আরব জনতার সংগ্রামী ইতিহাস
ভূমিকা
ইজরেল হলো একটি মূৰ্ত্তিমান অপরাধ এবং এই অপরাধের বিরুদ্ধে যুদ্ধই হলো প্যালেষ্টাইন মুক্তিসংগ্রাম। “রাষ্ট্র” হিসেবে ইজরেলের জন্ম তথা একটি আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্রমান্বয় পুঞ্জীভবন ও রূপ লাভের কাহিনীটি সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ যথেষ্ট ধারণা তথা বর্তমান প্যালেষ্টাইন মুক্তি সংগ্রামের প্রায় শতাব্দীব্যপী পটভূমিকা জানা না থাকলে এই মুক্তি সংগ্রামের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবন ও তার ন্যায্য মূল্যায়ন সম্ভব নয়। প্যালেষ্টাইন মুক্তিসংগ্রামের সমর্থন অথবা বিরোধিতা করতে হবে আবেগগত কারণে নয়, তা করতে হবে নির্লিপ্ত নিরপেক্ষ বুদ্ধি বৃত্তিক বিচারের ভিত্তিতে। আর এইরূপ একটি বিচারের জন্যই ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে ইজরেলের বেআইনী জন্মের কাহিনীর কিছুটা আলোচনা দরকার।
সাধারণতঃ দুটো আন্তর্জাতিক দলীলকে ইজরেলের শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি তথা বৈধতার প্রমাণপত্ররূপে উপস্থাপিত করা হয়ে থাকে; (১) ব্যালফোর ঘোষণা, ২রা নভেম্বর ১৯১৭ সন এবং (২) জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব,…..১৯৪৭ সন। দুটো দলীলের সঙ্গেই জড়িত রয়েছে ন্যায়নীতি ভিত্তিক এক মহত্ত্বের আমেজ ; বৃটেনের ব্যালফোর ঘোষণা আসে এমন এক সময় যখন একটি বিকট বিশ্বযুদ্ধে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা তথা ন্যায়নীতির স্বপক্ষে মরীয়া হয়ে যুদ্ধ করছে বৃটেন— এইভাবে যুদ্ধ করে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা তথা ন্যায়নীতির প্রতীকে পরিণত হয়েছে সে। ন্যায়যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ন্যায়নীতির এই অদম্য ও অজেয় প্রতীকের কাছ থেকে একটি নির্যাতিত জাতির জন্য আশ্রয় সৃষ্টির প্রতিশ্রুতিমূলক ঘোষণাটির সঙ্গে তাই সাধারণভাবে একটি অতিমহত্ত্ব, একটি সন্তসুলভ ন্যায়যুদ্ধের গন্ধ মাখা বলে মনে হয়। আবেগিত কারণে মুসলমানদের ছাড়া আর কারোই এর প্রতি বিরোধিতা দূরে থাক অশ্রদ্ধার মনোভাব পোষণ করাটাও তাই, সাধারণভাবে স্বাভাবিক নয়। এই জন্যই ব্যালফোর ঘোষণাকে স্বীয় শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরে ইজরেলে মুসলিম বিশ্বের বাইরে একটি স্বাভাবিক সহানুভূতি জয় করে ফেলতে সক্ষম হয়।
দ্বিতীয় দলীলটি যেন ইজরেলের বৈধতার প্রশ্নে বাদবাকী কোন সন্দেহ থাকলে তারও নিষ্পত্তি করে ; ১৯৪৫ সনে, নাৎসীবাদের বিরুদ্ধে মরণপন ন্যায়যুদ্ধে বিজয়ী মানবতা ও গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীদের দ্বারা, শান্তি ও আন্তর্জাতিক ন্যায়নীতির অভিভাবকরূপে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বব্যপী একটি বিশেষ সমীহা, সম্মান ও আস্থার পাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। জাতি সংঘের প্রতি বিশ্ব সমাজের আস্থা ক্ষয়ের সূচনা ‘৪৭/’৪৮ এ তখনও ঘটেনি। এমতাবস্থায় জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ডান বাম উভয় পক্ষের সমর্থনে যেই প্রস্তাব পাশ হয়, তার বৈধতা ও ন্যায্যতা সম্পর্কেও সাধারণভাবে বিশ্বব্যপী আস্থাটা ছিল অতি স্বাভাবিক।
এই ভাবে একটি মেকী আমেজ বা “ইমেজের” সুবিধা নিয়ে ইজরেলের “শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি” বা “বৈধতার প্রমাণপত্র” সমূহ তারজন্য একটি অন্যায় অথচ স্বাভাবিক আন্তর্জাতিক সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়। প্রায় আবেগগত কারণেই শুধু, একমাত্র মুসলিম বিশ্ব ছাড়া চাই পুঁজিবাদী, চাই কি সমাজতন্ত্রী—চাই উত্তরের উন্নত বিশ্ব। চাইকি মুসলিম জগতের বহির্ভূত তৃতীয় বিশ্বের বাদবাকী অংশ এমনকি আফ্রিকার বহু অমুসলিম শাসিত মুসলিম রাষ্ট্রই ইজরেলের পক্ষ নিতে থাকে। তুরস্ক ও ইরানের মত মুসলিম রাষ্ট্রও ইজরেলের সহযোগিতায় ব্যপৃত হয়। কারণ ছিল এই যে, ইজরেলের বিপক্ষে টানার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক আইনগত যুক্তিসমূহের অবতারণা না করতে পারায় ঐ কাজ যেখানে হচ্ছিল একমাত্র আবেগকে মূলধন করে, সেখানে ইরান ও তুরস্কের ক্ষেত্রে তাদের জাতীয় আবেগ ঐতিহাসিক কারণেই, ইজরেল প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরবর্ত্তী বছরগুলোতে আরব প্যালেষ্টাইনীদের পক্ষে না ছিল যতখানি, তার চাইতে অধিক ছিল বিপক্ষে। ইরান আর তুরস্ক তখন নিজ নিজ জাতীয়তাবাদে প্রায় নবদীক্ষিতই শুধু নয়, আরব জাতীয়তাবাদী ঘৃণার ফলে রীতিমত প্রত্যক্ষ ক্ষতিগ্রস্তও বটে। ইরানের ক্ষেত্রে যেই ধর্মগত আবেগসম্ভত কারণে প্যালেষ্টাইনীয়দের প্রতি তার সমর্থন থাকবার কথা প্যালেষ্টাইনীয়দের সঙ্গে তার সেই ধর্মগত ঐক্যই ছিল অন্যসকল মুসলিম রাষ্ট্রের তুলনায় শিথিলতম। শিয়া ও পারসিক ইরানের পক্ষে সুন্নী আরব পালেষ্টানীয়দের নিকটবর্ত্তী হওয়া অন্য সকল মুসলিম রাষ্ট্রের চাইতে অধিক কঠিন।
