বাংলার সংস্কৃতিঃ মুসলিম উপাদান

নৃতত্ত্বে সংস্কৃতি (Culture) কথাটিকে খুব ব্যাপক অর্থে প্রয়োগ করা হয়। মানুষ যা কিছু সৃষ্টি করেছে, প্রকৃতির কাছ থেকে পায়নি, তার মোট রুপ হলো সংস্কৃতি। কিন্তু সাধারণভাবে সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি, যা আমাদের মনের তৃপ্তি বিধান করে। বেঁচে থাকার সমস্যা সব প্রাণীরই আছে। কিন্তু অন্য প্রাণীর জীবনে একটা সমস্যা নেই, তা হলো সময় কাটাবার সমস্যা। মানুষের জীবনে এ সমস্যা আছে। তাই সে রচনা করেছে গল্পকাহিনী, গেয়েছে গান। কোন সমাজ জীবনই সংস্কৃতিবিহীন নয়। কারণ, সময় কাটাবার সমস্যা সব সময়ই রয়েছে।

বাংলার মুসলমান সমাজেও রচিত হয়েছে অনেক গল্প-কাহিনী, যা ছড়িয়ে আছে গ্রাম বাংলায় নানাভাবে। এসব কাহিনী সম্পর্কে শিক্ষিত পাঠক সমাজের দৃষ্টি প্রথম বিশেষভাবে আকর্ষণ করেন দীনেশ চন্দ্র সেন। তিনি তাঁর সম্পাদিত ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র ভূমিকায় বলেছেন, প্রথম যখন তিনি এ ব্যাপারে উৎসাহ দেখাতে আরম্ভ করেন, তখন অনেক ইংরেজী শিক্ষিত হিন্দু তাঁকে উপহাস করে বলেন : ছোট লোকেরা, বিশেষত মুসলমান চাষারা এ সব কাহিনী শোনে। এ সব পালাগানের মধ্যে কি এমন থাকতে পারে, যাতে তাঁর মত একজন উচ্চ শিক্ষিত লোকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে।[1] কিন্তু এই সব কাহিনীর মধ্যে যে সাহিত্য উপাদান বর্তমান তা আজ আমাদের বিস্মিত করে। এসব কাহিনী ঠিক লোক সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে না। একে বলতে হয় বাংলার একটা যুগের সাহিত্য, যা গৌরব করবার মত।

এ সব কাহিনীর রচকাদের নাম সব ক্ষেত্রে পাওয়া না গেলেও অনেক ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। যেমন, ‘দেওয়ান মদীনা’র রচক মনসুর বয়াতি। ‘ছুরত জামালের’ রচক অন্ধ কবি ফকির ফৈজু। এ সব কাহিনীর রচনা করা হয়েছে সাধারণ পয়ার ছন্দে, ভাষা ও উপমায় জটিলতা নেই। কিন্তু এর মধ্যে ফুটে উঠেছে নর-নারীর প্রেম, মায়ের স্নেহ-মমতা, সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রাম, সেকালের সওদাগরদের সমুদ্র যাত্রা, হার্মাদদের আক্রমণ, ঝড়-বাতাসে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মহামারী ও দুর্ভিক্ষ। জীবনকে এসব কবিরা দেখেছেন অনেক গভীরভাবে, অনেক কাছে থেকে। বাঙলা ভাষায় উপন্যাস লেখা আরম্ভ হয় ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ হতে। কিন্তু এ সব কাহিনীর মধ্যে পাওয়া যায় উপন্যাসের উপকরণ। এ সব কাহিনী থেকে ছয়টিকে বেছে নিয়ে দীনেশ চন্দ্র সেন গদ্যে লেখা গল্পের আকারে কবিতার অংশ বিশেষ উদ্ধৃতিসহ ১৯৩৯ সালে প্রকাশ করেন পুরাতনী নাম দিয়ে। কাহিনীগুলোর বয়স, তখনই তার হিসেবে ছিল প্রায় তিনশ বছর।[2] বইটির ভূমিকায় তিনি এই কাহিনীর রচকদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বলেন, এরা বিশ্ব সাহিত্যে স্থান পাবার যোগ্য। মুসলমান গ্রাম্য কথকরা এ সব পালাগান রচনা করবার সময় কোথাও কঠিন সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেন নি। অন্যদিকে মুসলমান সমাজে বহুল প্রচলিত অরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহারেও দেখান নি আড়স্টতা। ভাষা ও কাহিনী উভয় দিক থেকেই এর মধ্যে রূপ নিয়েছে এ দেশের মুসলিম সমাজ চিত্র, যা সাহিত্য কর্ম হিসেবে আবার হতে পারে সকলেরই উপভোগের বিষয়।

এই সাহিত্য অন্য প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের মত ধর্মাশ্রয়ী নয়। এর মধ্যে নেই কোন দেব-দেবীর গুণকীর্তন। নেই বৈষ্ণব সাহিত্যের মত পরকীয়া প্রেমের মাহাত্ম্য প্রচার। মুসলমান সাহিত্যিকরা ধর্মীয় কারণেই এসব করা থেকে সাধারণম্ভাবে থাকতে চেয়েছেন বিরত। ফলে মানুষের সংগ্রামমুখর সুখ-দুঃখময় জীবনই হয়েছে সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য। তাঁদের ধর্ম চেতনা, তাঁদের অনেক পৃথক পথে পরিচালিত করেছে গল্প-কাহিনীর রচনার ক্ষেত্রেও।

বাংলাদেশ তার পল্লী সঙ্গীত নিয়ে গৌরব করে। এই সঙ্গীত প্রসংগে বলতে গিয়ে বিখ্যাত লেখক, সমালোচক ও সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ নীরোদ চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, এই গানের ঐতিহ্য ও ধারা আলাদা, এই গানের সুরের পেছনে আছে আরবী গানের প্রভাব, যার মূলে আবার কাজ করেছিল প্রাচীন গ্রীক সঙ্গীতের ধারা। আরবীতে সঙ্গীতকে বলে ‘মুজিক’। শব্দটা আরবী ভাষায় এসেছে গ্রীক ভাষা থেকে।[3] চৌধুরীর মতে, এক সময় স্পেন ছিল আরবদের দখলে। এ সময় স্পেনের গানে ব্যাপকভাবে পড়ে আরব প্রভাব। তুর্কীরা গানের ক্ষেত্রে আরবদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখে। তুর্কীরা করে বলকান সহ গ্রীস দখল। এর ফলে গ্রীসের গানে, বিশেষ করে লোকসঙ্গীতে পড়ে তুর্কী এবং তুর্কীর মাধ্যমে আরবী প্রভাব। স্পেনের চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীর ল্যাটিনো ডায়লেকট-এর গান, গ্রীসের লোকসঙ্গীত এবং পূর্ব বাংলার গানের সুরে তাই পাওয়া যায় বহুবিধ মিল। পূর্ব বাংলার লোকসঙ্গীত, তাঁর মতে, মুসলমানী। এর স্টাইল স্পেন থেকে পূর্ব বঙ্গ পর্যন্ত এক। নীরোদ চৌধুরী তাঁর সিদ্ধান্তে এসেছেন এ সব দেশের গানের রেকর্ড বাজিয়ে নিজ কানে শুনে সুরের বিচার করে। কোন ঐতিহাসিক বিবরণের উপর নির্ভর না করে।[4] বাংলার সংস্কৃতিতে মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় নি ৷ এ সম্পর্কে প্রচলিত ইতিহাস বই থেকে জ্ঞান লাভ করা সহজ নয়। তবে এখন বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে যেয়ে এ ব্যাপারে কিছু কিছু আলোচনা হচ্ছে। আমরা এ-বইয়ের একটি প্রবন্ধে বাংলাদেশে ইসলামী শিল্পকলা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, মধ্যযুগে বাংলার স্থাপত্য শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায় মুসলমান সুলতানের নির্মিত মসজিদ ও সমাধি-ভবনে। আমাদের মতে, ঐতিহাসিক পটভূমিতে বিচার করলে বলতে হয়, বাংলার সংস্কৃতিতে মুসলিম উপাদান গৌণ নয়, গল্প-কাহিনীর ধারায়, গানে, স্থাপত্যে ঘটেছে তার বহুমুখী বিভিন্ন প্রকাশ।

