বাংলার সমাজ জীবনে ইসলাম : কিছু বক্তব্য

যে কোন সমাজ জীবনকে বুঝতে হলে বিশ্লেষণ করতে হয় তার সমাজ কাঠামো (Social Structure) এবং সেই কাঠামোর বাম্ভব কার্যধারাকে (Social Functions)। সমাজ কাঠামো বলতে বোঝায় মানুষে মানুষে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সম্বন্ধকে। ধর্ম চেতনা নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত করে এবং এখনও করে চলেছে মানুষে সম্বন্ধ। তাই সমাজ কাঠামো বর্ণনার ক্ষেত্রে সমাজ কাঠামোর পশ্চাতে কাজ করে চলা ধর্ম চেনার কথাও এসে যায় স্বাভাবিকভাবে।

ইসলামের বিশেষত্ব

সব ধর্মই চেয়েছে মানব জীবনে শৃঙ্খলা প্রদান করত। ইসলাম সমাজ জীবনকে যেভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে চেয়েছে, অন্য ধর্মে তার তুলনা মেলে না। ইসলামে গড়ে উঠেছে এক বহু বিস্তীর্ণ আইন বিজ্ঞান (Jurisprudence) বা ফিকাহ। সমাজ কাঠামো তথা মানুষে মানুষে সম্পর্কে এমন কোন দিক নেই যা এই আইন বিজ্ঞানের এলাকায় আসেনি। একজন অমুসঙ্গমান ইসলাম বিশেষজ্ঞ ইসলাম সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘It is characteristic of the practical bent of the Islamic Community and of its thought that its earliest activity and most highly developed expression in law rather than in theology”_ aa সমাজ জীবন নিয়স্ত্রণের জন্য আইন সম্পর্কে যতটা সক্রিয় উৎসাহ গোড় থেকেই দেখা হয়েছে, ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে ঠিক ততটা দেখান হয়নি।[1] একাধিকভাবে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা হয়ে ইসলামের এই আইনমুখীনতার। এর মধ্যে একটি হল, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কেবল একজন ধর্ম প্রবর্তকই ছিলেন না—ছিলেন একজন রাষ্ট্র প্রধান এবং বিচারক। সমাজ জীবন নিয়ন্ত্রণের বাস্তব সমস্যা তাই সুচনা থেকেই ইসলামে হয়েছে বিশেষভাবে বিবেচ্য। পরস্পর-বিরোধী আরব-গোষ্ঠীগুলোকে (Tribes) একত্র করে এক ধর্মের পতাকা তলে আসার জন্যও প্রয়োজন হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক আইন প্রতিষ্ঠার—সমাজ জীবন সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত সুনির্দিস্ট চিন্তার। পবিত্র কুরআন শরীফের সূরাগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যাদের বলা হয় মক্কাবতীর্ণ সুরা তাদের মধ্যে বিশেষতবে পাওয়া যায় ইসলামের আধ্যাত্মিক ধারণার পরিচয়। যে সব সূরা মদীনাবতীর্ণ, তাদের মধ্যে দেখা খায় সামাজিক আইন-কানুনের সুস্পষ্ট নির্দেশ।

সমাজ কাঠামো

নৃতত্ত্বের মতে সমাজ কাঠামোর গোড়ার কথা হল আত্মীয়তার বন্ধন (Kinship System)। কারণ, এর উপর বিশেষভাবে নির্ভর করে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। প্রত্যেক সমাজে আত্মীয়তার বন্ধন নিরূপিত হয়ও বিবাহসূত্র দিয়ে। মুসলমান সমাজে বিবাহ বন্ধন বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে ধর্মীয় বিধান দ্বারা। ধর্মীয় বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার (Inheritance)। মুসলমান সমাজের উত্তরাধিকার আইন এমন যে, সম্পত্তি এখানে যেতে চায় বিভক্ত হয়ে। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষমতা হতে পারে বিকেন্দ্রিত। মুসলমান সমাজ তাই এমনিতেই অন্য সমাজের তুলনা হয়েছে বাস্তব ক্ষেত্রে অনেক বেশী সমতাবাদী (egalitarian)। বাংলাদেশের মুসলমান সমাজও উত্তরাধিকার, বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ইসলামী আইনের মূল বিধি দ্বারা। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে বাঙালী মুসলমান সমাজে কিছু কিছু স্থানিক বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়ে। ‘নিকা’ শব্দটা আরবী। নিকা বলতে আরবীতে সর্ব প্রকার বিবাহকেই বোঝায়। কিন্তু বাঙালী মুসুলমান সমাজে নিকা বলতে প্রধানত বোঝায় বিধবা বিবাহ অথবা তালাকপ্রাপ্তা মহিলাকে বিবাহ। অনেক সময় ‘নিকা’ ও ‘বিবাহ’কে ঠিক এক নজরে দেখা হয় না। বিবাহ বন্ধনকে যতটা শ্রদ্ধা করা হয়, ‘নিকা’ কে ঠিক তা মর্যাদার বলে মনে করা হয় না। নিকার বন্ধন অনেক সহজেই ভঙ্গ হতে পারে। কেবল স্বামীর পক্ষ থেকে নয়, স্ত্রীর পক্ষ থেকেও। ইসলামী বিধান অনুসারে মেয়েরা পিতার এবং স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করতে পারে। (সূরা ৪, আয়াত ৮ এবং ১৪)। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে মেয়েরা পিতার সম্পত্তির যে অংশ তাদের প্রাপ্য, তা তারা সাধারণত ভাইদের ছেড়ে দেন। কারণ, তারা চান ভাইদের সাথে বিশেষ সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ! যাতে বিপদের সময় তারা প্রয়োজন হলে ভাইয়ের কাছে আশ্রয় পেতে পারেন। বাংলাদেশের মুসলমান সমাজ অন্যান্য দেশের মুসলমান সমাজের মত পিতৃ-সম্পর্ক প্রধান (aginatic) হলেও এই সমাজে মাতুলের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। সঙ্কটের সময় মা তাঁর আপন ভাইদের নিকট থেকে অনেক বেশী সাহায্য প্রত্যাশা করেন। ছেলেরা মামাদের প্রতি দেখা বিশেষ শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা (avunculate), যা কিছুটা মাতৃ-প্রধান সমাজের ঐতিহ্য বহন করে। সব দেশেই মুসলমান সমাজের নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ প্রচলিত আছে। যেমন চাচাতো ভাই-বোন, খালাতো ভাই-বোন (parallel cousin marriage) অথবা মামাতো ভাই-ফুপাতো বোন অথবা ফুফাতো ভাই-মামাত বোন (cross cousin marriage) বিবাহ হতে পারে।[2] অনেক দেশে মুসলমান সমাজে চাচাত তাই যদি চাচাত বোনকে বিয়ে করতে চায় তবে তাকে দেয়া হয় অগ্রাধিকার। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমান সমাজে এ রকম কোন অগ্রাধিকারের রেওয়াজ নেই।