ইজরেলের জন্মের পরপরই তার প্রতি এই যে একটি স্বাভাবিক বিশ্বজনীন সহানুভূতি তার দিকে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। সত্যি কথা বলতে গেলে কি সত্তরের দশক আসবার আগ পর্যন্ত ও প্যালেষ্টাইন সংগ্রামের প্রতি সমর্থন আরব বিশ্ব ও তার বাইরে দুয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রের ভেতরই সীমিত ছিল। আফ্রিকার বহুসংখ্যক দেশ আজও ইজরেলের সঙ্গে অর্থনৈতিক এমনকি সামরিক চুক্তি বন্ধনে আবদ্ধ। ১৯১৭ এবং বিশেষ করে ১৯৭৩-এর মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ। তেল সংকট, কাঁচামাল রপ্তানীকারক ও অনুন্নত দেশসমূহের জোটবদ্ধতাও তাতে আরব রাষ্ট্রসমূহের নেতৃত্বগ্রহণ ইত্যাদি কারণেই শুধুমাত্র অতি সম্প্রতি এইসব রাষ্ট্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইজরেলের বিরুদ্ধে এসে দাঁড়িয়েছে এবং প্যালেষ্টাইন সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সমীহা আরব বিশ্ব ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বে অতি উৎসাহী দু’চারটি দেশের গণ্ডির বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
সমর্থন ও সমীহা একটি মনোগত বিষয়। অর্থনৈতিক বা সাময়িক একটি ভাবগত কারণে সৃষ্ট কোন ‘সমর্থন’ বা ‘সমীহা’কে স্বায়ী করে ধরে রাখতে হলে যা প্রয়োজন তা হলো এই সমর্থনের জন্য একটি প্রকৃতই মানসিক ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। আজ যারা অবস্থার চাপে বা ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সনের যুদ্ধজাত আরবদের প্রতি সাময়িক বা আংশিক আবেগগত সমর্থন দিচ্ছে। তারা যাতে অবস্থার চাপ, অর্থনৈতিক সুবিধার আশা বা যুদ্ধে আরবদের রোমান্টিক বীরত্ব অথবা ইজরেলের আগ্রাসী নীতিতে ঘৃণার জন্য নয়, বরং প্যালেষ্টাইন সংগ্রামের ন্যায্যতার জন্যই প্যালেষ্টাইন সংগ্রামকে সমর্থন করতে শুরু করে, সেটাই হলো কাম্য। এবং তার জন্য প্রয়োজন, প্যালেটাইন সংগ্রামের ন্যায্যতা, তথা ইজরেলের অবৈধতাকে প্রতিষ্ঠিত করা।
আজকে পাশ্চাত্যের অনেক দেশ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ কম্যুনিষ্ট বিশ্বের প্রায় সর্বাংশ আরবদের সমর্থন করছে; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তারা প্যালেষ্টাইন মুক্তি সংগ্রমকে সমর্থন করছে। আরবদের সমর্থন করা বলতে তারা যা বোঝায় তা হলো এই যে তারা ইজরেলের আগ্রাসী নীতির প্রতিকার চায়— কিন্তু খোদ ইজরেলই যে একটি অপরাধ—তার প্রতিকার চায় না। তারা ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ এর যুদ্ধে ইজরেলের যেসব আরবভূমি দখল করে ফেলেছে – যার অধিকাংশই প্যালেইটাইনের বহির্ভূত অন্যান্য দেশ যথা মিশরের অংশ—তা থেকে ইজরেলের অপসারণ চায়— কিন্তু সমগ্র প্যালেষ্টাইন থেকে ইজরেলের উৎখাত এবং রাষ্ট্র হিসেবে প্যালেষ্টাইনের পুনঃ প্রতিষ্ঠা চায় না।
তারা যদি প্যালেষ্টান মুক্তি সংগ্রামের মুখপাত্রকে জাতিসংঘে কথা বলতে দিয়ে থাকে, তা এই জন্য নয় যে তারা প্যালেষ্টাইন মুক্তি সংগ্রামকে বা তার উদ্দেশকে সমর্থন দিচ্ছে, বরং এই জন্য যে এই কাজটি দ্বারা তারা কেবলমাত্র তাদের আরবপ্রীতির প্রমাণ দিতে চায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে আরবপ্রীতি সবসময়ই যে প্রকৃতপক্ষেই আরবদের সমর্থন হবে, তা নয়। আবার একই ভাবে আরবদের সমর্থন আর প্যালেষ্টাইন মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন ও এক কথা নয়, কেননা আরব ভূমি উদ্ধার ও প্যালেষ্টাইন সমস্যা দুটো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলো দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন সমস্যা।
১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ সনে ইজরেল যে আরব ভূমি দখল করে নেয়, তা ছিল প্রকাশ্য অবৈধ এবং এইজন্যই বিশ্বব্যপী বিবেক তার বিরুদ্ধে এত স্বাভাবিক ভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কিন্তু ১৯৪৮ সনে ইজরেলের প্রতিষ্ঠা জনিত যে অপরাধের প্রতিকারের জন্য প্যালেষ্টাইন মুক্তিসংস্থা সংগ্রামরত, তার অবৈধতা কখনো এত স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়নি বলেই প্যালেস্টাইন মুক্তিসংগ্রাম ও তার উদ্দেশ্য কখনো ঐরকম ব্যপক সমর্থন পায়নি— আজও প্রকৃত প্রস্তাবে পায় না। ইজরেলের বিরুদ্ধে প্যালেষ্টাইন মুক্তি- সংগ্রমের প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য তাই নানারূপ কুটনৈতিক চাপ ও ভাবাবেগ গত পরিবেশ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই সবচাইতে অধিক গুরুত্ব দিয়ে যা, করতে হবে, তা হলো ইজরেলের অবৈধতাকে পরিষ্কার ও সহজ ভাষায় প্রতিষ্ঠা ও তার ব্যপক সম্প্রচার ! মনে রাখতে হবে ইজরেলের বিরুদ্ধাচরণ বা সমর্থন হতে হবে প্রধানতঃ এবং প্রথমতঃ বুদ্ধিগত, ন্যায়- বিচারের প্রশ্নে—আবেগ বা চাপের মুখে নয়।
