নবী-যুগে শিক্ষা-ব্যবস্থা

মূল: ড. মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ

অনুবাদ : মুহাম্মদ লুতফুল হক

“পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ হতে। পাঠ কর, আর তোমার প্রতিপালক মহা-মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানতনা।” (৯৬ : ১-৫)

এই ছিল আল্লাহ পাকের তরফ থেকে নিরক্ষর মুহাম্মদ (সা)-এর উপর নাযিলকৃত প্রথম ওহী।

তেইশ বছর ধরে নাযিল হয়েছে যে কুরআন তার বিভিন্ন আয়াত শিক্ষার মাহাত্ম্য ও তাৎপর্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। একদিকে বলা হয়েছে যে, “তোমাদেরকে সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে; (১৭ : ৮৫)

অপরদিকে তাকিদের সুরে উল্লেখ করা হয়েছে: হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও।” (২০ : ১১৪)

শিক্ষা সম্পর্কিত বহুল প্রচারিত একটি প্রবাদের বর্ণনা এ রকম: জন্ম থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর। শিক্ষাকে উৎসাহিত করে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে: জ্ঞান যদি চীন দেশে থাকে, তবে সেখানেও তা অনন্বেষণ কর।

বস্তুতপক্ষে জ্ঞানচর্চার স্বার্থে অবস্থানগত বাধা উপক্ষো করতে হবে—এটাই হল বর্ণিত হাদীসের মর্মবাণী।

মদীনায় হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবস্থানকালে নবীজী শিক্ষার জন্য কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, তা নিরূপণ করা দুষ্কর। সেখানে তিনি কোন বিদ্যালয় নির্মাণ বা নিয়মিত কোন শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন কি না তা জানা যায় না। তবে নির্ভরযোগ্য শিক্ষকগণের মাধ্যমে অবশ্যই কুরআন শিক্ষা ও চর্চার সুযোগ ছিল। সম্ভবত এর বাইরে লেখা-পড়ার অন্য কোন ব্যবস্থা ছিল না। প্রসঙ্গক্রমে বিশেষভাবে প্রণিধান যোগ্য যে, আরবী তাদের মুখের ভাষা এবং এটা চলে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। আরবী হরফ লেখা শুরু হয় আবূ সুফিয়ানের পিতা হারব-এর আমলে। এবং মক্কার লোকেরা জীবনে এই প্রথম আরবীর লিখিতরূপ দেখতে পায়। নবী করীম (সা) তখন যুবকমাত্র।

কখন কিভাবে আরবী ভাষার লিখিতরূপ চালু হল-ঐতিহাসিকগণের বর্ণনায় তার বিবরণ রয়েছে। বর্ণিত আছে যে, ইরাকের অন্তর্গত হিরার একজন অধিবাসী মক্কায় আসে এবং হারব-এর কন্যার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়। কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ সে হারবকে একটি গোপন সূত্রের সন্ধান দেয়। সে বলে, গুরুত্বপূর্ণ যে সমস্ত তথ্য বা ঘটনা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেগুলো লিখিতভাবে সংরক্ষণ করা যায়। এ কৌশলটি শেখার জন্য সে হারবকে পরামর্শ দেয়। কুদামাহ ইবন জাফর রচিত কিবুল খারাজ, বালাযুরীর ফুতুহুল বুলদান এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থেও ঘটনাটি সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা)-এর নবুওয়াত লাভের অল্প কিছুকাল পূর্বে মক্কা শহরে পড়ালেখার কৌশল চালু হয়।

বালাযুরী বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছেন যে, নবী করীম (সা)-এর দাওয়াতী কাজের শুরুতে মক্কায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল মাত্র সতের। সম্ভবত, এ বর্ণনায় বেশ খানিকটা অতিরঞ্জন রয়েছে। ব্যাপারটা এমনো হতে পারে যে, বিশেষ একটা সময়ের প্রেক্ষাপটেই হয়ত বালাযুরী পরিসংখ্যানটি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে শিক্ষা-পরিস্থিতির অবশ্যই উন্নতি ঘটে থাকবে। সে যাই হোক, সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যের বিষয় হল: ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেই বেশ কিছু মহিলাও লেখা-পড়ার কৌশল রপ্ত করেছিল। এমনি এক শিক্ষিতা মহিলার নাম শাফাদ। তিনি ছিলেন আবদুল্লাহর কন্যা এবং ওমর (রা)-এর আত্মীয়া। এই শিক্ষাগত যোগ্যতার সুবাদেই মদীনার একটি বাণিজ্যিক অফিসের দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। ইবন হাজারের বর্ণনামতে তাঁর এ দায়িত্ব ছিল মদীনার একটি বাজার-কেন্দ্রিক। মহিলারা বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়ে বাজারে আসত। সম্ভবত তাদের বাণিজ্য তদারক করাই ছিল শাফাদের দায়িত্ব।