মুসলমান ও হিন্দু সমাজ সম্বন্ধ

বাংলার মুসলমান ও হিন্দু সমাজ পাশাপাশি দীর্ঘকাল বাস করেছে। কিন্তু মুসলমান ও হিন্দু সমাজের বিধি-বিধান থেকেছে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে। হিন্দু সমাজের উপর পড়েনি মুসলমান সমাজের প্রভাব, মুসলমান সমাজের উপরও প্রভাব পড়তে পারেনি হিন্দু ভাবধারার। নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ বাংলার হিন্দু সমাজে ছিল অসম্ভব (দাক্ষিণাত্যে ব্রাহ্মণরা মাতুল কন্যাকে বিবাহ করতে পারতেন)। তেমনি হিন্দু সমাজে অনেক রীতি ছিল যা মুসলমান সমাজে নিষিদ্ধ। যেমন হিন্দু সমাজে কেউ ইচ্ছা করলে অপরের দুই বা ততোধিক আপন বোনকে এক সঙ্গে বিবাহ করতে পারতেন। মুসলমান সমাজে স্ত্রী বেঁচে থাকতে তার আপন বোনকে বিবাহ কারা যায় না (সূরা ৪ : ২৬)। ইসলামে (সূরা ৪ : ৩) বহু বিবাহকে নিষিদ্ধ করা না হলেও তাকে বিশেষভাবে সীমিত করবার চেষ্টা করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে এ রকম কোন বিধান নেই। এ কারণে হিন্দু কুলীন ব্রাহ্মণ সমাজে বহু বিবাহ এক সশল্প খুবই জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ বিশেষ করে উচ্চ বর্গের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তাই সমাজে বিধবারাও ছিলেন এক বিরাট বোঝা হয়ে। বাংলা সাহিত্যে এক সময় হিন্দু বিধবার মন-যন্ত্রণা ও সামাজিক সমস্যা হয়েছে হিন্দু লোকদের বিশেষ উপজীব্য। কিন্তু মুসলমান সমাজে এ রকম সমস্যা ছিল না। বিধবারা মুসলিম সমাজ ইচ্ছে করলেই পুনরায় বিয়ে করতে পারতেন। এছাড়া পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার থাকার জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকেও তাঁরা ছিলেন তুলনায় অনেক স্বাবলম্বী। কিন্তু হিন্দু মহিলাদের এরফম অধিকার ছিল না। সর্বোপরি হিন্দু ব্রাহ্মণদের মধ্যে বাংলাদেশের উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল সতীদাহের মত প্রথা। স্বামীর মৃত্যুর পর, মৃত স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হত। ১৮১৭-১৮২৬ সালের মধ্যে প্রতি বছর সে সময়কার বাংলা ৫০০ থেকে ৮৫০ জনের মত হিন্দু বিধবাকে এভাবে পুড়ে মরতে হয়েছে। ১৮২৯ সালে এই প্রথার বিপক্ষে আইন প্রবর্তিত হয়।[3] অনেক মুসলমনি নৃপতিও চেয়েছিলেন এই প্রথার বিলুপ্তি। যেমন সম্রাট আকবর। কিন্তু হিন্দু সমাজের ধর্ম চেতনায় আঘাত লাগতে পারে ভেবে তিনি এ ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত কোন ঘোষণা দেননি।[4] উনবিংশ শতকে বাংলার হিন্দু সমাজে আসে বিশেষ জাগরণ। রাজা রামমোহন চান সতীদাহ প্রথার বিলোপ। যদিও তিনি ঠিক আইন করে এই প্রথার অবসান চাননি। অপর পক্ষে বিদ্যাসাগর চান হিন্দু সমাজ বিধবা বিবাহের প্রচলন করতে এবং কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে অগণিত বহু বিবাহ (Polygamy) বন্ধ করতে। মুসলমান সমাজে এ রকম কে সমস্যা ছিল না। তাই ইংরেজ আসবার পর হিন্দু সমাজের অনুরূপ কোন আন্দোলনের প্রশ্ন দেখা দেয়নি তাদের মধ্যে। ইউরোপ নিয়ে মুসলমান সমাজে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় ভিন্ন প্রকারের।