পূর্বে ইজরেলের দুটো শাসনতান্ত্রিক ভিত্তির কথা বলেছি–এবং সাধারণ ও স্বাভাবিকভাবে তা যে কি ভাবে গ্রহণযোগ্য ও সহানুভূতির উদ্রেককারী, তাও দেখিয়েছি। কিন্তু সূক্ষ্মতর বিচারে দুটো দলীলই অবৈধ এবং এই কারণেই দলীলে দুটো ও তদানুষঙ্গিক অন্যান্য দলীলের ওপর প্রতিষ্ঠিত ইজরেলের আইনগত রাষ্ট্র সত্ত্বাও অবৈধ এবং অনুপস্থিত। অর্থাৎ আইনের চোখে ইজরেল টিকে আছে কোন রাষ্ট্র হিসেবে নয়। “দস্যু সুলভ জবর দখল” (“piracy”) হিসেবে। ১৯১৭ সনের ২রা নভেম্বরের ব্যালফোর ঘোষনার বৈধতা আলোচনা করতে হলে তার পটভূমিকার নিরীক্ষা প্রয়োজন। ১৯১৫ সনে ওটোম্যান সাম্রাজ্যের “হোমসের পশ্চিমে অবস্থিত কোন কোন জায়গা” ছাড়া সমস্ত আরবভূমির স্বাধীনতার স্বীকৃতির মাধ্যমেই শুধু বৃটিশেরা আরবদের ওটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্রবৃত্ত করতে পেরেছিল। সমস্ত হোমের পশ্চিমে কিছু কিছু জায়গা (যার অর্থ- বর্তমান লেবানন দাঁড়ায়) বাকী সমস্ত আরব ভূমিতে আরব স্বাধীনতার এই বৃটিশ স্বীকৃতি “শরীফ হুসেন – ম্যাকমোহন করেসপণ্ডন্স” নামীয় আন্তর্জাতিক চুক্তিমালায় রীতিমত বিধিবদ্ধ হয়ে ছিল। ১৯১৭ সনের ২রা নভেম্বর ব্যালফোর ঘোষণার মাধ্যমে এই একই জায়গার অন্তর্ভুক্ত প্যালেষ্টাইনে আরবদের সম্মতি ছাড়াই ইহুদীদের জন্য একটি জাতীয় আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠায় সমর্থন বা স্বীকৃতি দিয়ে ঘটেন তার পূর্ববর্ত্তী চুক্তি লংঘন করে। তাই পরবর্ত্তী এই ঘোষণাটি একটি অবৈধ ঘোষণা। এই অবৈধ দলীলটির ভিত্তিতেই স্থচিত হয় ঘটেনের অবৈধ নীতিমালার ছত্রছায়ায় প্যালেষ্টাইনের ইহুদীকরণ তথা রাষ্ট্র হিসেবে ইজরেলের খনীভবণ। ১৯২০ সনে বৃটেন প্যালেষ্টাইনের অছি নিযুক্ত হয়ে এসে তার প্রশাসনের ভার নেয়ার পর থেকেই শুরু হয় তার ইহুদীবাদী প্রতিষ্ঠানের স্বপদে খোদ আরব শর্তাবলীরই অবমাননা।
১৯২০ সনের প্যারিস চুক্তিমালায় প্যালেষ্টাইনকে “ক” শ্রেণীভূক্ত অছি হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই শ্রেণীর অছি ভূখণ্ড সমূহকে সার্বভৌম দেশ হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়া হয়—অছি তদারকী রাষ্ট্র কেবল সেখানকার জনগনের রাষ্ট্র হিসেবে বিকাশ লাভ সহায়তাকল্পে তাদের প্রশাসনের পরামর্শ দান ও তদারকী করবেন- এই ছিল কথা। অছি হবার পর প্যালেষ্টাইনকে একটি দেশ হিসেবে গন্য করবার নানাবিধ নজীরও রয়েছে। প্যালেষ্টাইনের ভিন্ন পাসপোর্ট ভিসার প্রবর্তন হয়, এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্যালেষ্টাইনকে ভিন্ন একটি দেশ হিসেবে সদস্য পদও দেয়া হয়।
কিন্তু বৃটেন রাষ্ট্র হিসাবে প্যালেস্টাইনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশে সহায়তা কল্পে প্রশাসনে পরামর্শ দান ও তদারকী করতে গিয়ে যা করে তা হলো প্যালেষ্টাইনী প্ৰশাসনকে বৃটিশ স্বেচ্ছাচারের অধীনস্থকরণ এবং ঐ পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছাচারী নীতি সমূহের প্রণয়ণ পূর্বক একদিকে দেশটির ক্রমশঃই ইহুদীকরণ এবং অন্যদিকে রাষ্ট্র হিসেবে তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশের গতিরোধ। একটি অবৈধ দলীলকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে একটি পরিপূর্ণ অবৈধ পরিকল্পনার মাধ্যমে যে একটি বিশাল অন্যায় সংঘটিত হলো তারই ফলশ্রুতি হলো প্যালেষ্টাইনে আরব-ইহুদী সংঘর্ষ। এর সমাধান করতে গিয়ে বৃটেন আরো একটি অন্যায় করে : অছি তদারকী রাষ্ট্র মাত্রই অছি দেশের দায়িত্ব গ্রহণের সময় এই ব্যাপারে অঙ্গীবদ্ধ হয়েই তা করে যে দেশটিকে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রিক বিকাশের পর্যায়ে এনে পরিপূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়ার দায়িত্ব সে নিচ্ছে। কিন্তু বৃটেন, প্যালেষ্টাইন যখন তারই অবৈধ নীতিমালার ফলশ্রুতিস্বরূপ উত্তত এক ভয়ংকর গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত, ঠিক সেই সময়ই তার দায়িত্বের প্রতি চরম অবহেলা দেখিয়ে প্যালেষ্টাইন ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। আন্তজাতিক আইনের ভাষায় একে “সিভিল ইনাউফারেন্সের” অপরাথের পর্যায়েও ফেলা যায়।
এই বেআইনী কাজের সূত্র ধরেই এইবার স্বয়ং জাতিসংঘই আরো একটি অবৈধ কাজ করে “রাষ্ট্র” হিসেবে ইজরেলের জন্মদান করেন। জাতিসংঘ সনদের ………… ধারা অনুযায়ী জাতিসংঘ শুধু তার সদস্য মাত্রই নয়, পৃথিবীর সকল দেশেরই অখণ্ডতার প্রতি সম্মান দেখাতে বাধ্য। ১৯২০ সন থেকেই স্বতন্ত্র ও অবিভক্ত একটি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও নানাভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্যালেষ্টাইনকে …… এর প্রস্তাবের মাধ্যমে দ্বিখণ্ডি করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ যা করলেন তা একটি অতিনিকৃষ্ট শ্রেণীর চুক্তি লংঘন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ।
এইভাবে অবৈধ দলীল ও তাণ্ডব কার্যক্রম তথা অপরাধের পর অপরাধ স্তূপীকৃত হয়ে তথাকথিত ইজরেল রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। এই মূৰ্ত্তিমান অপরাধের প্রতিকার তথা বিনাশই প্যালেষ্টাইন মুক্তি সংগ্রামের উদ্দেশ্য এবং দায়িত্ব। আন্তর্জাতিক আইনে সংঘটিত একটি অপরাধের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সমাজের— তার অপরাগতায়, ঐ অপরাধের শিকারের। তাই ইজরেল অপরাধের প্রতিকারে অস্ত্রধারণ করে প্যালেষ্টাইন মুক্তি- সংগ্রাম যা করেছে তা হলো আইনের অধীনে একটি দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হওয়ার শামিল। এবং একমাত্র দায়িত্বশীলতার ভেতরই রয়েছে আন্তর্জাতিক কেন, সর্বপ্রকার অরাজকতা ও নৈরাজ্যের সমাধান।