বাংলাদেশে ইসলামী শিল্পকলা

শিল্পকলার ইতিহাসে ইসলামী শব্দটা বিশেষ অর্থে (Technical Sense) ব্যবহার করা হয়। ইসলামী বিশেষণটা কেবলমাত্র ধর্মীয় অর্থ বহন করে না। ইসলামী শিল্পকলায় রয়েছে কতগুলো সাধারণ লক্ষণ, যার সাহায্যে তাকে চিহ্নিত করা চলে। ইসলামী শিল্পকলা বলতে বোঝায় এই বিশিষ্ট লক্ষণযুক্ত শিল্পকলাকে। অনেকে এই একই অর্থে প্রয়োগ করেন মুসলিম  শব্দটিকেও।[5]

আরবদের (হিজায এর অধিবাসীদের) কোন উল্লেখযোগ্য শিল্পকলার ঐতিহ্য ছিল না। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওফাতের (৬৩২ খৃঃ) আশি বছরের মধ্যে আরব মুসলমানগণ অধিকার করেন ইরাকসহ পারস্য, মিসর, সিরিয়া, মধ্য এশিয়ার পশ্চিম ভাগ, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ স্পেন। পারস্য, মিসর, সিরিয়ায় ছিল সুসমৃদ্ধ শিল্পকলার ঐতিহ্য। এক সাম্রাজ্য ও ধর্মমতের আওতায় আসবার ফলে এই সব দেশের শিল্পকলার মধ্যে ঘটতে থাকে বিশেষ সংশ্লেষণ, উদ্ভব হয় ইসলামী শিল্পকলার।

ইসলাম ধর্ম এই সমন্বয় প্রক্রিয়াকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছিল, প্রদান করেছিল ঐক্য। তাই ইসলামী শিল্পকলার বৈশিষ্ট্যের বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে এসে যায় ইসলাম ধর্মের কতগুলো বিশেষত্বের কথা যা শিল্পকলার ইতিহাসের ছাত্রদেরও সাধারণভাবে জানতে হয়। ইসলামী সমাজ জীবন কুরআন ও হাদীস-নির্ভর। কুরআন-এ মানুষ ও জীবজন্তুর মূর্তি গড়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে (সূরা ৫, আয়াত ৯২)।[6] সহীহ হাদীসেও (বুখারী দ্রষ্টব্য) মানুষ ও জীবজন্তুর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এমনি নিষেধ অন্যান্য একেশ্বরবাদী ধর্মেও আছে। বাইবেল-এর প্রাচীন কান্ডে (তাওরাত) বলা হয়েছে :

তোমরা মূর্তি গড়বে না, ছবি আঁকবে না, আকাশ ও মর্তের বাসিন্দাদের, জলচর প্রাণীদের, অথবা যারা আছে পাতালে। তোমরা এদের সম্মুখে প্রণত হবে না—করবে না উপাসনা (Old Testament. Ex 20, 4-5)।” ইয়াহুদী, খৃস্টান ও মুসলমান–এই তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মেই জীবজন্তু, মানুষ, দেব-দূত ইত্যাদির ছবি আঁকবার বিপক্ষে বলা হয়েছে। কিন্তু ইসলাম ধর্মে এই বিধি-নিষেধ যতটা নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিপালিত হয়েছে, অন্য দুটি ধর্মে তা হয় নি। বিশেষ করে খৃস্টধর্মের ক্ষেত্রে। অন্যতম এই কারণেই, মুসলমানরা খৃস্টানদের বলেছেন নাসারা বা পথভ্রষ্ট। খৃস্টধর্মের মত শিল্পকলাকে ইসলাম ধর্ম প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে কখনও ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়নি, চেষ্টা হয়নি ইসলামকে সচিত্র করবার।

ইসলামী শিল্পকলার মূলসূত্র

ইসলামী শিল্পকলার প্রাণবন্ত হলো স্থাপত্য। ইসলামের দৃষ্টিতে একাকী প্রার্থনা করার চাইতে বহুজনে একত্র হয়ে প্রার্থনা করা শ্রেয়। অনেকে একত্র হয়ে প্রার্থনা করার প্রয়োজনে নির্মাণ করতে হয়েছে মসজিদ (মাসজিদ)। মসজিদকে সুন্দর করে গড়তে গিয়ে, তাকে কারুকার্য খচিত করতে গিয়ে, জন্ম নিয়েছে মুসলিম জনসমাজের শিল্পচেতনা। পরে এই চেতনা পরিব্যাপ্ত হয়েছে অন্যান্য শিল্পকর্মেও।

আরবরা সাধারণত বাস করত তাঁবুতে। মক্কা ও মদীনার মত শহরে বাড়ীঘর ছিল খুব সাধারণ। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) প্রথম মসজিদ নির্মাণ করান মদীনায় (৬২২ খৃঃ)। এই মসজিদ কোন শিল্পকর্মের নিদর্শন ছিল না। এ ছিল ইট ও পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটা স্থান। এই একচালা মসজিদের এক পাশ ছিল খেজুর গাছের খুঁটির উপর স্থাপিত। এর চাল ছিল খেজুর পাতার মাদুর দিয়ে তৈরী এবং উপরিভাগ ছিল কাদামাটি দিয়ে লেপা। চালার নীচে নবীজি নামায (সালাত) পড়াতেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মৃত্যুর পর একশ’ বছর গত না হতেই আরব মুসলমানদের নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় জেরুযালেমের বিখ্যাত সৌধ কুব্বাতউস সাখরা বা পাষাণ গম্বুজ (Dome of the Rock) এবং এর কিছু পরে নির্মিত হয় দামিশকের বড় মসজিদ। এই নির্মাণের কাজে আরবরা নিশ্চয়ই নিয়োজিত করেছিলেন বাইজেন্টাইন ও প্রাচীন পারস্যের সাসানীয় শিল্পধারার সঙ্গে পরিচিত কারিগরদের। কিন্তু দামিশকের বড় মসজিদ দেখলেই বোঝা যায়, একটা স্বতন্ত্র ইসলামী ধারা রূপ নিতে আরম্ভ করেছে। স্থাপত্যকে বাদ দিলে ইসলামী শিল্পকলায় যা থাকে তা হলো অলঙ্করণ বা নকশা (decoration)। ইসলামী শিল্পকলা প্রধানত চেয়েছে কোন কিছুর বহির্ভাগকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে (Surface decoration)। এই শিল্প বিশেষভাবেই মন্ডনশিল্প। বক্তব্য বা বিবরণ প্রধান শিল্প নয়।