সে যাই হোক, এটা একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ইসলামের আবির্ভাবকালে আরবে লেখা-পড়ার ইতিহাস ছিল খুবই স্বল্প সময়ের। বলতে গেলে লেখাপড়ার চর্চা তখনো তেমন একটা প্রসারলাভ করেনি। কুরআন শরীফকেই বলা যেতে পারে আরবী ভাষায় প্রথম লিখিত পুস্তক। এর পূর্বে আর কোন কিতাব রচিত হয়নি। শুধুমাত্র ‘সাবা মুয়াল্লাকাত’-এর মত কিছু কিছু লিখিত বিষয় ছিল এবং শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসাবে এগুলো কা’বা ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হত। সম্ভবত কিছু কিছু চুক্তিপত্রও লিখিতভাবে সম্পন্ন হত। ইবন আন-নাদিম আল-ফিরিশতায় উল্লেখ করেছেন যে, খলীফা আল-মামুনের দরবারে একটি পাণ্ডুলিপি ছিল। পাণ্ডুলিপি মানে এক প্রস্থ কাগজ। পাণ্ডুলিপির হস্তাক্ষর ছিল খুবই নিম্নমানের। বলা হয়ে থাকে যে, এটা ছিল আবদুল মুত্তালিবের লেখা একটি পত্র লিখিত আরবীর প্রবর্তন।

উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, একটি কলা বা শিল্প হিসাবে আরবী লেখাটা একেবারেই নতুন এবং ইসলামের আবির্ভাবকাল পর্যন্ত এটা তেমন কোন প্রসার লাভ করেনি। সম্ভবত এর একটা কারণ এই যে, হিরা থেকে আসা লোকটি তার দেশের প্রচলিত হস্তাক্ষরের আদলেই আরবী লিখন-পদ্ধতি শিখিয়েছিল। হিরায় লেখাপড়া হত ২৪টি বর্ণে। তদস্থলে আরবী বর্ণমালা হল ২৮টি। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, হিরার লিখন-কৌশলটি ছিল অপর্যাপ্ত। বিভিন্ন আরবী বর্ণমালার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের একমাত্র পথ হল নুকতা বা ফোঁটার ব্যবহার। খতীব আল-বাগদাদীর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, এই ত্রুটি অপনোদনকল্পে নবী করীম (সা) প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বর্ণিত আছে যে, খলীফা মুয়াবিয়া একদিন উবায়েদ আল-খাসানি নামের একজন লিপিকারকে ডেকে পাঠালেন। প্রয়োজনীয় ডিকটেশন দেওয়ার পর বললেন, এটাকে ‘রাশ’ করে নাও। লিপিকার উবায়েদ বললেন, ‘রাশ’ আবার কি? মৃদু হেসে খলীফা বললেন: তিনি নিজেও নবীজীর একজন লিপিকার ছিলেন।

একদিন নবীজী তাঁকে কিছু ডিকটেশন দেওয়ার পর বললেন: এটাকে ‘রাকশ’ করে নাও। তিনি তখন নবীজীকে ‘রাকশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। নবীজী বললেন: এটা হল শ্রুতিলিপি বা যা লেখান হল তার প্রয়োজনীয় স্থানগুলোতে ফোঁটা বা নুকতা দেওয়ার প্রক্রিয়া। উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, নবী-যুগেই মূলত আরবী লিখন-প্রক্রিয়ায় ফোঁটা বা নুকতা প্রদানের রীতি চালু হয়। কিন্তু প্রামাণ্য গ্রন্থাবলীতে এর কোন উল্লেখ নেই। অবশ্য এখন এ ব্যাপারে নতুন নতুন আরো কিছু প্রমাণপঞ্জি পাওয়া যাচ্ছে। তায়েফের শহরতলীতে আনুমানিক পঞ্চাশ হিজরীর একটি উৎকীর্ণ লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। খলীফা মুয়াবিয়া (রা)-র শাসনামলে তায়েফের গভর্নর যে সংগ্রহশালা তৈরি করেছিলেন, উৎকীর্ণ লিপিটিও সেই সংগ্রহের মধ্যে ছিল। আবিষ্কৃত এই উৎকীর্ণ লিপির কিছু কিছু বর্ণে নুকতা দেওয়া ছিল।