ইজরেল রাষ্ট্রের বিনাশ বলতে প্যালেষ্টাইনে এসে পৌঁছা লক্ষ লক্ষ বহিরাগত ইহুদী ও তাদের বংশধরদের বিনাশ বোঝায় না। প্যালেষ্টাইন মুক্তিসংগ্রাম যা চায়, তা’ হলো রাষ্ট্র হিসেবে প্যালেষ্টাইনের পুনঃ প্রতিষ্ঠা এবং তাতে ধর্ম নির্বিশেষে সকল বৈধ অধিবাসীর স্বাভাবিক বিকাশ ও বৃদ্ধি। এবং এর জন্যই অবৈধ ও অস্বাভাবিক ইজরেল রাষ্ট্রের বিলুপ্তির প্রয়োজন।
প্যালেষ্টাইন মুক্তিসংগ্রামের সংগে এই দেশের পাঠকদের ও কোন পরিষ্কার ও পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নেই। জেরুজালেমের পবিত্র নগরীর প্রতি একটি ধর্মীয় ভাবাবেগগত আকর্ষণ এবং মাঝে মাঝে প্যালেষ্টাইনী গেরিলাদের দুঃসাহসী কার্যকলাপের রোমান্টিক কাহিনী নিয়ে গড়ে ওঠা একটি ভাসা ভাসা ‘ইমেজ’ নিয়েই বাঙ্গালীদের প্যালেষ্টাইন তথা প্যালেষ্টাইন মুক্তি সংগ্রাম। একটি সমস্যা, তার সমাধান এবং তৎসম্পর্কিত একটি মহৎ সংগ্রামকে বুঝবার জন্য এবং ভাবাবেগের পরিবর্তে বুদ্ধিবৃত্তি ও সাম্প্রদায়ি কতার পরিবর্তে তাকে বিবেক দিয়ে গ্রহণ ও সমর্থন করবার জন্য তা যথেষ্ট নয়।
ভূমিকা
ষোড়শ শতকের প্রথমভাগে তুর্কীরা প্রায় সমগ্র আরব ভূখণ্ড দখল করে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে। এর পূর্বেই ১৭১৬ খৃষ্টাব্দে তারা মিসরীয় মামলুক শাসকদের কাছ থেকে প্যালেষ্টাইন দখল করে। এক বছরের মধ্যে মামলুক রাষ্ট্র তাদের হাতেই ধ্বংস হয়। সামন্ততান্ত্রিক ধন আহরণ, বিশ্ব বাণিজ্যের পথগুলো পেয়ে যাওয়া, ভূমধ্যসাগরের বুকে বিশেষ করে উপকুলে আধিপত্য লাভই ছিল এ দখলকারের উদ্দেশ্য। অন্যান্য আরব অঞ্চলের মত প্যালেষ্টাইনেও তুর্কীরা পাশা নামে প্রশাসক বসায়। কিন্তু সুলতানদের বিরুদ্ধে পাশাদের বিদ্রোহ অথবা স্থানীয় আরব সামন্তদের হাতে পাশাদের টালমাটাল অবস্থা, কখনো কখনো কৃষক ও জনবিদ্রোহ ওসমানীয় সাম্রাজ্যকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে। রাষ্ট্রীয়ভূমি (মামলে কাত), ধর্মীয় ভূমি (ওয়াকফ) আর ব্যক্তি মালিকানার ভূমি (মুলক) ছিল ভূমিস্বত্বের রীতি। ফসলের এক দশমাংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত ছিল করের আওতায়, অমুসলমানদের জন্য ছিল জিজিয়া কর। ফিলিস্তিনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আদি সমষ্টিবদ্ধ সাম্যজীবনের অবশেষ টিকে ছিল তখনো। বেদুঈন ও স্থায়ী বসতির ঐ এলাকাগুলোতেও সামস্ত ব্যবস্থা ধীরে ধীরে শিকড় ছড়াচ্ছিল। ১৭৮৪ সালে লিখিত এক বিবরণী থেকে জানা যায়, দক্ষিণ প্যালেষ্টাইনের ক্ষুদ্র গোত্র সমাজে পাঁচশ অশ্বারোহীর শেখও ছিলেন। শেখ স্বীয় গোত্রের লোকদের সাথে নিরহঙ্কারে ঘোড়া চরাতেন বলেও জানা যায়। তখন এতদঞ্চলে খৃষ্টানদের মধ্যে ১০টি ও মুসলমানদের মধ্যে ৫টি মতপ্রভেদ ভিত্তিক সম্প্রদায় বসবাস করতো।
সপ্তদশ শতকের শেষভাগে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের নিদারুণ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট দেখা দেয়। উৎপাদিকা ব্যবস্থা বিকাশহীন অবস্থায় নিশ্চল হয়ে পড়েছিল। সৈন্য যোগাড়েও তার দৈন্য দেখা দেয়। ইউরোপে পরপর সমরকৌশল ও সমরাস্ত্রের উদ্ভবের পাশাপাশি ওসমানীয় সাম্রাজ্যে দেখা দেয় সামরিক শক্তির অবক্ষয়। সমস্ত জায়গীরদার শ্রেণী জানিসারী পাইক পদাতিক দিয়ে সম্রাটের আজ্ঞা পালন করতে অসম্মতি জানাতে শুরু করলে এতদিনের বিজয় আত্মরক্ষার অবস্থানে নেমে আসে।
সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগে তুর্কীরা পরাজয় বরণ করে। ১৬৯৯ সালে অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, পোল্যাণ্ড ও ভেনিসের বিরুদ্ধে অভিযান ব্যর্থ হলে কার্লোবিজ চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়াকে আজভ, পোল্যাণ্ডকে পোদলিয়া, মধ্য হাঙ্গেরী, ট্রানসালভ্যানিয়া বাকা ও স্লাভনিয়া অস্ট্রীয়াকে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৭৯২ সালের জার্সী চুক্তিতে আরও এলাকা হারায় ওসমানীয়রা। অস্ট্রিয়া ও রাশিয়া আড্রিয়াটিক সাগরও দানিয়ুব অববাহিকা হাত করার চেষ্টা চালায়। ইস্তাম্বুল, মিসর, আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া, সিরিয়া ও ইরানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্স অধীর হয়ে ওঠে অষ্টাদশ শতাব্দীতে। তবে উনিশ শতকে পাশ্চাত্যে পুঁজিবাদের বিকাশের পর দূরপ্রাচ্য এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্য খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলবার জন্য পাশ্চাত্য মরীয়া হয়ে উঠে। এটাই ঊনিশ শতকের ইউরোপীয় কূটনীতির “প্রাচ্য প্রশ্ন”।