ইউরোপের অভিঘাত ও নব্যচিন্তার উন্মেষ

অনেকে বোঝাতে চান মুসলমান সমাজের ধর্মের গোঁড়ামির জন্যই অসে ক্ষয়। অরি এই ক্ষয়ই ডেকে আনে তার ইউরোপের কাছে পরাজয়। কিন্তু বাস্তব ইতিহাসের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, এই পরাজয়ের মূলে কাজ করেছিল ইউরোপের মাত্র কয়েকটি দেশের নতুন ধরনের জাহাজ তৈরী ও নৌবহর গড়ে তুলবার সাফল্য। পর্তুগীজ জাহাজের কামান (artillery) এ সময় ছিল যথেষ্ট উন্নত। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তাদের পূর্বের নৌবহরে জাহাজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় আটশোর মত। ১৪৯৮ স্টাব্দে আহমদ ইবনে মজীদ নামক একজন নামকরা আরব নাবিক ভাসকো-দা-গামাকে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন দক্ষিণ ভারতের কালিকট বন্দরে। এই বন্দরছিল আরব নাবিকদের কাছে খুবই পরিচিত। তারা এই বন্দর মারফত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য করত। পর্তুগীজরা প্রথমে কালিকট এবং পরে গোয়াতে ঘাঁটি গাড়ে। তারা হয়ে ওঠে ভারত মহাসাগরে আরব বণিকদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। পর্তুগীজ নৌ সেনাপতি দ্য আল মিয়েদা (De Alimeida) ১৫০৭ সালে মিসর ও গুজরাটের যৌথ নৌবাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। এ সময় থেকেই ভারত মহাসাগর আর ইসলামের সমুদ্র হয়ে থাকেনি।[5] আল মিয়েদা ঘোষণা করেন, “সমুদ্রের কর্তৃত্ব যার হাতে থাকবে, ভারতের ভূখন্ডও থাকবে তার অধীনে”। পরবর্তীকালে নৌশক্তিতে ইংরেজ ছাড়িয়ে যেতে পারে অন্যদের-আল মিয়েদার ভবিষ্যদ্বাণী বিশেষভাবে খেটে যায়। এই উপমহাদেশের কর্তৃত্ব চলে ঘায় ইংরাজদের হাতে। মুসলিম শক্তির পরাজয়কে ঠিক ধর্মের গোঁড়ামি দিয়ে ব্যাখ্যা করলে চলে না। কারণ, মুসলমান সমাজের তুলনায় খৃস্টান সমাজ এ সময় খুব কম গোঁড়া ছিল না ধর্মের দিক থেকে। ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ সাল, এই ত্রিশ বছর ধরে ইউরোপের বুকে রোমান ক্যাথলিক এবং প্রটেস্ট্যান্টদের মধ্যে চলে ভয়াবহ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে য়ে বারুদ ব্যবহৃত হয়েছিল তা তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় শোরা (saltpetre) চালান যায় উত্তর বিহার থেকে তখনকার বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। এ সময় থেকেই এদেশে ইউরোপের ব্যবসা বাণিজ্য জেঁকে ওঠে।

ইংরাজরা প্রথম যখন পূর্বের পথে বাণিজ্য করতে বের হয়, তখন ভাবনা-চিন্তায় তারা যে ছিল সব ব্যাপারেই এগিয়ে থাকা, তা নয়। এমন কি তাদের মধ্যে এমন অনেক প্রথা ছিল, যার কথা এখন ভাবলে অবাক হতে হয়। যেমন বিলাতে কোন মেয়েকে ডাইনি বলে সন্দেহ হলে তাকে বিচার করে পুড়িয়ে মারবার আইন ছিল। স্কটল্যান্ডে এড়াবে মেয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়েছে ১৭২২ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত। অর্থাৎ ১৬০০ খৃষ্টাব্দে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ইউরোপকে বলা চলে না মুক্তমনা। কিন্তু স্বীকার করতে হয় ইউরোপের মানুষের অন্তত একাংশের মধ্যে দেখা দিয়েছিল নতুন ভাবনা চিন্তা, জেগেছিল বিশেষ ধরনের কর্মতৎপরতা, যার ফলে তারা গড়তে পেরেছিল উন্নতমানের বাণিজ্য ও সমর সংগঠন (Organisation)। এ সময় কেবল মুসলিম বিশ্বের নয়, সাধারণভাবে প্রাচ্যের পরাজয় ঘটবার কারণ ছিল সাংগঠনিক দুর্বলতা ও যন্ত্র কৌশলে পিছিয়ে পড়া। অবস্থা যথেষ্ট অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও চীনে অতীতে ঘটেনি শিল্পবিপ্লব। বাষ্প শক্তির ব্যবহার চীনারা আবিষ্কার করতে পারেনি, পেরেছে বৃটেনের লোক। এই ঘটনার সহজ কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। বলতে হয়, এটা ঘটেছিল আকষ্মিকভাবে।

ইউরোপের অগ্রগতি সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বের ভাবনা চিন্তা বিশেষভাবে আরম্ভ হয় উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। এক্ষেত্রে তিনজন ব্যক্তির নাম খুবই উল্লেখযোগ্য যাঁদের প্রভাব পড়েছে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে। এঁরা হলেন অফিগানিস্তানের জামাল-আল-দীন আফগানী (১৮৩৯–১৮৯৭), তাঁর প্রিয় ও যোগ্য শিষ্য মিসরের আবদুহু (১৮৭৯-১৯০৫) এবং বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের চুঁচূড়ার সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮)। আফগানী ও আবদুহু—দুজনেই বোঝাতে চান যে, খৃষ্টান ইউরোপের আধিপত্যের হাত থেকে বাঁচতে হলে গ্রহণ করতে হবে আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার দান। তাঁরা বোঝাতে চান, বিজ্ঞান ও ইসলামে কোন বিরোধ নেই। আফগানী রাজনীতির ক্ষেত্রে গোটা মুসলিম বিশ্বকে একত্র দেখতে চান তুর্কী সুলতান খিলাফতের নেতৃত্বে। তিনিই হলেন প্যান-ইসলামী চিন্তাধারার জনক। তিনি উত্তর ভারতে আসেন লেখাপড়া শিখতে। সেখানেই প্রথম গঠিত হয় তাঁর ভাবধারা (১৮৬৯)।[6]