তুলনামূলকভাবে এ আবিষ্কারের ঘটনাটি বেশ পুরাতন। সম্প্রতি এতদসংক্রান্ত আরো কিছু প্রমাণপঞ্জি পাওয়া গেছে। এগুলো আরো সিদ্ধান্তমূলক। মিসরে কাগজ হিসাবে ব্যবহৃত কিছু চামড়া পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে বাইশ হিজরীতে হযরত ওমর (রা)-এর লেখা দু’টি পত্রও রয়েছে। উল্লেখ্য যে, তখন তিনি মুসলিম জাহানের খলীফা। এই পত্র দু’টিতেও নুকতা র ব্যবহার ছিল। এ সমস্ত আবিষ্কার থেকে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, হযরত ওমর (রা)-এর খিলাফতকালেই আরবী বর্ণমালায় নুকতা ব্যবহারের বিষয়টি বেশ প্রসার লাভ করে। উপরের আলোচনার সূত্র ধরে আরো বলা যেতে পারে যে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ-এর শামনামল অথবা তারও পরবর্তী সময়ে আরবী বর্ণমালায় নুকতা প্রদানের রীতি চালু হওয়া সম্পর্কে যে কথা আছে— তা ঠিক নয়।

যা হোক, এভাবেই আরবী বর্ণমালায় নুকতার ব্যবহার চালু করা হয়। বস্তুতপক্ষে লিখন-প্রক্রিয়ায় এটা ছিল একটি মৌলিক সংস্কার। লেখালেখি-সংশ্লিষ্ট আরো কতগুলো বিষয় আছে এবং সেগুলো আলোচনায় আসতে পারে। যেমন একটি হাদীসে এরূপ বর্ণিত রয়েছে যে, কোন পত্র লেখার পরপরই তা ভাঁজ না করার জন্য নবী করীম (সা) পরামর্শ দিয়েছেন। বরং লেখাটি প্রথমে শুকাতে হবে এবং তারপরই তা ভাঁজ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, বুখারী অথবা মুসলিমের সংগ্রহের মধ্যে হাদীসটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তবু এটা সত্য যে, পরামর্শটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নবী করীম (সা) অবশ্যই তাঁর নিখুঁত পর্যবেক্ষণ থেকে এ পরামর্শটি দিয়েছিলেন। কারণ কখনো কখানো এমন হয় যে, লেখার সঙ্গে সঙ্গে কালি শুকায় না। লেখার পরপরই চিঠি ভাঁজ করলে কালি লেপটে যায়। ফলে লেখাটি অস্পষ্ট বা অপাঠ্য হয়ে পড়ে। ইবন আল-আসীরের সূত্রে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করীম (সা) ‘সিন’ অক্ষরটি লিখতে দাঁত বা শিঙ্গাবিশিষ্ট করার পরামর্শ দিয়েছেন। তা না করে সরলরেখা বা অন্য কোনভাবে লেখা হলেই বিভ্রান্তির আশংকা থাকবে। হস্তলিপি সংক্রান্ত আরো কিছু হাদীস রয়েছে। একজন তুর্কী পণ্ডিত এরূপ চল্লিশটি হাদীস সংগ্রহ করেছেন।

নবী করীম (সা) মদীনায় আস-সুফফাগণের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অনুরূপ আরো কতকগুলো স্কুল ছিল। স্কুলগুলোতে শিক্ষকও নিয়োগ করেছিলেন। তাঁরা ছাত্রদেরকে লেখাপড়া শেখাতেন এবং ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতেন। আমরা জানি যে, নবী করীম (সা)-এর মক্কায় অবস্থানকালে তাঁকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু দলিলপত্র লিখিতভাবে সম্পাদিত হয়েছে। প্রথম এবং বহুল প্রচারিত দলিলটি ছিল নবী করীম (সা) ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের বয়কট সংক্রান্ত। মক্কার লোকেরাই তাঁকে বয়কট করেছিল। তারা দলিলটি টানিয়ে রেখেছিল কা’বা ঘরে। দলিলটিতে লেখা ছিল যে, ওদের মেয়েদেরকে কেউ বিয়ে করতে পারবে না। অথবা ওদের কাছে মক্কার কোন মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যাবে না। তাদের সঙ্গে সকল প্রকার বেচা-কেনা ও ব্যবসা- বাণিজ্য নিষিদ্ধ। এমনকি কেউ ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না। কথা পর্যন্ত বলবে না। চুক্তিপত্রে আরো উল্লেখ ছিল যে, মক্কার লোকেরা তো বটেই, কিনানা গোত্রের লোকেরাও এ চুক্তিপত্রের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছে। কিন্তু পরবর্তীতে চুক্তিপত্রটি পোকায় কেটে ফেলে এবং নবীজীকে বয়কটের ব্যাপারে বিরোধী শক্তি যে মৈত্রী গড়ে তুলেছিল তা-ও ভেঙ্গে যায়।