ইসলামী শিল্পকলা কেন এভাবে এগোতে গেল, তার ব্যাখ্যা দিতে যেয়ে বলা হয়, যেহেতু ধর্মীয় বাধা ছিল তাই ইসলামী শিল্পে জীবজন্তু ও মানুষের মূর্তি গড়া বাদ পড়েছে। বাদ পড়েছে ছবি আঁকা। শিল্পীরা প্রধানত ঝুঁকে পড়েছেন বিমূর্ত নকশাকলার দিকে। কিন্তু ধর্ম দিয়ে ইসলামী শিল্পকলার বৈশিষ্টোর অনেকখানি ব্যাখ্যা পাওয়া গেলেও, পূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব হয় না। কারণ ইসলামে গাছপালা ও বাড়িঘরের ছবি আঁকবার ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তথাপি মুসলিম সমাজে কোন বিশুদ্ধ ভূ-চিত্র (Landscape) আঁকবার চেষ্টা করা হয় নি। এখানে শিল্পকর্ম এগিয়েছে কেবল বিমূর্ত (abstract) নকশাকার পথে। কোন দেশেই মুসলিম সমাজে সাধারণভাবে বাস্তবানুগতা (Realism) শিল্প স্থান করে নিতে পারে নি। উৎসাহ পায়নি। অনেকের মতে, ইসলামী শিল্পকলার মূলে বিশেষভাবে আছে মরুচারী মানুষের জীবনধারার প্রভাব। মরুভূমির মানুষ প্রধানত বাস করে তাঁবুতে। এই জীবনে আসবাব-পত্র ব্যবহারের বিশেষ সুযোগ নেই। তারা আসবাবপত্র ব্যবহারের পরিবর্তে ব্যবহার করে সুন্দর করে বোনা গাল্পিচা, যাতে সঙ্গত কারণেই জ্যামিতিক ও লতাগুখের নকশা পায় প্রাধান্য। মসজিদের দেয়ালের গায়ের কারুকাজ হয়েছে কিরঘিজ গালিচারই মত।[7]

ইসলামী নকশাকলা

ইসলামী নকশাকলার (decoration) উপাদান চারটি :

ক. ফুল-লতা-পাতা ; খ, জ্যামিতিক আকার-আকৃতি। গ, আরবী বর্ণ-মাত্রা এবং ঘ. উজ্জ্বল অবিমিশ্র রঙ।

ফুল-লতাপাতার মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে পাক খাওয়া আঙ্গুর লতা। এ রকম পাক খাওয়া লতা নকশাকে সাধারণত বলে আরাবেসক (Arabesque)। জ্যামিতিক আকার-আকৃতির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বরফি, বৃত্ত, ত্রিভুজ ও বহুভুজ। ইসলামী শিল্পকলায় রঙের প্রয়োগ করা হয়েছে কোন কিছুকে কেবল সুন্দর দেখাবার জন্যে, বাস্তব জগতের কোন কিছুর সঙ্গে সাদৃশ্য দেখাতে নয়। রঙ সাধারণত স্বাভাবিক কোন কিছুর রঙ-এর অনুকরণে প্রয়োগ করা হয়নি।

আরবী বর্ণমালাকে কেন্দ্র করে ইসলামে উদ্ভব হয়েছে এক সুসমৃদ্ধ লিপিকলার (Calligraphy)। লিপিকলার উপর ইসলামে দেখান হয়েছে বিশেষ অনুরাগ। কারণ, কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা মানুষকে লেখনীর সাহায্যে জ্ঞান দান করেছেন (সূরা ৯৬, আয়াত ৪)। কুরআনের আয়াতগুলো সুন্দর করে লেখা হয়েছে মসজিদের দেওয়ালের গায়, যাতে করে ধর্মের মূল কথাগুলো সহজেই মানুষের মনে গেঁথে যেতে পারে। ইসলামের পতাকাতলে ফারসী ও তুর্কী ভাষাও গ্রহণ করে আরবী বর্ণমা (তুর্কী এখন লেখা হয় রোমান অক্ষরে)। প্রধানত ইরানেই আরবী বর্ণমালা লাভ করে বহু বিচিত্র ও নন্দন-সমৃদ্ধ রূপ।[8] পারস্যের শিয় ঐতিহ্য ছিল আরবদের চাইতে বইগুণে উন্নত। ইসলামের আবির্ভাবের হযরি বছর আগেই ঘটেছিল তার বিকাশ। এই শিল্প ঐতিহ্য মুক্ত হয়ে যায় ইসলামী ধারায়।