এরপর তিনি যান ইস্তাম্বুলে, মিসরে এবং ইরানে। এক সময় প্যারিস থেকে তিনি মুসলিম বিশ্বের জাগরণের জন্যে প্রকাশ করেন বিশেষ পঞ্জিকা। তিনি কিছুদিন লন্ডনেও অবস্থান করেন এবং শেষে মারা যান ইস্তাম্বুল (১৮৯৭)। আফগানীর বিশেষ প্রভাব পড়ে মিসরে, যার ফলে ঘটে সেখানে বৃটিশ বিরোধী অভ্যুদয় (১৮৮১)। তাঁর চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত তরুণরা পারস্যে বিদ্রোহ করেন (১৯০৬)। তাঁর চিন্তার দ্বারা আংশিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল তরুণ তুর্কীর (১৯০৮) আন্দোলনও। আমীর আলী ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার লোক। তাঁর প্রভাব পড়েছে প্রধানত তাঁর লেখার মাধ্যমে। আমীর আলীর বিখ্যাত গ্রন্থ The Spirit of Islam মুসলিম বিশ্বের একাংশের চিন্তায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। বইটি ইংরজী থেকে তুর্কী ও অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯১ সালে। তখন বইটির নাম ছিল The Life and Teaching of Muhammad। আমীর আলী ছিলেন খুব মেধাবী ছাত্র। ১৮৬৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা বি. এ. পরীক্ষা দেন, তাঁদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদালয় থেকে এম, এ, এবং বি, এল. ডিগ্রী নেবার পর বিলাতে যান ব্যারিস্টারী পড়তে। সেখানে ব্যারিষ্টার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশে ফিরেন ১৮৭৩ সালে এবং কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা আরম্ভ করেন। এর পরের বছর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে ‘মোহামেডান ল’-এর প্রফেসর নিযুক্ত হন। তিনি পরে বাংলার আইন পরিষদের মন্ত্রণা সার এবং রাজকীয় মন্ত্রণা সভার (Imperial council) সদস্য মনোনীত হন। রাজনীতির দিক থেকে আমীর আলী আফগানী ও আবু দুদুর মত বিপ্লবী ছিলেন না। তিনি ইংরেজের সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু চিন্তাধারার যে প্রসারতা তিনি দেখিয়েছেন তা মুসলিম বিশ্বে ছিল অভাবিত। তিনি বোঝাতে চান, সনাতন শিক্ষায় শিক্ষিত আলিমগণ ইসলামের যে ব্যাখ্যা দেন তাকে সঠিক বলে মেনে নেবার কোন কারণ নেই। ইসলামের স্বর্ণযুগে যুক্তিবাদকে দেয়া হয়েছে বিশেষ প্রাধান্য। আসলে ইসলাম একটি যুক্তিবাদী ধর্ম। বিজ্ঞানের সঙ্গে এর ধর্মগত কোন বিরোধ নেই। এই কারণে অতীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা মুসলিম বিশ্বেই বিশেষভাবে হতে পেরেছে। ইসলামে ভাগ্যবাদ (Prelestination} প্রাধান্য লাভ করতে আরম্ভ করেছে মুসলমান সমাজের অবক্ষয়ের যুগে। কুরআনের মুল কথা ভাগ্যবাদ নয়। আল্লাহর অভিপ্রায়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও বুদ্ধির ভূমিকাকে স্বীকার করা হয়েছে ইসলামে। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তার কর্মকে নয়। যেহেতু কর্মের স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয় ইসলামে, তাই মানুষের ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে পাপ পুণ্য বিচারের। সৎ-অসতের বিবেচনার। তিনি আরো বলেন, আধুনিক গণতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গেও ইসলামের কোন বিরোধ নেই। খলীফা প্রথমে হয়েছেন নির্বাচিত। নগর-গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করেই ঘটে ইসলামের অভ্যুদয়। ইসলামের মূল শিক্ষা গণতন্ত্র ও মানব সমতার। এই মর্মবাণীকে (Spirit) উপলদ্ধি করেই ঘটাতে হবে ধর্ম-চিন্তার সঞ্জীবন। বাঁচতে হবে আধুনিক বিশ্বে। সৈয়দ আমীর আলী যদিও জন্মেছিলেন শিয়া পরিবারে, কিন্তু তাঁর লেখায় কোথাও শিয়া মতবাদের প্রভাব দেখা যায় না। তিনি সাধারণভাবে চেয়েছেন সমগ্র মুসলিম সমাজেরই বিশেষ জাগরণ। কুসংস্কার ও পিছিয়ে পড়া থেকে অব্যাহতি। এই সব চিন্তাশীল ও কর্মকর্তাদের উদ্যোগে মুসলমান সমাজে আরম্ভ হয় ইসলামী আইনের (শরিয়া) সময়োপযোগী ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা। ইউরোপের অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূলে অনেক কারণ ছিল। এর মধ্যে একটি হলো, আধুনিক ব্যাংক ব্যবসার প্রসার। ইয়াহুদী, খৃষ্টান ও ইসলাম-এই তিনটি ধর্মেই টাকা ধার দিয়ে সূদ গ্রহণ নিষিদ্ধ। কিন্তু ইয়াহুদীরা তাদের ধর্মীয় নিষেধ ভঙ্গ করে সুদের ব্যবসা আরম্ভ করে। ইউরোপে প্রথমে তাদের প্রচেষ্টাতেই গড়ে ওঠে আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থা। রথ চাইল্ড লয়েডস প্রমুখ ইয়াহুদ এক্ষেত্রে পালন করেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। খৃস্টানরা করতে চান ইয়াহুদীদেরই অনুসরণ। বিলাতে বিখ্যাত দার্শনিক বেন্থাম প্রবন্ধ লেখেন (১৭৮৭) সূদ প্রহণের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে (Defence of Usury)। কিন্তু কুরআন শরীফে সূদ গ্রহণ হারাম করা হয়েছে (সুরা ৪, আয়াত ১৫৭-১৫৯)। তাই এই শতাব্দীর প্রথম ভাগেও ধর্মপ্রাণ মুসমানরা ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ গ্রহণক ভেবেছেন অন্যায়।[7] ব্যাংক থেকে যাঁরা টাকা ধার করেন তাঁরা তা করেন বিভিন্ন ব্যবসায়ে ঘাটাবার জন্যে। এই টাকা খাটিয়ে যে লাভ হয়, তা থেকেই তাঁরা দেন ব্যাংকের ধার নেওয়া টাকার সূদ। আর এই সূদের অংশই ব্যাংক দিয়ে থাকে আমানতকারীদের।