১৭৮০ সালের দিকে বিদ্রোহ দেখা দেয় আরবে। লেবাননে চরম পন্থায় বিদ্রোহ দমন করা হয়। রাজন্যবর্গের একাংশ বিদ্রোহীদের পক্ষে যোগ দিলে রাজন্যবর্গের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি সংঘর্ষ শুরু হয়। ইউসুফ শিহাব তার ভাইয়ের জিহ্বা কেটে, চক্ষু উৎপাটন করে বিদ্রোহের সাজা দেন। এরপর প্যালেষ্টাইন ও সাঈদার বেদুইন ও কৃষকদের বিদ্রোহ দমন শুরু হয়। এখানেও সামন্তদের একাংশ স্বচ্ছন্দ জীবনের অঙ্গীকার দিয়ে কৃষকদের বিদ্রোহে অবতীর্ণ করেছিল। মিসরকেন্দ্রিক নৃপতি জাযযার আহমদ চরম নিষ্ঠুরতার সাথে বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত হলে বিদ্রোহও প্রচণ্ডরূপ ধারণ করে। বিদ্রোহীরা বৈরুত, সাঈদা, সুর ও আক্কার উপকণ্ঠ দখল করে নেয়। কিন্তু আহমদের উৎকোচ গ্রহণকারী একদল সামন্তের বিশ্বাসঘাতকতায় বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। তবু ১৭৯০ সালে আবার লেবাননে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৭৯৮তে দামেস্কের অধিবাসীরা নিষ্ঠুর আহমদকে কর প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিদ্রোহ করে। দামেস্কে নতুন পাশার নিযুক্তিতে বিদ্রোহ থামলেও সিরিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে বিদ্রোহ চলতে থাকে। ভূমির উপর অধিকার দাবী করে ইরাকে ষোড়শ সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিদ্রোহ ঘটে। আবার, গ্রীক, কুর্দ, আর্মেনীয় ও স্লাভদের বিদ্রোহ ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ফ্রান্সে সামন্ততন্ত্র উৎখাত করে মুক্তির চেতনা নিয়ে বিপ্লব সম্পন্ন হলে তার প্রভাব আরব জগতে এত সহসা এসে উপনীত হবে বলে ভাবা যায়নি। কিন্তু মিসরে সহসাই এর প্রভাব দেখা দিল। নেপোলিয়ন বোনাপার্টির অধীনে ফরাসী প্রজাতন্ত্র বাহিনী ১৭৯৮ তে মিসর অভিযান করে। ১লা জুলাই ফরাসী বাহিনী আলেকজান্দ্রিয়ায় হানা দিলে অধিবাসীরা প্রতিরোধ চালায়। প্রতিরোধ পূর্ণ করে ফরাসী বাহিনী মিসর অভিমুখে অগ্রসর হয়। মিসরীয় নাগরিকদের উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন ফরাসী বিপ্লবের বুলির সাথে ঔপনিবেশিক হুমকি এবং সরল জনগণকে ধোঁকা দেবার জন্য ধর্মীয় ভাবানুভূতি কাজে লাগানোর নাটকীয়তা মিশিয়ে বক্তৃতা করেন।
তার এই ডেমাগসী বক্তৃতার পর নেপোলিয়নের আসল চেহারা তার ৫টি ফরমানে স্পষ্ট : যেমন, বিদ্রোহী গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়া হবে। তিন ঘণ্টার পথ সমতুল্য দূরত্বের সব গ্রাম থেকে ফরাসী বাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রতিনিধি দল পাঠাতে হবে এবং ত্রিবর্ণ ফরাসী পতাকা তুলতে হবে। বন্ধু ওসমানীয় সুলতানের পতাকাও রাখা যাবে। গ্রামের মোড়ল বা শেখ সামন্তদের সম্পত্তি পাহারা দেবেন। শেখ, উলেমা, ইমামগণ ওসমানীয় সুলতান, ফরাসী বাহিনীর গৌরব কামনা, মামলুকদের ধ্বংস কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা করাবেন।
সামন্ত শ্রেণী ফরাসীদের বাধা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। কারণ সুদক্ষ, উন্নত, সুশৃঙ্খল ফরাসীদের সাথে সামন্ত বাহিনীর পেরে ওঠবার কথা নয়!
কিন্তু হানাদার ফরাসী বাহিনী কায়রো অভিমুখে এগিয়ে এলে সামন্ত ও রাজন্যদের যুদ্ধ প্রস্তুতির বাইরে কুশলী কারিগর ও সাধারণ মানুষ স্ব-উদ্যোগে প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি নেয়। তারা স্বেচ্ছাসেবী দল, যোদ্ধা দল গঠন করে অস্ত্র কিনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। তবু ফরাসী বাহিনী কায়রোতে ঢুকে পড়ে। নির্মম প্রতিশোধ নেয় প্রতিরোধকারীদের ওপর। এদিকে আগষ্টের প্রথমে ইতালীর এডমিরাল নেলসনের ফরাসী নৌবহর এসে আবুকির উপসাগরে ফরাসী নৌবহর ধ্বংস করে। সুলতান তৃতীয় সেলিম মিসর উদ্ধারের জন্যও যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
জনগণের ধর্মীয় ভাবানুভূতিকে ব্যবহার করতে চেয়ে বোনাপার্টি আলী বোনা বার্দা পাশা নাম নিয়ে, পাগড়ী মাথায় পরে নামাজ আদায়, জেনারেল জ্যাকু ম্যানুকে “আবদুল্লাহ” নামে গ্রহণযোগ্য করার প্রয়াস, শেখ ও উলেমাদের নিয়ে দিওয়ান গঠন করে সামন্তদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে ফরাসী উপনিবেশবাদের পক্ষে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু অর্থ ও দ্রব্যে যে করভার ফরাসীরা চাপাতে শুরু করে তার নিরিখেই ‘গণবন্ধু’ নেপোলিয়নের আসল চেহারা জনগণ সনাক্ত করে নেয়।
তুর্কী সৈন্যরা অভিযান শুরু করতেই বদ্বীপ অঞ্চলগুলোতে ফরাসী সংবাদবাহীদের হালাক করা, ক্ষুদ্র টহলদার দলগুলোকে গায়েব করে দেওয়া, কর সংগ্রাহকদের পিটিয়ে লাশ করা, ফরাসী সামরিক অফিসারদের অতর্কিতে শিরচ্ছেদ করার মত গেরিলা তৎপরতায় কৃষককুল মেতে উঠে। বদ্বীপ অঞ্চলে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করতেই কায়রোতে বিদ্রোহ শুরু হয়। অক্টোবরে ফরাসী অফিসার ও জেনারেলদের উপর অতর্কিত গণআক্রমণ শুরু হয়। রাস্তায় গৃহে নিহত হয় একের পর এক। ফরাসী সৈন্যরা পালাতে শুরু করে। বোনাপার্টি পালিয়ে যান বদ্বীপে-। সেখান থেকে পিটুনী অভিযান চালনার প্রস্তুতি নেন। আল আজহার মসজিদে পনের হাজার লোক সমবেত হয়ে সৈন্যদের গতিরুদ্ধ করার জন্য শুরু করে ব্যারিকেড নির্মাণ। গ্রাম থেকে ৫ হাজার কৃষক, কয়েক হাজার বেদুইন এগিয়ে আসে বোনাপার্টি আসল চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে মসজিদে মসজিদে কামান চালাবার নির্দেশ দেয়। হাজার হাজার লোক হতাহত হয়। আহতদের হত্যা করা হয় বেয়নেট দিয়ে। বিদ্রোহের ৬ জন নেতার শিরচ্ছেদ করে বর্ণায় গেথে কায়রোতে ঘুরানো হয়।