বাংলার পটভূমি

বাংলাদেশ ছিল ইসলামী সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র গুলো থেকে অনেক দূরে। আরবরা কখনও এদেশ জয় করেন নি। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের ও শিল্পকলার প্রভাব এসে পৌছতে থাকে খৃীস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে, ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের পর হতে। বখতিয়ার ছিলেন মধ্য এশিয়ার একজন তুর্কী সেনানায়ক। তিনি মধ্য এশিয়া ছেড়ে এই উপমহাদেশে আসেন ভাগ্যানুসন্ধানে। তিনি বাংলাদেশের অংশ বিশেষ জয় করেন ১২০২ খৃষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে। বাংলায় তাঁর সময়ই প্রথম নির্মিত হয় মসজিদ, মাদ্রাসা এবং খানকা। বাংলাদেশের বাইরে থেকে যেসব মুসলমান আসেন তারা অধিকাংশ ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কী বা তুরানী মানবধারার লোক। আরবরা মধ্য এশিয়ার পশ্চিম ভাগ দখল করেন খৃষ্টীয় অষ্টম শতকে (সমরখন্দ দখল করেন ৭১২ খ্রীঃ) এই অঞ্চলের লোক ইসলাম গ্রহণ করেন এবং এই অঞ্চন্ত্রে বুখারা ও সমরখন্দ শহরকে কেন্দ্র করে মুসলিম চিন্তা ও সভ্যতার ঘটে বিশেষ বিকাশ। এই অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন একাধিক বিখ্যাত মনীষী। বিখ্যাত হাদীস সংকলক মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারীর জন্ম হয় বুখারায় এবং তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সমরখন্দে। বিখ্যাত চিকিৎসক ও দার্শনিক ইবনে সিনার জন্ম হয় বুখারায়। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও গণিতবিদ আল-খারিযমীর জন্ম হয় খিভায়। তাই মধ্য এশিয়া থেকে এদেশে যারা এসেছিলেন, তাঁরা কেবল সৈনিকই ছিলেন না, তারা ছিলেন তুলনায় একটা উন্নত সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী। তাঁরা সঙ্গে করে এনেছিলেন একটা সমৃদ্ধ সভ্যতার নানা দান, যা বাংলার জনসমাজকে করেছিল বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে চেঙ্গিস খান সমস্ত মধ্য এশিয়ার তুর্কী রাজ্যের উপর হামলা চালান। এ সময় এই অঞ্চল থেকে দলে দলে তুর্কী মুসলমান প্রথমে এসে আশ্রয় নেন উত্তর ভারত ও পরে আসেন বাংলায়। এ ছাড়া পরবর্তীকালে দিল্লীতে বিভিন্ন তুর্কী রঞ্জবংশের উত্থান-পতনের সময় বিতাড়িত হয়ে অনেক সম্ভ্রান্ত (elite) তুর্কী মুসলমান পরিবার এসে আশ্রয় নেন বাংলায়। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন শিক্ষিত জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি। অনেকেই ছিলেন সুদক্ষ কারিগর এবং বাণিজ্যপটু সওদাগর। এঁরা বাংলার অর্থনীতিতে রেখেছিলেন বিশেষ অবদান। এজন্য বাংলার অর্থনীতিতে আসে একাধিক পরিবর্তন। বৌদ্ধ পালরাজাদের সময়কার (আনুমানিক ৭৫০-১০৭৫ খৃঃ) মুদ্রা বিশেষ পাওয়া যায়নি। পালদের পর বাংলাদেশে রাজত্ব করেন কর্ণাটক থেকে আগত আচারনিষ্ঠ বিদেশী গোঁড়া ব্রাহ্মন ক্ষত্রিয় সেন রাজারা। সেন রাজাদের আমলের (আনুমানিক ১০৯৫–১২০২ খৃঃ) কোন মুদ্রা এ পর্যন্ত বিস্তৃত হয় নি। এ সময় কেনাবেচা চলত কেবল মাত্র কড়ির মাধ্যমে। কিন্তু তুর্কীরা আসবার পর এদেশে আবার ব্যাপকভাবে মুদ্রার প্রচলন হয়। মুসলমান যুগের বাংলার প্রত্যেক স্বাধীন সুলতানই তাদের নিজ নামে মুদ্রা অঙ্কিত করেছেন। অনেক এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন বাগদাদের ছায়া খলীফাদেরও নাম। অর্থাৎ এ যুগের মুসলিম নৃপতিগণ খলীফাকে স্বীকার করতেন। এ সময় টাকার মাধ্যমে বাণিজ্যের ফলে এদেশের অর্থনীতি পায় নতুন কাঠামো। আসে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশেষ সচ্ছলতা। ফলে গড়ে উঠতে থাকে অনেক শহর বা কসবা। সৃষ্টি হয় শিল্পকার, বিশেষ করে স্থাপত্য জন্যে অনুকূল পরিবেশ। ইসলামী শিল্পকলার মূল বিষয় স্থাপত্য।

বাংলাদেশের ইসলামী শিল্পকলা বলতেও মূলত বোঝায় স্থাপত্যকেই! তুর্কীরা এদেশে বাইরে থেকে নিয়ে আসেন গম্বুজ, প্রকৃত সুঁচাল খিলান (Pointed arch), খিলান করে ছাদ তৈরী এবং মিনার বানাবার রীতি। এর সঙ্গে মেশে বৌদ্ধ স্থাপ্যতার ধারা। বৌদ্ধ স্থাপত্যের প্রভাবে মসজিদের গম্বুজগুলো পায় বিশেষ ধরনের অর্ধ গোলক আকৃতিরূপ (Hemispherical) যার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বৌদ্ধ স্তূপের।

বাংলাদেশে ছিল মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের (সহজিয়া রূপের) প্রবল প্রভাব। এদেশে বাইরে থেকে তুর্কী মুসলমানরা আসবার আগে চলেছিল বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ দ্বন্দ্ব। সেন রাজাদের আমলে ব্রাহ্মণদের বহু ভূমি দান করা হয়। ব্রাহ্মণরা হয়ে ওঠেন এদেশে ভূস্বামী শ্রেণী। অন্যদিকে বৌদ্ধরা হয়ে ওঠেন সাধারণ কৃষক প্রজা। ভূস্বামী ও কৃষক প্রজার অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্বও রূপ নেয় ধর্মীয় বিরোধ হিসেবে।

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস এখনও যথেষ্টভাবে লিখিত হয়নি। তবে ভাববার মত সঙ্গত কারণ আছে যে, এদেশের বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণ করতে থাকেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্যে তাদের উপর কোন প্রকার বল প্রয়োগের প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুলতানী আমলে (১২০০ – ১৫৩৮) বাংলায় অমুসলমানদের কাছ থেকে কোন জিযিয়া কর আদায় করা হত বলেও উল্লেখ মেলে না। তাই ধরে নিতে হয় স্বেচ্ছায় তাঁরা ইমাম গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছিলেন।

আরব বণিকেরা সম্ভবত বহুকাল আগে থেকেই এদেশে আসতেন। আর তাঁরা এদেশের মানুষের কাছে পরিচিত হতেন শেখরূপে। ক্ৰমে শেখ এবং মুসলমান শব্দ দুটি হয়ে দাঁড়ায় সমার্থক। বাংলাদেশের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মুসলমনি তাঁদের নামের শেষে এখনও শেখ লেখেন। যে সব বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করেন তারাও সম্ভবত পরিচিত হতে থাকেন শেখরূপে। বাংলায় বৌদ্ধদের ইসলাম গ্রহণের মূলে যে কেবলমাত্র কাজ করেছে হিন্দু বৌদ্ধ বিরোধ, তা বসা যায় না। কারণ, ত্রয়োদশ শতক থেকে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতেও দলে দলে বৌদ্ধ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। ইসলাম এখন এই দুই দেশের প্রধান ধর্ম। প্রথমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে সুমাত্রা ও আভায়। পরে সেখান থেকে মালয়েশিয়া হয়ে পৌঁছায় ফিলিপাইনের মিন্দানাও-এ।

বাংলার মানুষের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের যোগাযোগ ছিল কাছের। তাই এই অঞ্চলের কোন প্রভাব বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছিল কিনা তা সঠিকভাবে বলা যায় না। কিন্তু যেভাবেই হোক, বাংলাদেশে বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণের ফলে এদেশের সনাতন বৌদ্ধ স্থাপত্যের ধারার সঙ্গে অনেক সহজেই মিলে যেতে পারে মধ্য এশিষ্মী থেকে আসা তুর্কী ইসলামী শিল্প ধারা। সৃষ্টি হতে পারে বাংলাদেশের একটা নিজস্ব স্থাপত্য রীতি। অবশ্য এই উপমহাদেশের অন্যত্রও ঘটেছে বৌদ্ধ স্থাপত্যের সঙ্গে মধ্য এশিয়া থেকে আসা স্থাপত্যের সমন্বয়। তবে বাংলার ক্ষেত্রে এটা হতে পেরেছে, অনেক সহজ ও ব্যাপকভাবে।[9]