যাকে আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা বলে অভিহিত করা হয়, তার মূল কাজ করে চলেছে বিশেষ ধরনের অর্থনৈতিক সংগঠন, আধুনিক পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের জ্ঞান এবং এক ধরনের রাজনৈতিক চেতনা, যাকে বলা চলে গণতান্ত্রিক। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সর্বত্র মুসলমান সমাজের একাংশ চেয়েছেন ইউরোপের সংভ্যতা থেকে গ্রহণীয় বিষয়গুলো গ্রহণ করে সমাজের অগ্রগতি সাধন করতে। আবার একাংশ সমগ্র ইউরোপীয় সভ্যতাকে খৃস্টান মনের সৃষ্টি বলে চেয়েছেন উপেক্ষা করতে। এর থেকে সর্বতোভাবে দূরে সরে থাকতে। মুসলমান সমাজের এই দুই প্রবণতা এখনও অবলুপ্ত হয়নি এবং এদের সমন্বয় সাধন এখনও অনেক ক্ষেত্রে হয়ে আছে সমস্যামূলক। ব্যতিক্রম ছাড়া এখন মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশ থেকেই অযৌক্তিক বিধিবিধানকে বাদ দিয়ে আধুনিক হবারই চেষ্টা করা হচ্ছে। আসলে মুসলমান সমাজকে আপাত দৃষ্টিতে যতটা রক্ষণশীল বলে মনে হয়, ইতিহাসে তার প্রমাণ মেলে না। ধর্মের মূলনীতির বিরোধী নয়, অথচ সমাজের পক্ষে হিতকর এ রকম স্থানীয় বিধি-বিধানকে (আদত) অতীতে মুসলমান সমাজে অনেক সহজেই গ্রহণ করা হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে সুলতান-খলীফার আমলেই তুরস্কে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল নিজামী আদালত। সেখানে বিচার হত, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রবর্তিত নতুন আইনের (তানজিমাত) উপর ভিত্তি করে।

আজকের আমেরিকায় খৃস্টানদের মধ্যে অ্যামিশ (Amish) বলে একটি বিশেষ সম্প্রদাজের লোকেরা মটর গাড়ীতে চড়েন না, বিজলী বাতি ও টেলিফোন ব্যবহার করেন না যীশু (Jesus) এগুলো ব্যবহার করেন নি বলে। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে এ রকম সম্প্রদায়ের কোন সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না কোন দেশে। হযরত মুহম্মদ (সঃ) উটে চড়েছেন, অতএব আমাদেরও কেবল উটে চড়াই উচিত, এ রকম যুক্তি দেখাবার প্রয়োজন অনুভব করেন না মুসলমানরা।

লোকবিশ্বাস

বাংলাদেশে ইসলাম সম্পর্কে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। জনসংখ্যার দিক থেকে মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের স্থানকে বলা যায় দ্বিতীয়। বাংলাদেশ হবার পর বাঙালী মুসলমান সম্পর্কে কৌতুহল ও অনুসন্ধিৎসা নানাভাবেই বেড়েছে। কিন্তু আলোচনা করতে যেয়ে বাঙালী মুসমানের মধ্যে যে সব অনৈসলামী ভাবধারা টিকে আছে তার উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। এর দ্বারা তারা প্রমাণ করতে চান বাঙালী মুসলমানর বৈশিষ্ট্যের কথা। তার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের কথা। এর মধ্যে তাঁরা খুঁজে পেতে চান আজকের পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাষ্ট্ৰীয় অস্তিত্বের মুক্তি বা বাঙালীত্বের বুনিয়াদ। এর ফলে বাঙালী মুসলমানের জীবনে কুরআন-হাদীসের যে একটা সাধারণ প্রভাবও বিদ্যমান তার কথা আলোচ্যসূচী থেকে বাদ পড়ে যেতে থাকে। আলোচনা হয়ে উঠতে থাকে খুবই একাদশস্পর্শী। মনে হতে থাকে বাঙালী মুসলমান যেন আসলে মুসলমানই নয়। সব দেশেই ইসলামের দুটি রূপ চোখে পড়ে : বিশুদ্ধ এবং লোকজ। সব দেশেই লোকজ ইসলামের (Folk Islam) মধ্যে এমন অনেক ধারণার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যার কোন সমর্থনই দেয়া চলে না ইসলামের মূল বিশ্বাস থেকে। বাংলাদেশে যেমন এর দৃষ্টান্তু পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় অন্যান্য প্রায় সব মুসলিম দেশেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনন্য নয়। যদিও বাঙালী মুসলমান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অনেকে এ রকম ইঙ্গিতই করতে চেয়েছেন। কতগুলো দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে এই জমে থাকা ভুল ধারণা নিরসনের জন্যে :

মিসরে শেখ হারিদির দরগা বেশ বিখ্যাত। মনে করা হয়, শেখ হারিদি সর্ব প্রকার রোগ নিরাময়ে সক্ষম। শেখ হারিদি এটা করতে পারে, লোকের বিশ্বাস, একটি পবিত্র ধাপের সাহায্যে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ হারিদি আসলে হচ্ছে প্রাচীন মিসরের স্বর্ণ দেবতা। এমনি আর একটি বিখ্যাত দরগা হলো সিরিয়ার ঢায়ার শহরের শেখ মাসুখের দরগা। শেখ মাসুখ সকলেরই বন্ধু। শেখ মাসুখ সকলকেই ভালবাসে এবং করে কল্যাণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ মাসুখের দরগা আসলে হলো প্রাচীন গ্রীক অ্যাডোনিস-এর স্মৃতিমন্দির। ইয়েমেনে সাধারণ গ্রাম্য শিয়া কৃষক মেঘের ডাক শুনলে বল হযরত আলী (রাঃ) মেঘের মধ্যে থেকে হাঁক দিচ্ছেন। তাদের কাছে এক হয়ে গিয়েছেন হযরত আলী (রাঃ) এবং প্রাচীন সেমেটিকে বজ্র-দেবতা।[8] এ ভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলিম সমাজে এমন অনেক ধারণা দুকে পড়েছে অথবা টিকে আছে, যার সাথে প্রকৃত ইসলামের সুর যোগাযোগও কামনা করা যায় না।

বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যেও পাওয়া যায় এ ধরনের অনেক পীরের ধারণা। যেমন পীর শাহ মাদার ও জিন্দা-গাযীর ধারণা। পীর শাহ মাদার থাকেন হিমালয় পর্বতে। সেখান থেকে তিনি ভক্তদের উদ্ধার করেন বিপদ থেকে। বিশেষ করে পথের বিপদ থেকে। গ্রাম দেশে শাহ মাদারের গান কিছুদিন আগেও ছিল খুব প্রচলিত। মায়েরা ছেলের মঙ্গল কামনা করে দিতেন শাহ মাদারের শিরনি। অন্যদিকে জিন্দা-গাযী থাকেন সুন্দরবনের গহীনে। সুন্দরবনের কাঠুরেদের পীর তিনি। তিনি বাঘের পিঠে চড়ে বেড়ান। ভক্তদের তিনি রক্ষা করেন বাঘ ও কুমীরের হাত থেকে।[9]

বাংলাদেশের মুসলমান সমাজে কোন গাছকে পবিত্র ভেবে তার শাখার নানা রঙের সুতো অথবা কাপড়ের টুকরো বাঁধার রেওয়াজ আছে। মনে করা হয়, গাছের নীচে কখন কোন পীর বসে ইবাদত করেছেন। এই সব গাছের মধ্যে আছে তাঁদের অলৌকিক শক্তির (কারামত) প্রভাব। মনে করা হয়, কিছু মানস করে গাছের ডালে সুতো অথবা রঙিন কাপড়ের টুকরা জড়ালে হতে পারবে ইচ্ছে পূরণ। কিন্তু এ ধরনের উদ্ভিদ ভক্তি যে কেবল বাঙালী মুসলমানের মধ্যেই দেখা যায়, তা নয়। অনেক দেশেই এরকম ভক্তির দৃষ্টান্ত মেলে। বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে আলজিরিয়াতেও অনুরূপ বিশ্বাসের নজীর মেলে।[10] নজীর মেলে আনাতোলিয়ার গ্রামে ও অন্যত্র। অর্থাৎ এই ধরনের বিশ্বাস যথেষ্ট ব্যাপকভাবে বিস্তীর্ণ রয়েছে মুসলিম সমাজে, কেবল বাঙালী মুসলমানের মধ্যেই তা নিবন্ধ নয়।

কিন্তু যা বিশেষভাবে মনে রাখতে হয়, তা হলো কোন দেশেই লোক-বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে মুসলিম সমাজের বিধি-বিধান রচিত নয়। সাধারণভাবে মুসলমানরা সর্বত্রই মেনে চলেন কুরআন ও হাদীসেরই নির্দেশ।[11]

বিশ্বের সর্বত্রই শরীয়া ইসলামী সমাজ জীবনে দিয়েছে একটা মূলগত ঐকা, যা হলো তার জীবন-রীতির ভিত্তি।

মরমীবাদ

বাংলার মুসলমান সমাজ-জীবনকে আর একটি দিক থেকেও খুব আলাদা করে দেখবার চেষ্টা করা হয়। বোঝাবার চেষ্টা হয়, বাংলাদেশে যে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল তা আসলে ছিল মরমীবাদ ইসলাম। এর সঙ্গে খাঁটি ইসলামের মিল ছিল খুব অল্পই। বরং এর সঙ্গে বহুবিধ সহিশ ছিন্ন এ দেশের সনাতন যোগমার্গ সাধনার ফলে এ দেশেরইলাম অতি সহজেই প্রচারিত হতে পেরেছিল।[12] কিন্তু এ প্রসঙ্গে কতগুলো কথা মনে রাখতে হয়ঃ বাংলার মুসলমান তার সমাজজীবনে কুরআন-হাদীসের বিধানকেই মেনে চলতে চেয়েছেন, কোন আলাদা সমাজ বিধান (Social legislation) গড়ে তোলেন নি। অন্যদিকে যাকে বলা হয় ইসলামী মরমীবাদ (Mysticisin) বা সূফীবাদ, তার সঙ্গে অন্যান্য মরমীবাদী চিন্তার বেশকিছুটা পার্থক্য আছে। এই মরমীবাদ আর যোগমার্গ সাধনা ঠিক এক ব্যাপার নয়। অন্য মরমী চিন্তার সঙ্গে সূফীবাদের একটি পার্থক্য হলো, খৃষ্টান ও বৌদ্ধ মরমীবাদীরা থাকতে চেয়েছেন অবিবাহিত। পালন করতে চেয়েছন ব্রহ্মচর্য ব্রত। কিন্তু ইসলাম বিবাহিত জীবন যাপনের উপর দেয়া হয়েছে গুরুত্ব। এ কারণে মুসলিম মরমী সাধকরা সাধারণত যাপন করেছেন বিবাহিত জীবন।[13]

সূফীরা সাধারণভাবে মানুষকে অত বেশী জীবনবিমুখ হাত বলেন নি, যেমন বলেছেন খৃষ্টান ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুর দল। সূফী দার্শনিক আল-গাযযালী (১০৫৮-১১১১) সূফীবাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন সূফীবাদের অন্যতম লক্ষ্য হলো অপরের সঙ্গে সংঘাতহীন নিস্বার্থ জীবন যাপন।[14] সূফীবাদ একটা অখণ্ড মত নয়। সূফীবাদের মধ্যে আমরা গাই একাধিক প্রবণতার সাক্ষাত। ইসলামে ধর্ম-যুদ্ধের বিধান আছে। এ বিধানও মেনে চলছেন সূফীরা। প্রয়োজন হলে সূফীরা ধর্মের জন্য যুদ্ধও (জিহাদ) করেছেন। যেমন করেছেন শ্রীহট্টে শাহ জালাল (রঃ) এবং উত্তর আফ্রিক্ষার মেরাবেৎ-রা। অর্থাৎ সূফীরা কেবল জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্বন্ধ স্থাপনের কথাই চিন্তা করেন নি। তারা প্রয়োজন হলে অস্ত্রও ধারণ করেছেন। অন্যদিকে, ইতিহাসে দেখি, অতীতে বাংলাদেশে কুরআন-হাদীসের চর্চাও হয়েছে যথেষ্ট। ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা খায়, ইবনে বখতিয়ার পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গ জয়ের পর রংপুরে স্থাপন করেন প্রথম মাদ্রাসা। বাংলায় সুলতানী আমলেই নির্মিত হয়েছে কয়েক সহস্র মসজিদ, যা কেবল প্রার্থনা কেন্দ্র ছিল না, ছি শিক্ষা কেন্দ্রও। আর এই শিক্ষার মূল বিষয় ছিল