দ্বিতীয় দলিলটি প্রণীত হয়েছিল তামিম-আল-দারীকে কেন্দ্র করে। তিনি ছিলেন একজন ফিলিস্তিনী মুসলমান। নবীজীর হিজরতের পূর্বেই তিনি মুসলমান হয়েছিলেন। তিনি সিরীয় অঞ্চলের কিছু জমি তাঁকে দান করা এবং এতদসংক্রান্ত একটি বরাদ্দপত্র প্রদানের জন্য নবীজীর নিকট আবেদন করেছিলেন। নবীজী তাঁর এ আবেদন মঞ্জুর করেন এবং একটি প্রাধিকারপত্র দেন। পরবর্তীতে তামিম আল-দারীর বংশধরদের হাতে এ পত্রটির বিকৃতি ঘটেছে বলেই অনুমান করা হয়। এতদসংক্রান্ত পত্রের দু’টি কপি পাওয়া যায়। কপি দু’টির বিষয়বস্তুও সম্পূর্ণ আলাদা। ফলে পত্র বা দলিলের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দুষ্কর। তবে আবু ইউসুফ রচিত কিতাবুল খারায গ্রন্থে এ দলিলটির উল্লেখ আছে এবং লিখিত দলিলপত্রের মধ্যে এটাই দ্বিতীয়।

ইসলামের প্রথম জমানায় এ রকম আরো একটি দলিল প্রণীত হয়েছিল। এটা ছিল মূলত একটা জামিনপত্র। সুরাকা বিন মালিকের নিরাপদে পথ চলার সুবিধার্থে নবী করীম (সা) এ জামিনপত্রটি দিয়েছিলেন। অথচ এই সুরাকাই নবীজীর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতকালে তাঁকে বন্দী করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। হিজরতের সময়ে আবূ বকর (রা)-এর গোলাম আমির ইবন ফাহিরা ছিলেন নবীজীর সফরসঙ্গী। নবীজীর নির্দেশে তিনি এ পত্রটি লিখেছিলেন। এ ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, সফরের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর সঙ্গে নবীজী একটি কলম, কালি এবং কাগজও নিয়েছিলেন।

প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়

লেখাপড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে নবী করীম (সা) বিশেষভাবে সজাগ ছিলেন। মদীনায় পৌঁছার পরক্ষণেই তাঁর প্রথম কাজ ছিল একটি মসজিদ নির্মাণ করা। কুবায় পৌঁছার পরপরই তিনি সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এই কুবা ছিল আসও গোত্রের একটি এলাকা। কুবা ছেড়ে যখন তিনি নজজার (খাযরাজ গোত্রের শাখা) এলাকায় প্রবেশ করেন তখন পুরাতন মসজিদটির আরো সম্প্রসারণ করেন। মসজিদের সঙ্গেই ছিল নবীজীর আবাস-ব্যবস্থা। মসজিদের একটি অংশকে লেখাপড়ার স্থান হিসাবে নির্ধারণ করে রাখা হয়। এ স্থানটিকে বলা হত আল-সুফফা। এর অর্থ ডায়াস বা প্লাটফরম। দিনের বেলা এটা স্কুল হিসাবে ব্যবহৃত হত। আর যে সমস্ত ছাত্রের অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা ছিল না, তারা এখানেই রাত্রিযাপন করতেন।