পোড়া মাটির নকশা

বাংলাদেশের সুলতানী আমলের প্রাচীন মসজিদগুলোর পোড়া মাটির কাজ (Terracotta) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মসজিদের দেয়াল ও মিহরাব সাজান হয়েছে সুনিপুণ নকশা করা পোড়া মাটির ইট বা টাইল দিয়ে। এই নকশীকলা কতটা উৎকর্ষ লাভ করেছিল, তার কিছুটা পরিচয় এখনও পাওয়া যায় রাজশাহীর ২৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব বাঘা নামক গ্রামের মসজিদ থেকে। মসজিদটি বাংলার বিখ্যাত সুলতান নসরত শাহের নির্দেশে নির্মিত হয় (১৫২৩ খৃঃ)। এই সময় এই স্থানটি ছিন্ন ইসলামী শিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্র। অনেক দানেশমন্দ ব্যক্তি সমাবেশ ঘটছিল এখানে। পোড়া মাটির কাঞ্জের ঐতিহ্য এদেশে আগে থেকেই ছিল। প্রাচীন বৌদ্ধ স্তূপে স্থান পেয়েছে পোড়া মাটির কাজ। এসব পোড়া মাটির কাজে (যেমন পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের মধ্যে অবস্থিত স্তুপে) অঙ্কিত হয়েছে মানুষ ও জীবজন্তুর মূর্তি। এসব পোড়া মাটির ফলকে ধরা পড়েছে সেদিনের দৈনন্দিন জীবনের অনেক চিত্র। এতে স্থান পেয়েছে জেল ও গ্রাম্য কৃষকের মূর্তি, সন্তান কোলে জননী, পশু-পাখী প্রভৃতি। এই সব পোড়া মাটির কাজকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি লোক-শিল্প, দ্বিতীয়টি অভিজাত শিল্প এবং তৃতীয়টি এই দুয়ের মাঝামাঝি। পোড়া মাটির শিল্পকলার এই স্থানিক ঐতিহ্য মুসলমানরা পরিত্যাগ করেন নি।

মসজিদের দেয়ালও পোড়া মার্টির নকশা করা ইট দিয়ে সাজান হয়েছে। কিন্তু এইসব ইটের কারুকাজ হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। ধর্মীয় কারণে মসজিদের পোড়া মাটির নকশায় মানুষ ও জীবজন্তু স্থান পায় নি। মসজিদের পোড়া মাটির নকশায় কেবলমাত্র ব্যবহার করা হয়েছে ফুল, লতা, পাতা ও জ্যামিতিক মুদ্রা (Motif)। এইসব নকশার (মনে রাখা ভাল নকশা কথাটা আরবী) পরিমাপও খুব ভেবে চিন্তে করা। এসবের মধ্যে ফুটে উঠেছে এক সুনিপুণ সূক্ষ্ণতা। এগুলো বৌদ্ধ নকশাকার মত অতটা ভারী নয়। এ ক্ষেত্রেও ঘটেছে মধ্য এশিয়া ও ইরান থেকে আগত নকশা মুদ্রা (Motif) এবং এদেশের বহু প্রচলিত নকশা মুদ্রার সমন্বয়। নকশা পরিকল্পনায় আঙ্গুর লতা ও নার্গিসের সঙ্গে গাছের শাখা, লতা, গুম, ফুল। জ্যামিতিক আকার-আকৃতি দিয়ে নকশা এদেশে আগে ছিল অজানা। তুর্কীরাই এই রীতি এদেশে প্রথম প্রচলিত করেন। বরফি ও অন্যান্য আকার পেতে থাকে প্রাধান্য। এছাড়া চোখে পড়ে ঝুলন্ত ফুলের গুচ্ছের মত ঝাড়বাতির নকশা। সাধারণত পুরোনো মসজিদের মিহরাবের ভেতরে এ ধরনের নকশা দেখতে পাওয়া যায়। এই নকশামুদ্রা ইরান ও মধ্য এশিয়া থেকে পাওয়া। ইরান ও মধ্য এশিয়া থেকে এসেছে বিশেষ ধরনের ফিতা নকশা এবং রোজেট। ইসলামী শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার উদ্ভিদীয় ও জ্যামিতিক অলঙ্করণ। বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোতে এর উভয়েরই পরিচয় মেলে। তবে এদেশে জ্যামিতিক নকশার চাইতে উদ্ভিদীয় অলঙ্করণই তুলনায় পেয়েছে বেশি প্রাধান্য। ইসলামী নকশাকার অন্যতম উপাদান হলো আরবী বর্ণমালা। বাংলাদেশের মসজিদের মণ্ডনে (Decoration) আরবী বর্ণমালা যথেষ্ট ব্যবহৃত হয় নি। তবে গৌড়ে উদ্ভব হয় আরবী লেখার এক বিশেষ ধাঁচ, যাকে সাধারণত উল্লেখ করা হয় ‘তুঘরা’ বলে। বিভিন্ন প্রাচীন মসজিদে এবং গৌড়ের কদম রসূলে এই লিপির পরিচয় পাওয়া যায়। এই লিপির বৈশিষ্ট্য হলো বিশেষ মাত্রায় লম্বা খাড়া খাড়া টান যা অক্ষরেরই অংশ। তুঘরা লিপি বিশেষভাবে উৎকীর্ণ করা হয়েছে কালো ব্যাসল্ট পাথরের ওপর। এসব পাথর কেটে লিখতে সাধারণত প্রচুর পরিশ্রম করতে হত।

শিল্পকম নানাভাবেই নির্মাণ উপকরণের উপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে স্থাপত্য। বাংলায় পাথর সহজলভ্য ছিল না। ব্যাসল্ট পাথর আসত রাজমহল পাহাড় থেকে (রাজমহল তখন বাংলার অংশ ছিল)। এই পাথরে রঙ প্রায় কালো, কতকটা বেশি পোড়া ঝামার মত। এ এক রকমের খুব শক্ত আগ্নেয় শিলা। বাংলায় যেহেতু পাথর সহজে পাওয়া যেত না, তাই বাড়িঘর ও মসজিদ নির্মাণের কাজে পাথরের ব্যবহার হয়েছে খুবই কম। অন্যদিকে গঙ্গার পলিমাটি খুব ভাল ইট ও মাটির জিনিস-পত্র তৈরির উপযোগী। মাটি দিয়ে ইট ও অন্যান্য জিনিস বানাতে হলে মাটি যেমন এক দিকে হতে হয় নমনীয় (Plastic), তেমনি আবার তাতে থাকতে হয় যথেষ্ট পরিমাণে বালি। তা না হলে মাটি পোড়ালে তা বেশি সংকুচিত হয়ে ফেটে যায়, গড়ন ঠিক থাকে না। গঙ্গার পলিমাটি একদিকে যেমন নমনীয় তেমনি তাতে থাকে উপযুক্ত মাত্রায় বালি। তাই বাংলাদেশে পোড়া মাটির শিল্পকলা খুব প্রাচীনকাল কেই বিকাশ লাভ করেছে, বাংলার স্থাপত্য প্রধানত হয়েছে ইটের স্থাপত্য। এখনকার মসজিদগুলো সবই প্রায় বানান হয়েছে পোড়া মাটির ইটের সাহায্যে। কেবল সুলতানী আমলে মসজিদে বাবহার করা হয়েছে কিছু পরিমাণ ব্যাসল্ট পাথর। বিশেষ করে অনুচ্চ পিলার হিসেবে। পোড়ামাটির স্থাপত্যে পাথরের স্থাপত্যের সক্ষমতা আনা সম্ভব নয়। তবু বাংলার মসদিগুলোর মধ্যে রয়েছে যে বিশিষ্ট তা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাংলার হরিৎ পরিবেশে বিরাট দীঘির পাশে লাল ইটের মসজিদগুলোকে শ্রী হীন মনে হয় না।