সিরিয়া অভিযানে ব্যর্থ হয়ে ফরাসী বাহিনী সরে যাবার জন্য বৃটিশ ও তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু নিরস্ত্র হতে বলা হলে পুনরায় ফরাসীরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এর আগেই, ১৭৯৯ সালেই জেনারেল ক্লোবারের হাতে দায়িত্ব দিয়ে গোপনে নেপোলিয়ন ফিরে গিয়ে ছিলেন। ১৮০০ খৃষ্টাব্দের জুনে আলেপ্পোর সুলেমান নামক ধর্মপ্রাণ এক ব্যক্তি ক্লোবারকে স্বগৃহে হত্যা করে। সামরিক আদালত তাকে হাত পুরিয়ে হত্যা করে। কিন্তু এ যন্ত্রনার মুহূর্তে সুলেমান টুশব্দটি করেননি। এর দাদ নিতে গিয়ে ফরাসী বাহিনী আরেকবার কায়রোতে বহৎসব চালায়।
১৮০১ সালে ২০ হাজার বৃটিশ সৈন্য কায়রোতে অবতরণ করে। ফরাসী তিনটি বছরের দখলকারের অবসান ঘটে। এ দখলকারের ব্যর্থতা চরম। কেবল ফরাসী রাজ কর্মচারীরা সেচ, কৃষি, হস্তশিল্প সমাজজীবন, সাংস্কৃতিক সৌধ, সমাজ সম্পর্ক লোকগীতি, রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থার ওপর ২০ খণ্ড বিস্তৃত ‘দ্যসক্রিপসন দ্য লা-ইজিপ্টি’ রচনা করেছেন-এটাই একমাত্র কাজের মত কাজ়। অবশ্য আজও এ গ্রন্থটি থেকে যথেষ্ট ঐতিহাসিক উপাদান আহরিত হয়নি।
তার পর ১৮০১ থেকে ১৮০২ পর্যন্ত ২০ হাজার বৃটিশ, ৪০ হাজার তুর্ক ও ৪০ হাজার মামলুক সৈন্য কায়রোতে অবস্থান করে। বৃটিশরা যাবার সময় মোহাম্মদ আল আলফী নামক মামলুকপন্থী মিসরীয় নেতাকে বগলদাবা করে নিয়ে যান, যেন যথাসময়ে আবার মিসরের মাটিতে দাঁড় করানো যায়।
তা করুক। প্যালেষ্টাইনের সংবাদ নিতে চাইলে আমরা দেখবো, ফরাসীরা প্যালেষ্টাইনের উপকূলভাগ দখল করেছিল উনিশ শতকের শুরুর দিকে বৃটিশ প্রতিপত্তি বেড়ে যায় আরব অঞ্চলে। পারস্যসাগর ও ইরাকে বৃটিশ শক্তি সংহত হয়ে উঠে।
বর্তমান সউদী আরবের রাজতন্ত্রের পূর্ব প্রতিষ্ঠারা ঊনিশ শতকের প্রথম দশকে ওসমানীর আধিপত্য উৎখাত ও আরবের ঐক্য সাধনের লক্ষ্যে অন্যান্য অঞ্চল ছাড়াও পূর্ব প্যালেষ্টাইনের উপর আক্রমণ চালায়।
উনিশ শতকের তৃতীয় দশকের দিকে সিরিয়া ও প্যালেষ্টাইনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। ওসমানীয় সুলতান রাজকর্ম চারীদের পাগড়ী ছেড়ে ফেজটুপী ও ইউরোপীয় পরিচ্ছদ পরিধানের নির্দেশ দিলে ধর্মীয় অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। ১৮২৫-এর প্রক্কালে জীবন যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিদ্রোহে। একই বছর জেরুজালেম কর প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। ১৮৩১-এ মিসরীয় বাহিনী সিরিয়া ও প্যালেষ্টাইন আক্রমণ করলে জনতা তাদের স্বাগত জানায়।
মিসরের বর্ম হিসেবে উপকূল ও পূর্বভাগের প্যালেষ্টাইন ও সিরিয়া হাত করার জন্য মোহাম্মদ আলীর প্রয়াস অব্যাহত থাকে। ১৮৩১ সালে সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুক্তি এড়াবার জন্য মিসর হতে প্যালেস্টাইনে পলায়নকারী ছয় সহস্রাধিক কৃষককে কেন্দ্র করেই মোহাম্মদ আলী প্রকারান্তরে তুর্কী মিসর যুদ্ধের আয়োজন করে। একই বছর মিসরীয় সৈন্যরা গাজা, জাফা, হাইফা দখল করে।
অবশেষে সুলতান মিসর, ক্রেটে, আরব ও সুদানের উপর অধিকার স্বীকার করে এবং তাকে প্যালেষ্টাইন, সিরিয়া ও সিসিলির শাসক নিয়োগ করে এক ফরমান জারী করে মুখ রক্ষা করেন।
আরবী ভাষাভাষী সব অঞ্চলকে একত্রিত করে আরব সাম্রাজ্য গঠন ছিল মোহাম্মদ আলীর লক্ষ্য। তাঁর পুত্র ইব্রাহিমও অনুরূপ সংস্কার ও প্রসারিত লক্ষ্যে প্রয়াস অব্যাহত রাখেন।
১৮৩৪-এ বৈরুতে ছাপাখানা স্থাপন এই সংস্কারেরই অঙ্গ।
প্যালেষ্টাইনকে ৬টি প্রদেশে বিভক্ত করা এবং নতুন প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম করাও এর অন্তর্গত। কিন্তু মোহাম্মদ আলী ইব্রাহীমের সৈন্য যোগাতে কৃষকদের অস্বীকৃতি আবার ১৮৩৪-এ বিদ্রোহ ডেকে আনে প্যালেষ্টাইনে। বিদ্রোহীরা ইব্রাহিমকে জেরুজালেমে আটক করে। মোহাম্মদ আলী স্বয়ং পুত্র উদ্ধার ও বিদ্রোহ দমনে নেতৃত্ব দেন। লেবাননেও দেখা দেয় বিদ্রোহ। লেবাননী খৃষ্টান অঞ্চলের সীমিত বিদ্রোহটি ইব্রাহীম দমন করে ফিরবার পর পরই পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ তথাকথিত ‘প্রাচ্য প্রশ্নের’ নামে ১৮৪০-এ ‘লণ্ডন সম্মেলনের’ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় মোহাম্মদ আলীর উপর। তাতে মোহাম্মদ আলীকে শুধু মিসর ও ফিলিস্তিনের আক্কা রেখে বাকী ভূমি সুলতানকে প্রত্যার্পনের হুকুম এবং ২০ দিনের মধ্যে এ হুকুম তামিল না হলে উৎখাত করার হুমকি দেওয়া হয়। মোহাম্মদ আলী “অস্ত্রের বলে লব্ধ ব্যাপার অস্ত্রবলেই রক্ষার” কথা ঘোষণা করলেন। ফরাসী সাহায্যের প্রত্যাশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু ইউরোপীয় যুদ্ধের ঝুকি নিতে ফ্রান্স নারাজ। বৃটিশ রাষ্ট্রীয় রণতরী বহর ও বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহের চাপে মোহাম্মদ আলী ও ইব্রাহীম নতি স্বীকার করলেন।