ধর্ম ও ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ইসলামী আইন-বিজ্ঞান (ফিকাহ)। অতীতেও বাংলাদেশ থেকে অনেকে গিয়েছেন মক্কায় হজ্জ করতে। সেখান থেকে বয়ে এনেছেন মুসলিম বিশ্বের নানা অংশের চিন্তার ফসল। তাই কেবল লোক-ইসলাম ও তথাকথিত সূফী সাধনার মাধ্যমে বাংলার মুসলিম মানসকে ব্যাখ্যা করা যায় না।[15]

একথা ঠিক, বাংলাদেশে সর্বত্রই পীরের মাযার ও দরগা চোখে পড়ে। কিন্তু পীরবাদ কেবল বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য নয়। সমগ্র মুসলিম বিশ্বেই এক সময় পীরবাদ লাভ করেছে বিশেষ প্রাধান্য। সূফীদের মাধ্যমেই ইসলামে এই অনৈসলামিক পীর-পূজার (Cult of Saints) অনুপ্রবেশ ঘটে। কিন্তু মুসলমানদের এই বিচ্যুতি কেবল বাংলার মুসলমানদের ক্ষেত্রেই ঘটে নি। এটা সাধারণভাবে প্রভাবিত করেছে সমগ্র মুসলিম বিশ্বকেই। এই প্রভাব থেকে ইসলামকে মুক্ত করবার জন্যেও চেষ্টা হয়েছে। যেমন, আরবে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইবনে আবদুল ওয়াহাব আরম্ভ করেন আল্লাহর একত্ববাদী (মোয়াদীন) আন্দোলন। এই আন্দোলন ছিল পীর ও দরবেশবাদের বিপক্ষে। এই আন্দোলন কেবল বাংলাদেশে নয়, পূর্বে সুমাত্রা থেকে পশ্চিমে নাইজেরিয়া পর্যন্ত জাগিয়েছিল বিশেষ সাড়া।[16] বাংলাদেশে এই আন্দোলন কেবল ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সীমিত থাকে নি, তা লাভ করে এক বিরাট রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবী আদায়ের আন্দোলনেরও রুপ, হান্টার-এর লেখায় যা ওয়াহাবী অভ্যুত্থান রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে।[17]

বাংলাদেশ আজ একটা পৃথক রাষ্ট্র। বাঙালী মুসলমানকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা তাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজকের বাঙালী মুসলমানকে বুঝে দেখতে হলে থা স্বীকার করা দরকার, তা হলো বাঙালী মুসলমানের আছে একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস। বাংলাদেশের মুসলমানের মধ্যে কাজ করে চলেছে যে ধর্ম চেতনা, তা কেবল বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, তার ব্যাপ্তি বিশ্বের একটা বিরাট ভাংশ জুড়ে। অতীতে ইসলামী বিশ্বের এক অংশের জাগরণ আর এক অংশকে প্রভাবিত করেছে। বাঙালী মুসলমান ও ইসলামী বিশ্বের মূল ভাবনা স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে নি, থাকতে পারে নি। কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই থাকেনি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে।

ইউরোপের অভিজাত বাঙালী মুসলমানকে ভাবিয়েছে, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদেরও। এই ভাবনা-চিন্তার ফলজাত আন্দোলন নিয়েছে কতক একই রূপ। কারণ, শেষ পর্যন্ত সমস্যাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউরোপীয় ভাবধারার সঙ্গে ইসালামী মূল্য ব্যবস্থার (Value System) সঙ্গতি সাধনের। মুসলিম দেশগুলোতে অতীতে শিল্প বিপ্লব ঘটে নি। তাই তাদের কাছে অনেক সময় ইউরোপকে মনে হয়েছে এক অপরিচিত গ্রহ বলে। কিন্তু আজ শিল্প-বিপ্লব সব মুসলিম দেশেই কম-বেশি ঘটছে বলে আগের বিরোধটা আর থাকছে না। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের তেল-সম্পদ ঐ অঞ্চলের মানুষের জীবন ধারাকে নিয়ে চলেছে আজ অতি দ্রুত রূপান্তরের পথে।

ইসলামী রুচি ও আবেগ

ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, যাকে বলা হয় ইসলামী সভ্যতা, তাতে এসে মিশেছে সভ্যতার দান। এই দান একীভূত হতে পেরেছিল এমন এক সাম্রাজ্যের সীমানার মধ্যে, যার বন্ধন ছিল ধর্মের এবং সেই ধর্মের ভাষা আরবী। অন্যান্য ভাষাও ছিল, তবে আরবী হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রধান ভাষা। এই কারনে উমর খৈয়াম (১০৫০-১১২৩) কবিতা লিখেছেন তাঁর মাতৃভাষা ফারসীতে কিন্তু বীজগণিত রচনা করেছেন আরবীতে। আরবীতে বই লিখেছেন আল-ফারাবী, ইবনে-সিনা, আল-বেরুনী ও আরো অনেক জ্ঞানী গুণীজন, আরবী যাঁদের মাতৃভাষা ছিল না। মুসলিম বিশ্বে ফারসী (বর্তমান ইরানের দক্ষিণ অঞ্চল বা ফারসী-এর ভাষা) তুর্কী ভাষাও এক সময় লাভ করে বিশেষ মর্যাদা।[18]