বাঁশের শৈলী

ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে কোন শিল্পই গড়ে ওঠে না। বাংলার মানুষ আগেকার দিনে এখনকার মতই প্রধানত কত খড়ে ছাওয়া বাঁশের বাড়িতে। বাঁশের বাড়ি মানেই অবশ্য তখন সামান্য কুড়েঘর ছিল না। অনেক বাঁশের ঘরকে বানান হত খুবই সুন্দর করে। ঘরের ভেতর খড়ের চালে এবং বেড়ায় নানাভাবে বাঁশের বাতা কেটে লাগান হত ও তাদের রও করা হ’ত। এমনভাবে তাদের লাগান হত যে, তা থেকে ফুটে উঠত নানারকম নকশা। ঘরের মধ্যে বসান হত ছোট ছোট করে কাটা নানা আকৃতির আয়না, যাতে আলো পড়ে ঝলমল করত। খুব যত্ন করে খড় কেটে সুন্দর করে ছাওয়া হত চাল। এ রকম ঘর বানাতে খরচ পড়ত অনেক। আবুল ফজল তাঁর বিখ্যাত ‘আইন-ই-আকবরী’ বইতে বলেছেন, এ রকম ঘর বানাতে অনেক সময় পাঁচ হাজার টাকারও বেশি খরচ পড়ত। পাঁচ হাযার টাকা সে সময়ে ছিল অনেক টাকা। আবুল ফজলের সময় বাংলায় এক টাকায় খাওয়া যেত ৫/৬ মণ চাল।

বাংলাদেশের বাঁশের ঘরের গড়ন প্রভাবিত করেছে সুলতানী আমল্পের মসজিদ স্থাপত্য। যাকে অনেকে উল্লেখ করেছেন, বাংলা বা গৌড়ীয়-রীতির মসজিদ বলে, তা বানান হয়েছে কতকটা বিভিন্ন রকমের খড়ের চারচালা ঘরের অনুকরণে। মসজিদের ছাদও তার কার্নিশ করা হয়েছে কিছুটা খড়ের চালের মত বাঁকা। অনেক ক্ষেত্রে মসজিদের সবকটি গম্বুজ গোল করে বানান হতো না—মাঝের সারির গম্বুজগুলোকে বানান হত খড়ের-ছাওয়া বাঁশের চার-চালা ঘরের মত করে। এর একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত হলো হুসেন শাহের রাজত্বকালে নির্মিত চাপাই নবাবগঞ্জের বিখ্যাত ছোট সোনা মসজিদ। এই অঞ্চল ছিল রাজধানী গৌড়েরই অংশ। এই মসজিদের স্থাপত্য ও নকশাকলা খুবই বিখ্যাত। এই মসজিদের মাঝের সারির তিনটি গম্বুজ অবিকল পড়ে হাওয়া বাঁশের চারচালা ঘরের মত দেখতে। বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের (আনুমানিক ১৪৫০ খৃঃ নির্মিত) মধ্যের সারির গম্বুজগুলোও চারচালা ঘরের মত। এটি একটি বিরাট মসজিদ। খে মনে হয় বিরাট দরবার কক্ষ। মসজিদটির নাম যদিও ষাট গম্বুজ কিন্তু এর সর্বমোট গম্বুজ সংখ্যা হলো সাতাত্তর।

বাংলার এই বাঁশের শৈলী (Bamboo style) কেবল তখনকার বাংলার সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি, অন্যত্রও নীত হয়েছে। উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে কিছুটা পরিবর্তিত রূপে ছড়িয়ে পড়ে এই স্থাপত্য। ফারগুসন-এর মতে এই কুঁড়েঘরের স্থাপত্য রীতি প্রথমে দিল্লীতে ও পরে লাহোরে নীত হয়। তবে এ বিষয়ে মতপার্থক্য আছে।

ইট দিয়ে গাঁথা ইমারতে পাথরের তৈরী ইমারতের স্থাপত্য সূক্ষ্মতা আনা চলে না। নির্মাণ উপকরণ হিসেবে মার্টির ইটের রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা কিন্তু তা সত্ত্বেও ইট দিয়ে তৈরী বাংলার মসজিদগুলোতে বিভিন্নভাবে বৈচিত্র্য আনবার চেষ্টা করা হয়েছে।

বাংলার অনেক মসজিদে কাঠামোগত বৈচিত্র্য আনবার জন্যে এক বিশেষ পদ্ধতিতে দেওয়াল গাঁথা হয়েছে। মসজিদের দেয়ার কোন কোন জায়গার কিছুটা সামনের দিকে বাড়িয়ে এবং কিছুটা পিছনের দিকে সরিয়ে তৈরী করা হয়েছে।

সুলতানী আমলের কোন কোন মসজিদে মিনা করা ইট ব্যবহার করা হয়েছে। মিনা করবার কৌশল আগে এদেশে ছিল অজানা। তবে মিনার কাজ এদেশে খুব বেশি সাফল্য লাভ করে নি।

কুটির দেউল ও মসজিদ স্থাপত্য

বাংলার মন্দিরগুলোকে স্থাপত্য রীতির দিক থেকে মোটামুটি দুভাগে ভাগ করা যায়ঃ রেখ-দেউল এবং কুটির দেউল। রেখ-দেউল এদেশে আগে থেকেই ছিল, কিন্তু কুটির দেউলের যে সব নিদর্শন এখন টিকে আছে তা সবই ষোড়শ শতাব্দীর পরবর্তী সময়ের। প্রাচীন রেখ-দেউল-এর কয়েকটি নিদর্শন পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গে। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনোটির নির্মাণকাজ ধরা হয় খৃস্টীয় অষ্টম শতাব্দী বলে। অনেক সময় রেখ-দেউলকে বলা হয় উড়িষ্যা শৈলীর (Orissan style) দেউল। কারণ, এরকম দেউল উড়িষ্যার খুব বেশি দেখা যায়। এগুলো রথের অনুকরণে তৈরী। সম্ভবত এরকম মন্দিরই ছিল সমস্ত উত্তর ভারতের মন্দির স্থাপত্যের প্রধান নিদর্শন। কিন্তু কুটির-দেউল বাংলার নিজস্ব। এগুলো নির্মিত হয়েছে বাংলার চির পরিচিত বাঁশের ঘরের মত করে। কুটির-দেউলের ছাদের কার্নিশ করা হয়েছে খড়ের চালের মত বাঁকা। এর মূল কাঠামোতেও রয়েছে বাঁশের ঘরের ছাপ। কুটির-দেউলের অনেক সাদৃশ্য আছে সুলতানী আমলের গৌড়ীয় রীতিতে নির্মিত মসজিদের সঙ্গে। অনেকে তাই মনে করেন সুলতানী আমলের মসজিদগুলোতে রয়েছে কুটির দেউলের প্রভাব। কিন্তু এর উল্টো মতও পোষণ করবার যথেষ্ট যুক্তি আছে। ভাবা চলে, কুটির দেউলের স্থাপত্যই হয়েছে সুলতানী আমলের মসজিদ স্থাপত্যের দ্বারা প্রভাবিত। কারণ, সুলতানী আমলের মসজিদের বয়স কুটির-দেউলের চাইতে বেশি। অর্থাৎ মসজিদ তৈরী হয়েছে আগে এবং পরে তৈরী হতে আরম্ভ করেছে কুটির-দেউলগুলো। এখন পর্যন্ত কুটির-দেউলের সর্ব-প্রাচীন যেসব নিদর্শনের সঙ্গে আমরা পরিচিত, তার কোনটিই সুলতানী যুগের মসজিদের থেকে বয়সে বেশি নয়।