১৮৪০-এর দিক থেকে প্যালেষ্টাইনকে উপনিবেশিকরণের জন্য মিশনারী ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এরা প্যালেষ্টাইনে বিদ্যালয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলে শতগুণ উৎসাহে ধর্মপ্রচার শুরু করে এবং এর মাধ্যমে ধর্মপ্রচারকরা স্ব স্ব দেশের স্বার্থ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পায় ! ফ্রান্সের সমর্থনে ভ্যাটিকান এই ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়। ধর্মযুদ্ধের সময়কার লাতিন জেরুজালেম ধর্মসংস্থা আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। ১৮৪৯-এ রাশিয়ার অর্থডক্স মিশন জেরুজালেমে আসর পাতে। বৃটেনের ইঙ্গিতে ১৮৪১-এ জার্মানীর মাধ্যমে ইঙ্গ-জার্মান ধর্ম গোত্রের একটি মিশন খোলা হয়। প্রকারান্তরে বৃটেন এখানে ইহুদীদের বসতি স্থাপন ও ইহুদী কার্যক্রম পরিচালনায় উৎসাহ যোগায়। ১৯ শতকের মাঝামাঝি প্যালেষ্টাইনে ইহুদী অধিবাসী সংখ্যা দাড়ায় ১১ হাজার। অনেকেই ছিল তীর্থে আগত। এদের অনেকেই শুধুমাত্র ধর্মীয় উদ্দেশ্যে এখানে বসতি স্থাপন করে। ১৮৩৯-৪১ এর তথাকথিত প্রাচ্য সঙ্কটের সময় বৃটিশ জেরুজালেমে ইহুদীরাষ্ট্র গঠনের জন্য বোনাপার্টির পরিকল্পনা অনুসরণ করে।
১৮৩৮ সালে প্যালেষ্টাইনে নিযুক্ত বৃটিশ কন্সাল গার্ড শ্যাকটবারী ও গাউলার সেখানে ইহুদী জনসংখ্যা স্থানান্তর করে বৃটিশ ছত্রছায়ায় ইহুদী রাষ্ট্রগঠনের জন্য পরিকল্পনা পাশ করে। ইহুদী ধনকুবের রথচাইল্ড পরিবারভূক্ত বৃটিশ ব্যাঙ্কার স্যার মুসা মণ্টেকিওর এ পরিকল্পনা সমর্থন করে কয়েকবার প্রাচ্য সফরে আসেন এবং ১৮৫৫ সালে জাফায় কমলালেবুর বাগান খরিদ করেন। তবু কোন ইহুদী উপনিবেশবাদীকে আগ্রহান্বিত তিনি করতে পারেননি।
১৯০৬ সাল নাগাদ বৃটেন প্যালেষ্টাইনকে দখল করে নিতে চেষ্টা করে। আসন্ন বিশ্বযুদ্ধ কালে ইতিপূর্বে হস্তগত সুয়েজ খাল রক্ষার জন্য একে যুদ্ধঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে মনস্থ করে।
প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের রপ্তানী বাণিজ্যের মধ্যে প্যালেষ্টাইন এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। তবে ইতিমধ্যে বিংশ শতকের শুরুর দিকে, প্যালেষ্টাইন বৃটিশ প্রভাবে পড়ে। ইতিপূর্বেই মিসর বৃটিশ দখলকারে চলে যায়, পূর্ব সুদানে কায়েম হয় মাহদী রাষ্ট্র। আলজিরিয়া ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয় মুক্তি সংগ্রামে। মরক্কো তখনো ফরাসীদের অধীনে। ইতালীয়রা দখল করেছিল সিরিয়া।
তবে বৃটিশ ও ফরাসীরাও কেবল নয়। জার্মানীরাও প্যালেষ্টাইনে তাদের ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করে। জাফা থেকে প্যালেষ্টাইন পর্যন্ত ফরাসীরাও রেলপথ খোলে। তাউরাস পর্বতমালার বিপুল খনিজ সম্পদের ব্যাপারে বিদেশীরা সচেতন হয়ে উঠে।
পতনোন্মুখ ওসমানীয় সাম্রাজ্য কেন্দ্রে নব্য তুর্কীরা ক্ষমতা নিয়ে সংস্কারের চেষ্টা চালায়। আরবদের সাথে কথিত ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্কের কথা ঘোষণা করে। কিন্তু জাতিসত্তাগুলোর প্রতি শাসকসুলভ মনোভাব সে- প্রয়াস ব্যর্থ করে। ১৯১২ সালে প্রথম বলকান যুদ্ধের পর আরব জাতীয়তাবাদীরা ওসমানীয় প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ পার্টি গঠন করে। প্যালেষ্টাইনেও তার শাখা গড়ে ওঠে।
ঊনিশ শতকের শেষ ৩০ বছর আরব উপদ্বীপ ছিল অত্যন্ত অনগ্রসর। খণ্ড-বিখণ্ড রাজ্যগুলো কখনো তুরস্কের কখনো বৃটেনের প্রভাব বশে লালিত হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে মধ্যযুগীয় জীবন এবং যোগাযোগ সম্বৃদ্ধ অঞ্চলে অবিকশিত স্থবির অর্থনীতির জীবন ব্যবস্থা চলে এসেছে। ঊনিশ শতকের শেষ ভাগে আরব দেশগুলো পুনরায় বিশ্বরাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে পতিত হলো। বৃটেন আরব উপদ্বীপ জুড়ে স্বীয় প্রভাব বিস্তার করতে চেষ্টা করে।
কিন্তু ফ্রান্স ও রাশিয়া নিজেদের অধিকার কায়েমের জন্য বাধা দেয় বৃটেনকে। তুরস্ক আরব অঞ্চলে স্বীয় প্রভুত্ব সংহত ধরার জন্যও চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ১৮৯৬-এ সুয়েজ খালের উদ্বোধনে এ অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়ে যায়। এডেনও গুরুত্ব লাভ করে। বৃটেন এডেনকে শুল্ক মুক্ত বন্দর বলেও ঘোষণা করে। সুয়েজ খাল খুলবার পর বৃটেন দক্ষিণ আরবকে রক্তস্নাত করে, বোমাবর্ষণ করে শহর গ্রামের উপর, সামন্ত শ্রেণীকে উৎকোচ দিয়ে বশে আনে। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথে বৃটিশ দক্ষিণ আরবের ২৩টি ক্ষুদ্র সুলতানাত ও শেখ রাজ্যকে চুক্তিতে আবদ্ধ করে এবং এডেন কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বৃটেন পারস্য উপসাগর করায়ত্ত করে। সউদীরা সউদী আরবের প্রতিষ্ঠা ঘটায় ১৯৫৬ সালের দিকে।
