আবূ ইউসুফ (১১৩-১৮৫ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
الْعِلْمُ شَيْءٌ لَا يُعْطِيكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَهُ كُلَّكَ
“ইল্ম এমন বস্তু, যা তোমাকে তাঁর কানাকড়িও দিবে না, যতক্ষণ না তাঁকে তুমি তোমার পুরোটা দিবে।” [৭]
হ্যাঁ, এই ইল্ম পাওয়ার জন্য তাঁকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কষ্টের মধ্য দিয়েই বিন্দু বিন্দু জল জমে মহাসমুদ্র তৈরি হয়েছে। কী ছিলো সেই কষ্ট? তাঁর ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু মুয়াম্মাল মাসারজিসী (২৬১-৩৫০ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
كُنَّا نَقُوْل: مَا بَقِيَ فِي الدُّنْيَا مَدِيْنَةٌ لَمْ يَدْخُلْهَا الفَضْلُ فِي طَلَبِ الحَدِيْثِ، إِلاَّ الأَنْدَلُسَ
“আমরা বলাবলি করতাম- দুনিয়ার এমন কোনো শহর বাকী ছিলো না, হাদীসের সন্ধানে ফযল যাতে প্রবেশ করেননি, তবে আন্দালুস ব্যতীত।” [৮]
বর্তমান স্পেন ও পর্তুগালের বেশ কিছু অঞ্চল নিয়ে গড়ে ওঠা ভূখন্ডটিই তৎকালীন সময়ে আন্দালুস নামে পরিচিত ছিলো। [৯]
ইমাম ইবনুল ইমাদ আল-হাম্বলী (১০৩২-১০৮৯ হি) রহিমাহুল্লাহ তাঁর প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন,
طوّف الأقاليم
“তিনি দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন।” [১০]
পয়সাকড়ি ছাড়া তো আর সফর চলে না। প্রায় পুরো বিশ্বটাই যিনি চষে বেড়িয়েছেন, এ কাজে নিশ্চয়ই তাঁর অনেক পয়সাকড়ির দরকার পড়েছে? কোথায় পেলেন এতো পয়সাকড়ি। ইমাম যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হি) রহিমাহুল্লাহ তাঁর পরিচয়পর্ব যেখান হতে শুরু করেছেন সেখান হতে যদি আমরা পড়ে আসি তাহলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। তিনি বলেন,
الإِمَامُ، الحَافِظُ، المُحَدِّثُ، الجَوَّالُ، المُكْثِرُ، أَبُو مُحَمَّدٍ، الفَضْلُ بنُ مُحَمَّدِ بنِ المُسَيَّبِ بنِ مُوْسَى بنِ زُهَيْرِ بنِ يَزِيْدَ بنِ كَيْسَانَ بنِ المَلِكِ بَاذَانَ (1) ، صَاحِبُ اليَمَنِ، الَّذِي أَسْلَمَ بِكِتَابِ رَسُوْلِ اللهِ -صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- الخُرَاسَانِيُّ النَّيْسَابُوْرِيُّ الشَّعْرَانِيُّ
“ইমাম, হাফিয, মুহাদ্দিস, পর্যটক, অঢেল সম্পত্তির মালিক- আবূ মুহাম্মাদ, আল-ফযল ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুল মুসায়্যিব ইবনু মূসা ইবনু যুহাইর ইবনু ইয়াযিদ ইবনু কাইসান ইবনুল মালিক বাযান বা বাদশাহ বাযান, যিনি ইয়ামানের অধিপতি, আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠির মাধ্যমে যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন- খোরাসানী, নিশাপুরী, শা’রানী।” [১১]
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন- তিনি ছিলেন রাজবংশের ছেলে এবং নিজেও ছিলেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। ইমাম ফযল রহিমাহুল্লাহর জন্য তাঁর পয়সাকড়ি ছিলো আল্লাহর দেয়া ফযল, অর্থাৎ অনুগ্রহ। ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ গ্রন্থে ইমাম যাহাবী রহিমাহুল্লাহ তাঁর জীবনী সম্পর্কিত আলোচনা করতে গিয়ে শেষপর্যায়ে বলেন,
وإنما يعرف الفضل لأهل الفضل ذو الفضل
“আর তিনি তো কেবল এজন্যই ফযল নামে পরিচিতি লাভ করেন যে, ফযল বা অনুগ্রহে ভরা পরিবারে তাঁর জন্ম এবং নিজেও ফযল বা প্রভূত অনুগ্রহের অধিকারী।” [১২]
.
[১] তাযকিরাতুল হুফফায, যাহাবী, ২/১৫০
[২] তাবাক্বাতুল হুফফায, সুয়ূত্বী, পৃঃ ২৭৯
[৩] আল-মুনতাযিমু ফী তারীখিল মুলূকি ওয়াল উমাম, ১২/৩৫১
[৪] সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা (রিসালাহ), যাহাবী, ১৩/৩১৭
[৫] সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা (রিসালাহ), যাহাবী, ১৩/৩১৮
[৬] আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া (ফিক্র), ইবনু কাছীর, ১১/৭৩
[৭] আল-জামিউল আখলাক, খতীব আল-বাগদাদী, ১৫২৩
[৮] তারীখু দিমাশ্ক, ইবনু আসাকির, ৪৮/৩৬৪
[৯] বিস্তারিত জানার জন্য- আল-আন্দালুস মিনাল ফাতহি ইলাস সুক্বুত, রাগিব সিরজানী
[১০] শাযারাতুয যাহাব, ইবনুল ইমাদ আল-হাম্বলী, ৩/৩৩৭
[১১] সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা (রিসালাহ), যাহাবী, ১৩/৩১৭
[১২] তাযকিরাতুল হুফফায, যাহাবী, ২/১৫০