শিল্পধারার দিক থেকেও কুটির-দেউলের ওপর মসজিদ স্থাপত্যের প্রভাব দেখানো চলে। তুর্কী মুসলমানেরা এদেশে নিয়ে আসেন প্রকৃত সূঁচাল খিলান তৈরির কৌশঙ্গ। অনেক ক্ষেত্রে এসব সূঁচাল খিলানের তলদেশ হত ছোট পলকাটা (Cusp)। এ রকম খিলান ও পলকাটা খিলানের নিদর্শন মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। কিন্তু পুরান বৌদ্ধ ও হিন্দু স্থাপত্যে এর ব্যবহার দেখা যায় না। কুটির-দেউলে সাধারণত সূঁচাল খিলান ও পলকাটা খিলান ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক কুটির-দেউলের ছাদের উপর নির্মাণ করা হয়েছে গোলাকৃতি গম্বুজ। এই ধরনের গম্বুজ তৈরির কোন নিদর্শনও এদেশের প্রাচীন স্থাপত্যে নেই। এছাড়া মন্দিরের শিখরের উপর পড়েছে মসজিদের প্রভাব। ফারগুসন-এর মতে দিনাজপুরের কান্তনগরের বিখ্যাত মন্দিরের নয়টি শিখরের আটটির উপর আছে মুসলিম স্থাপত্যের প্রভাব (এই শিখরগুলো বর্তমানে নেই, ভেঙে গিয়েছে)। অনেক কুটির-দেউলের দেয়াল সাজান হয়েছে নকশা করা পোড়া মাটির ফলক দিয়ে। আর এসব ফলকের নকশায় দেখা যায় ইরান ও মধ্য এশিয়া থেকে আসা নকশা মুদ্রা (Motif )।[10]

হিন্দু ধর্মের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের অনেক পার্থক্য আছে। হিন্দু ধর্মে পূজা করেন পুরোহিত। মন্দিরের মূল কক্ষে (গর্ভগৃহে) থাকে বিগ্রহ। ভক্তরা বিগ্রহ দর্শন করে চলে যান। অন্যদিকে ইসলামে কোন পুরোহিততন্ত্র নেই। মসজিদে বহু লোক একত্রিত হয়ে একসঙ্গে সারিবদ্ধভাবে প্রার্থনা করেন। ইসলামে ব্যক্তিগতভাবে উপাসনার চাইতে সমবেতভাবে প্রার্থনার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে (সূরা ২, আয়াত ৪০)। কারণ, ধর্ম হলো সমাজ জীবনে ঐক্য ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধির উপায়। ফলে, মসজিদ বানাবার সময় তাকে যে রকম বড় ঘরের মত করে বানাবার প্রয়োজন হয় মন্দিরকে সে রকম করে না। তাই বহু বাঁশের ঘরের মত করে মসজিদ বানাবার জন্যে সম্ভবত মুসলমানরাই প্রথম গ্রহণ করেন উদ্যোগ – পরে মসজিদ স্থাপত্য প্রভাবিত করে মন্দির স্থাপত্যকে। আরবী ‘মসজিদ’ শব্দটার উদ্ভব হয় ‘সিজদা’ শব্দ থেকে। ‘সিজদা’ মানে প্রণত হওয়া। ‘মসজিদ’ শব্দের অর্থ হলো প্রণত হবার স্থান। ইসলামে মসজিদ কেবল প্রার্থনা কেন্দ্রই নয়, শিক্ষা ও সামাজিক যোগাযোগেরও ক্ষেত্র। ইসলামী স্থাপত্যকে অনুধাবন করতে হলে মুসলিম প্রার্থনা রীতি ও সমাজ জীবন সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত থাকতে হয়।

বাংলাদেশে ইসলামী শিল্পকলার ইতিহাস বুঝবার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা হলো আমাদের দেশে প্রচলিত অনেক ইতিহাস গ্রন্থ, যা মধ্য এশিয়া থেকে আগত তুর্কীদের সম্বন্ধে আমাদের মনে খুব নীচু ধারণার সৃষ্টি করে। ধরে নেওয়া হয়—এরা সকলেই ছিল লুটেরা ঘোড়-সওয়ার। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস তা ছিল না। মুঘল পূর্বযুগের স্থাপত্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে যেয়ে অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন : “মোগলের আগে যে সব তুর্কীরা এদেশে আসে তারা তুরস্ক শিল্পকেও সঙ্গে করে আনলে এবং মিলিয়ে দিলে বৌদ্ধ শিল্পের শেষ যে ধারা চলেছিল তার সঙ্গে আজমীর, দিল্লী, জৌনপুর, গৌড়, হায়দারাবাদ, বিজাপুর -এমনি সব স্থান জুড়ে একটা চমৎকার স্থাপত্য শিল্পের আবির্ভাব হলো।” ( বানেশ্বর বক্তৃতা : কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯২১)।

শিল্প ও রাজশক্তি

বাংলাদেশের ইসলামী স্থাপত্যের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, যে সময়টাকে সাধারণত উল্লেখ করা হয় সুলতানী আমল বলে, সে সময়ই গড়ে উঠেছে বাংলার একটা নিজস্ব সমৃদ্ধ স্থাপত্য ধারা। কিন্তু মূঘল আমলে কোন নতুন ধারার উদ্ভব হয়নি। বরং ঘটছে পুরাতন শিল্প শৈলীর অবক্ষয়। মুঘল আমলে ধীরে ধীরে মসজিদের দেয়াল থেকে পোড়া মাটির নকশাকলা বাদ পড়েছে এবং সে জায়গায় স্থান পেয়ে পলেস্তারা করবার রেওয়াজ। মসজিদের গায়ে ও দেয়ালে কেবল রঙ করে তার সৌন্দর্ঘ্য বর্ধনের চেষ্টা করা হয়েছে। এর একটা কারণ রাজনৈতিক। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, “রাজশক্তির সহিত শিল্পের উৎকর্ষের যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে, বাংলার স্বাধীন সুলতানদের যুগের শিল্পের সহিত মুঘল যুগের শিল্পের তুলনা করিলেই তাহা বুঝা যায়। মুঘল যুগে সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল দিল্লী ও ‘আগ্রায় মুসলমান শিল্পের চরম উৎকর্ষ হইয়াছিল। কিন্তু বাংলাদেশ তখন কোন স্বাধীন রাজশক্তি ছিল না; একজুন সুবাদার শাসন করতেন কার্থান্তে তিনি বাংলার বাহিরে স্বদেশে ফিরিয়া যাইতেন। উচ্চ কর্মচারীদের সম্বন্ধেও এ কথা বলা যায়। সুতরাং বাংলাদেশের প্রতি তাহাদের অন্তরর টান ছিল না। তাহা ছাড়া সুবাদার ও উচ্চ রাজকর্মচারীরা কোটি কোটি টাকা এদেশ হইতে লইয়া যাইতেন এবং কোটি কোটি টাকা রাজস্ব স্বরূপ বাংলাদেশ হইতে আগ্রা ও দিল্লীতে যাইত। রাজশক্তির ইচ্ছা ও উৎসাহ এবং ধন-সম্পদের প্রাচুর্য না থাকিলে কোন দেশেরই শিল্পের উন্নতি সব হয় না। মুঘল যুগে বাংলাদেশ পূর্বযুগের তুলনায় এ দুয়েরই অভাব ছিল, সুতরাং শিল্পের উৎকর্ষ বিশেষ কিছু ই নাই।