১৯১৪ সালে আরব দেশগুলো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের শিকারে পরিণত হয়। জার্মান-তুর্ক পক্ষ প্যালেষ্টাইন, সিরিয়া, লেবানন ও আরব অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনশক্তি নিজেদের স্বার্থে লাগাতে শুরু করে। সিরিয়া ও প্যালেষ্টাইনে ৪র্থ বাহিনী এনে বসানো হয়। প্যালেষ্টাইনের অর্থনীতি তখন এহেন যুদ্ধের চাপ সহ্য করতে অপারগ ১৯১৫ ও ১৯১৬ সালে লেবানন, সিরিয়া ও প্যালেষ্টাইনব্যাপী প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষে শহরগুলো উজার হয়ে যায়। একমাত্র লেবাননেই ১ লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে।
১৯১৫ সালের দিকে জামাল পাশা যখন যুঝলেন যে, জেহাদের শ্লোগানে কাজ হবার নয়, তখন তুর্ক বিরোধী আরব জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থান প্রস্তুতি এগিয়ে গেছে অনেকখানি। ইতিপূর্বে ফরাসী দূতাবাসে তল্লাসী চালিয়ে জামাল পাশা এর যথাযথ প্রমাণও পেয়েছিলেন।
তারপর শুরু হলো আরব জাতীয়তাবাদী দলন। পত্র পত্রিকা বন্ধ ঘোষণা, আরব জাতীয় সমিতিগুলোর লোকজন পাইকারী ভাবে গ্রেফতার এবং সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করা শুরু হলো। সামরিক ট্রাইব্যুনাল বিকেন্দ্রীকরণ পার্টি, তরুণ আরব জোট, লেবাননী জাগরণী সংস্থা সহ বিভিন্ন সংগঠনের ৮০০ ব্যক্তির প্রাণদণ্ড দেয়ার হুকুম দেয়। প্যালেষ্টাইনী অনেককেও সে দিন প্রাণ হারাতে হয়।
প্রথম মহাযুদ্ধে প্যালেষ্টাইন, সিরিয়া, জার্মান-তুর্ক বাহিনীর হাতে থাকায় বৃটিশরা মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে মিসরের ঘাঁটি থেকে সুবিধা করতে পারেনি বেশ কিছু কাল। বৃটিশরা সিনাই মরুভূমির মধ্য দিয়ে প্যালেষ্টাইনের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করলে জার্মান পক্ষের গোলা ও বোমায় একমাত্র সামরিক বাহিনীর পশ্চাদবর্তী দিন মজুরই নিহত হয় ৩০ হাজার। এ দিনমজুররা আসলে সাধারণ কৃষক, বৃটিশরা তাদের জবরদস্তি নিয়োগ করেছিল।
১৯১৫ সালের মে মাসে আবার ইংরেজ সহযোগীতায় দামেস্ক প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি বস্তুতঃ পক্ষে আরব সামন্তদের এবং সিরিয়া, ইরান ও প্যালেষ্টাইনী ধনবাদীদের সন্ধিপত্রের নামান্তর। আরব জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এ চুক্তি থেকে নবতর শিক্ষা লাভ করে।
বৃটিশ বাহিনী প্যালেষ্টাইনের উপর অভিযান শুরু করলে বৃটিশ গোয়েন্দা অফিসার লরেণ্ডা হেজাজ বাহিনীর নেতত্বে দিয়ে অগ্রসর হন এবং আকাবা দখল করে নেন। সেখান থেকে আরবরা লোহিত সাগরের তীর তুর্কী যুক্ত করে বৃটিশ বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। যুদ্ধের সময় আরবদের স্বাধীন রাষ্ট্র সংগঠনের সংগ্রামকে উপেক্ষা করে বৃহৎ শক্তিবর্গ নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী আরবকে বিভক্ত করার পায়তারা চালাতে থাকে। ১৯১৫ সালের ১০ই এপ্রিল বৃটেন-ফ্রান্স-রাশিয়ার মধ্যকার চুক্তিতে রাশিয়াকে কতিপয় অন্তরীপ প্ৰদান ও আরবে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র সংগঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। তবে সিরিয়া ও প্যালেষ্টাইনের ভাগ্য তখনও নির্ধারিত হয় নি। এক বছর পর প্যালেষ্টাইনের ব্রাউন জোন বাদ দিয়ে বৃটেন বাকী সবটুকুই দখল করে ফেলে। ব্রাউন জোন রাখা হয় রাশিয়াও অন্যান্য দেশের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাস্তবায়নের পরিষদ হিসেবে। ধারণা ছিল, এখানে একটি আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ তারা প্রতিষ্ঠা করবেন।
প্যালেষ্টাইন পুরোপুরি বৃটিশ দখলে চলে গেলে বৃটেন কোন অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অগ্রসর হলো না। বৃটেন ইহুদী আন্দোলনের সহায়তা দান শুরু করল। ১৮৮২ সালে রাশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী একদল ইহুদী জাফার কৃষি খামার স্থাপন করে। ১৯০৮ সালে ইহুদী আন্দোলন বিভিন্ন দেশ থেকে প্যালেষ্টাইনে ইহুদী পাঠাতে থাকে। তুর্কীরা ইহুদীদের উপনিবেশ স্থাপনে কোন বাধা দেয়নি। ১৩ হাজার অধিবাসী অধ্যুষিত ৪৩টি বসতি গড়ে উঠে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ১৯১৪ সালে ইহুদীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯০ হাজার ইঙ্গ-ইহুদী ষড়যন্ত্রের ফলাফল ধারণ করে ব্যালফোর ঘোষণা এবং ফরাসী ও ইতালীর সাথে আপোষ রক্ষার পর আরব বিদ্রোহীরা দৃঢ়তরভাবে বৃটিশ বিরোধী অভিযান শুরু করে। ভাগাভাগি হস্তান্তরের পরও প্যালেষ্টাইন থেকে যায় বৃটিশের হাতে।
প্রথম মহাযুদ্ধের অবসানে আরব ভূমি তুর্কী জোয়াল থেকে মুক্ত হলো বটে কিন্তু ফরাসী ও বৃটিশ প্রভাব থেকে তাদের মুক্তি হয়ে রইলো সুদূর পরাহত। প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে আরব জনতার সংগ্রামের ইতিহাস শুরু হলো এক নবতর অধ্যায়। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম আরবে এগিয়ে চললো মুক্তির চড়ান্ত লক্ষ্যে।
সূত্র : প্রবাল প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এবং নজমুল হক ও আবদুস সালাম রচিত “ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রাম” নামক বই থেকে সংগৃহীত।