বস্তুতপক্ষে এটাই ছিল ইসলামের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। আবাসিক সুযোগ-সুবিধার জন্য ভর্তুকি দেয়া হত। ভর্তুকির অর্থ আসত রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ ও ব্যক্তিগত অনুদান থেকে। তাছাড়া জনগণ এতে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করতেন। যেমন, ফসল কাটার সময় প্রত্যেক আনসার সাহাবী এক কাঁদি খেজুর দান করতেন। আস-সুফফার একটি উঁচু স্থানে এগুলো ঝুলিয়ে রাখা হত। যখন খেজুর পাকত এবং নিচে ঝরে পড়ত তখন আস-সুফফায় বসবাসকারী গরীব ছাত্ররা এগুলো কুড়িয়ে খেতেন। খেজুরের কাঁদিগুলো পাহারা দেওয়ার জন্য একজন লোকও নিয়োগ করা হয়েছিল। মুয়াজ ইবন জাবাল (রা) নামের একজন খ্যাতিমান সাহাবী এ দায়িত্ব পালন করেন। বস্তুতপক্ষে তিনি ছিলেন খুবই দানশীল। তিনি অতিরিক্ত দানশীলতার কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অবশেষে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে আবাসভূমি বিক্রি করে দেন। এভাবেই তিনি দেউলিয়া হয়ে পড়েন। তখন তিনি আস-সুফফায় চলে আসেন।

আস-সুফফায় দু’ধরনের ছাত্র ছিলেন। প্রথমত, সার্বক্ষণিক ছাত্রবৃন্দ। দ্বিতীয়ত, এমন কিছু ছাত্র, যাঁরা আশ্রয়হীন হওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে এখানে থাকতেন। এঁদের সংখ্যা কখনো কমে যেত, কখনো আবার বেড়ে যেত। খলীফা ওমর (রা)-এর পুত্র আবদুল্লাহ (রা)-ও ছিলেন এ রকম একজন ছাত্র। জনগণের অনুদান দিয়ে আস- সুফফার ছাত্রদের ব্যয়ভার নির্বাহ করা হত। অনুদান আসত নবী করীম (সা) ও সাহাবীগণের পরিবার-পরিজনদের কাছ থেকে। বর্ণিত আছে যে, একবার সাদ ইবন উবাদা (রা) আস-সুফফার ৮০ জন আবাসিক ছাত্রকে রাতের খাবারের জন্য দাওয়াত করেছিলেন। আস-সুফায় কি পরমাণ ছাত্র ছিলেন, তাদের থাকা-খাওয়া কীভাবে চলত, উপরের আলোচনা থেকে তা বোঝা যায়। ছাত্রদের ব্যয়ভার বহন করার জন্য কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতেও অনুদান দেওয়া হত। কিন্তু আস-সুফফার ছাত্রগণ পরগাছা বা পরনির্ভরশীল ছিলেন না। অধ্যয়নের পাশাপাশি তাঁরা কাজ ও করতেন। শুধুমাত্র অর্থ সংগ্রহ নয়; বরং উপার্জন করবে ও অধ্যয়ন চলবে- এটাই ছিল নীতি। একবার আস-সুফফার একজন ছাত্র ইন্তিকাল করেন। ধর্মীয় রীতি অনুসারে তাকে গোসল দেওয়া হচ্ছিল। তখন তাঁর কাছে দু’টো স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেল। এ কথা শুনে নবী করীম (সা) অনেকটা বিরক্ত হলেন। সম্ভবত সেটা এ কারণে যে, যাঁর এত পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ জমা আছে। অপরের দান বা অনুগ্রহের উপর তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই।