অবশ্য এ যুগেও বহু সংখক মসজিদ, সমাধি ভবন, স্তম্ভ ও তোরণ নিমিত হইয়াছিল কিন্তু শিল্পের উৎকর্ষ হিসাবে তা উচ্চ স্থান অধিকার করে না।”[11]

বাংলাদেশের ইসলামী স্থাপত্যের ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যায়, হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৮ খৃঃ) ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র নসরত শাহ (১৫১৮-১৫৩২) সময়ই সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল। এঁরা দুজনেই ছিলেন সাহিত্য ও স্থাপত্যের বিশেষ অনুরাগী।

শিল্পকলার ক্ষেত্রে উপযুক্ত পৃষ্ঠপাষকতা (patronage) চিরকালই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে।

প্রসঙ্গ সূত্র

A History of Indian and Eastern Architecture : James Ferguson; (গৌড়ের স্থাপত্যের জন্যে দ্রষ্টব্য Chapter VII এবং কান্তগরের মন্দিরের বর্ণনার জন্যে দ্রষ্টব্য ৪৬৫ থেকে ৪৬৯ পৃষ্ঠা) John Murry, London, 1899.

A History of Fine Art in India and Ceylon, Vincent A. Smith (Chapter XII এবং Chapter XIII) Clarendon Press. Oxford, 1912.

Memoire of Gour and Pandua, M. Abid Ali Khan (Edt. H. E. Stapleton), Bengal Secretariate Book Depot, Calcutta, 1924.

Indian Architecture (Islamic Period) Percy Brown (Chapter VIII) D. B. Taraporevala and Co. Ltd. Bombay. 1942.

Muslim Architecture in Bengal, Ahmad Hassan Dani, Asiatic Society, Dhaka. 1961.

বাংলাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ)। শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার (সম্পাদিত) জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স। কলকাতা, ১৩৮০। বাংলার মধ্যযুগের মুসলিম সমাজ জীবন সম্পর্কে আলোচনার জন্যে দ্রষ্টব্য ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ। শিল্পকলার জন্য দ্রষ্টব্য ষোড়শ পরিচ্ছেদ।

বাংলাদেশের সমস্ত প্রাচীন মসজিদ নির্মাণকাল দেওয়া থাকে হিজরী অব্দে। আমরা এই প্রবন্ধে খৃস্টাব্দ ব্যবহার করছি কেবল আলোচনার সুবিধার জন্যে। খৃস্টাব্দ ও হিজরীর মধ্যে সম্বন্ধ হলো এই রকম।

খৃটাব্দ = ৬২২+ হিজরী (৩*হিজরী/১০০)।

[1] দ্রষ্টব্যঃ দীনেশ চন্দ্র সেন, ময়মনসিংহ গীতিকার ভূমিকা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫২।

[2] দীনেশ চন্দ্র সেন, পুরাতনী (মুসলিম নারী চিত্র), গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স। কলকাতা।

[3] সঙ্গীত সম্পর্কে আরবীতে প্রথম বিশেষভাবে আলোচনা করেন আল-ফারাবী। ফারাবী ছিলেন দার্শনিক, গণিতজ্ঞ এবং চিকিৎসক। তিনি বাঁশী বাজাবার জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি পরিচিত ছিলেন দ্বিতীয় এরিস্টটল হিসেবে। তিনি সঙ্গীত সম্পর্কে যে বই লেখেন, তার নাম হলো, ‘কিতাব আল-মুজিক-আল-কাবীর’। ফারাবী লিখেছেন আরবীতে। কিন্তু তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার লোক এবং রক্তের দিক থেকে তুর্কী। ফারাবী ইউরোপে পরিচিত হন আল ফারাবিয়াস (Alpharabius) রূপে। তাঁর নামে প্রচারিত অনেক গান সূফী দরবেশরা এখনও করেন। ফারাবী ১৫০ খৃস্টাব্দে দামেশকে মারা যান।

[4] দ্রষ্টব্য, কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকা ১৯ জানুয়ারী, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ২৫।

[5] ‘ইসলাম’ শব্দটার উদ্ভব হয়েছে আরবী ‘সালাম’ শব্দ থেকে। সালাম মানে শান্তি। আরবীর চাইতে পুরান সেমেটিক ভাষা হয় (Hebrew) তে সালামকে বলে সালোম। সালোম মানেও শান্তি। মুসলিম শব্দগুলো হলেন ইসলাম শব্দের বিশ্লেষণ। মুসলমান হলো আরবী ‘মুসলিম’’ শব্দের ফারসী রুপ।

[6] আনশ্বর কথাটার বাংলা সাধারণত করা হয় মূর্তি। কিন্তু আরবীতে আনশ্বর বলতে বোঝায় পবিত্র পাথর অথবা পূজোর জন্যে নির্মিত কোন বস্তু।

[7] Islamic Art, Encyclopaedia Britanica (1973), Vol. 12. P-676.

[8] Using Arabic letter, Moslem Persians raised calligraphy to the rank of an almost unique art. “Philip K. Hitti, Islam and the West (New York D. Van Nostrand Company Inc; 1962) pp. 34-35.

[9] আরব মুসলমানগণ যখন খৃস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ার তুর্কীস্থান অঞ্চল জয় করেন, তখন এই অঞ্চলের মানুষ ছিল বৌদ্ধ। ইসলামী স্থাপত্যের সঙ্গে তাই বৌদ্ধ স্থাপত্যের একটা যোগাযোগ আগে থেকেই ঘটেছিল। সূফী ‘ফানা’ ও ‘বৌদ্ধ’, ‘নির্বাণ’ এর ধারণার যে কিছুটা সাদৃশ্য দেখা যায় তার মধ্যেও থাকা সম্ভব বৌদ্ধ প্রভাব। বাংলায় সূফী ভাবধারা এক সময় বিশেষভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। বাংলার বৌদ্ধদের কাছে সম্ভবত সূফী ভাবধারা সহজেই গ্রহণীয় হয়েছিল।

[10] H. Sanyal, Religious Architecture in Bengal, Marg, Vol. XXVII, Nov-1974. pp 31-43.

[11] বাংলাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ), পৃঃ ৪৩৯-৪৪০।

সূত্রঃ বাংলাদেশে ইসলাম, রচনায়: ডক্টর এবনে গোলাম সামাদ।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button