কিন্তু দুটি ভাষা আরবী থেকে এত বেশী শব্দ গ্রহণ করে যে, এদের সাবেক রূপ যায় বিশেষভাবে বদলে। তাছাড়া ফারসী ও তুর্কী ভাষা লেখা হতে থাকে আরবী হরফে (১৯২৮ সালে কামাল আতাতুর্ক আরবী অক্ষরের পরিবর্তে রোমান অক্ষরে তুর্কী লেখার আইন করেন)। এ সবের মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বে সাধারভাবে সৃষ্টি হয় এক বিশেষ ঐক্য চেতনা, একটা বিশিষ্ট ইসলামী মেজাজ (mental make-up) বা রুচি। এর ফলে এখনও বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা নিজেদের কেবল তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে গণ্য করেন না, ভাবেন একটা বৃহত্তর তওহীদবাদী সমাজের (monotheistic community) বা উম্মাহর অংশ, কুরআন যার ভিত্তি।[19] এ কারণে অনেক বিবাদ-বিসংবাদ সত্ত্বেও তাঁরা একে অপরের জন্যে অনেক ক্ষেত্রেই অনুভব করেন বিশেষ সহমর্মিতা। বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় অনুরূপ মনোভঙ্গী, যাকে বাদ দিয়ে তার ইতিহাস, সমাজ জীবন ও রাজনীতির বৃহত্তর ধারাকে সার্বিকভাবে উপলব্ধি করা যায় না।

[1] H. A. R. Gibb, Mohammadanism (The New American Library. New York, 1935) P. 72.

[2] অনেকে মনে করেন এ রকম বিবাহ বংশধারার ক্ষতি করে। বিস্তু ক্ষতি কেবল সেই ক্ষেত্রেই হতে পারে যেখানে বংশগত কোন বিকৃতি থাকে, অন্যথায় নয়। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ হতে দেখা যায় নওগাঁর পোড়শাতে। কিন্তু সেখানে এর জন্যে কোন ক্ষতি হবার কথা জানা নেই।

[3] দ্রষ্টব্য The Oxford History of India (1967). PP. 647-648.

[4] K.M. Sen, Hinduism (Penguin Books, Middlesex, 1961) P. 109.

[5] D. E. Sopher, Geography of Religions. p. 78. [ In the Sixteenth Century Coalition of Muslim powers made an abortive attempt to eject the treading Portuguese from the Indian Ocean, which previously had been virtually an Islamic Sea. It was the lost significant action of the kind]

[6] আফগানীকে ১৮৮২ সালে ইংরাজরা ধরে এনে কলকাতায় কিছু দিন অন্তরীণ করে রাখে। এ সময় তাঁর সম্বন্ধে এদেশের মুসলমানদের একাংশে জানবার বিশেষ কৌতুহল জাগে। তার সম্বন্ধে বাংলায় বই লেখা হয়। ইংরাজ সরকার সে বই বাজেয়াপ্ত করে।

[7] লেখক তাঁর ছেলেবেলায় একজন মুসলমান অধ্যাপকের কথা জানতেন, যিনি মনে করতেন ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ গ্রহণ অন্যায়। ইসলামী বিশ্বের অন্যত্র অনুরুপ ধারণাই প্রচলিত ছিল। সিরিয়া ও মিসরে অনেক ধর্মপ্রাণ মুসমান নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকে টাকা রাখলেও সূদ গ্রহণে রাযী হতেন না। মিসরের একজন খুব ধনী ব্যক্তি, যার গচ্ছিত অর্থের সূদ হত কয়েক হাযার পাউণ্ড, তিনি তা গ্রহণ না করে মিসরের জাতীয় ব্যাংককে দিয়ে দিতেন।

দ্রষ্টব্যঃ E.Atiyh: The Arabs, (Penguin Books, Middlesex, 1953 ). pp. 28–29.

[8] Edward Montet: L. Islam, (Payat and Co., Paris. 1921) PP.51-52.

[9] Census of India, 1901, Vol, VI, Part 1. PP. 179-180.

[10] S. M. Zwemer, The Influence of Animism In Islam (Central Board of Mission, London. 1920), PP. 214-215.

[11] বাংলায় চলতি কথায় কোন কিছুর তত্ত্ব বা সন্ধান না পাওয়া গেলে বলি “বিষয়টার হদিস মিলছে না”। এ থেকে সম্ভবত অনুমান করা চলে, এদেশের সমাজ জীবনে এক সময় ছিল হাদীসের প্রভাব।

[12] সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়-জাতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য, (মিত্র এন্ড ঘোষ, কলকাতা, ১৩৪৫ অব্দ) পৃঃ ২৫-২৬।

[13] Philip K. Blit, Islam and the West. p. 44

[14] The Encyclopaedia of Philosophy (Ed, p. Edward) Vol 8 .p. 41 (Colller-Macmillan Ltd. London, 1967)

[15] Abdul Karim, Social History of the Muslims in Bengal, Asiatic Society. Dacca. 1959) P. 159.

[16] P.K. Hitti, History of the Arabs (Macmillan Second, Edition, London 1970) pp. 438, 740-741.

[17] W.W. Hunter, The Indian Musalmans (1871). Chapter-1

[18] ১৮৩৮ সনের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে আদালতের ভাষা ছিল ফারসী। ১৮৩৮ সাল থেকে ইংরেজীকে আদালতের ভাষ্য করা হয়। কম করে এখনও বাঙলা ভাষায় আড়াই হাযারের কিছু উপরে আরবী, ফারসী ও তুর্কী শব্দ চলে। এই সব শব্দ বাঙলা ভাষা এসেছে প্রধানত ফারসী ভাষার মাধ্যমে। বাংলাদেশে নামটাও প্রাচীন বঙ্গ নামের ফারসী রুপ। বঙ্গের সঙ্গে ফারসী ‘আহ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে উদ্ভূত হয়েছে। মুসলমান আমল থেকেই দেশটিকে এই নামে ডাকা হতে থাকে। মধ্যযুগে বলা হত বঙ্গালহ বা বঙ্গালা।

[19] জাতীয়তাবাদের ধারণা ইউরোপে যেভাবে বিকাশ লাভ কমেছে, মুসলিম বিশ্বে ঠিক সেভাবে করেনি। এ বিষয় অনেক মুসলমান দেশের ধারণা বেশ কিছুটা স্বতন্ত্র।

দ্রষ্টব্য Maurice Duverger, The Idea of politics (Methuen and Co, London, 1965), P. 80

সূত্রঃ বাংলাদেশে ইসলাম, রচনায়: ডক্টর এবনে গোলাম সামাদ।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button