আস-সুফফায় ইসলামের প্রাথমিক বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হত। বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের দায়িত্ব বিভিন্ন শিক্ষকের উপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। কারো দায়িত্ব ছিল ছাত্রদের লিখতে ও পড়তে শেখান। যাদের লেখা ও পড়ার কৌশল শেখা হয়ে যেত, তাদের বলা হত অন্যদেরকে ইতিমধ্যে নাযিলকৃত কুরআনের আয়াতসমূহ শিখতে। সম্ভবত কাউকে কাউকে ইসলামের বিধি-বিধান, সুন্নাত সালাত, ইবাদত- বন্দেগী প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার জন্য বলা হত। নও-মুসলিমগণের মধ্যে অনেকেই বসবাস করতেন মদীনার বাইরে। তাঁরা মাঝেমধ্যেই মদীনায় আসতেন। তখন তাঁদের প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত। একটি হাদীসে মদীনা সফরে আসা আবদ-কায়েস গোত্রের লোকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সা) তাঁদের দেখাশোনার ও আতিথেয়তার দায়িত্ব আনসারদের উপর ন্যস্ত করেন। পরে তাদেরকে আনসারদের আদর-আপ্যায়ন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। জবাবে আবদ-কায়েস গোত্রের লোকেরা কৃতজ্ঞতার সাথে বললেন, আনসাররা আমাদেরকে নরম রুটি খেতে দিয়েছেন। থাকতে দিয়েছেন নরম বিছানায়। তাঁরা কুরআনের আয়াত শিখিয়েছেন, সালাত আদায়ের নিয়ম-নীতি ও সুন্নত সম্পর্কে তালিম দিয়েছেন। বস্তুতপক্ষে এটা সম্ভব হয়েছিল এ কারণে যে, আস-সুফফায় জ্ঞান- বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তালিম দেওয়া হত। শত ব্যস্ততার মাঝেও নবী করীম (সা) মাঝেমধ্যে দু-একটি ক্লাস নিতেন। যখনই সময় পেতেন তিনি চলে আসতেন আস-সুফফায়। ব্যস্ত সাহাবীরাও তখন ছুটে যেতেন সেখানে এবং গভীর মনোযোগ- সহকারে ক্লাসে হাযির থাকতেন। এ বিষয়ে চমৎকার একটি হাদীস রয়েছে। একবার নবী করীম (সা) তাঁর ব্যক্তিগত নিবাস থেকে মসজিদে এলেন। সেখানে দু’টো দল দেখতে পেলেন। একটি দল তসবীহ পড়ছে, অন্য দলটি বিদ্যাচর্চা করছে। নবীজী বললেন: দু’টি দলই ইবাদতে মশগুল রয়েছে। তবে যে দলটি বিদ্যাচর্চায় মগ্ন, সেটাই উত্তম। একথা বলে নবীজীও সে দলে যোগ দিলেন।

স্কুল হিসেবে মসজিদ

আস-সুফফা চালু হওয়ার পর পরই নবীজী আরো কতগুলো স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বালাযুরী উল্লেখ করেছেন যে, নবীজীর আমলে মদীনায় ৯টি মসজিদ ছিল। নবীজী ঘোষণা দেন যে, তোমরা স্থানীয় মসজিদে যাবে এবং প্রতিবেশীদের নিকট লেখাপড়া শিখবে। তোমাদের ব্যাপকহারে কেন্দ্রীয় মসজিদে আসা অন্যাবশ্যক। সম্ভবত আস- সুফফায় ছাত্রসংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ার আশংকায় তিনি এরূপ করেছিলেন। কারণ, এর ফলে তাদের প্রত্যেকের লেখাপড়া বিঘ্নিত হবে। পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে শিশুরা বঞ্চিত হবে শিক্ষার সুযোগ থেকে। সম্ভবত, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পরিবহণ ও যোগাযোগ সমস্যা।

শিক্ষার প্রসারের জন্য নবী করীম (সা) মদীনার বাইরেও শিক্ষক পাঠাতেন। সেটা এ কারণে যে, দিনে দিনে বিভিন্ন স্থানের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে এবং ক্রমবর্ধমান মুসলমানদের শিক্ষা দেওয়ার সুবিধার্থে শিক্ষক প্রেরণের জন্য আবেদন আসতে থাকে। প্রসঙ্গক্রমে নবীজীর হিজরতের পূর্বে ঘটেছিল, এমন একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। মদীনার কিছুসংখ্যাক লোকের ইসলাম গ্রহণ এবং আকাবায় আনুগত্যের শপথ গ্রহণের পর তাঁরা একজন শিক্ষকের জন্য নবীজীর কাছে আবেদন করেন। তখন মুস’আব ইবন উমায়র (রা)-কে মদীনায় পাঠান হয়েছিল। আরো বর্ণিত আছে যে, সে সময় পর্যন্ত কুরআন করীমের যে অংশটুকু নাযিল হয়েছিল, তার একটি অনুলিপি তিনি আকাবার শপথ গ্রহণকারীদের দিয়েছিলেন। এটা ব্যবহৃত হত পাঠ্য- উপকরণ হিসাবে। তাঁরা তা স্থানীয় মসজিদে এনে সরবে তিলাওয়াত করতেন। ঐতিহাসিকগণের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মদীনা শহরেই সর্বপ্রথম সরবে কুরআন তিলাওয়াত করার রীতি শুরু হয় এবং বনু জারিক গোত্রের আনসাররা ছিলেন এর প্রথম উদ্যোক্তা।

নবী করীম (সা) একদিকে শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, অপরদিকে জ্ঞান অর্জন-প্রক্রিয়ায় উৎসাহ দানের যথেষ্ট ব্যবস্থা রেখেছিলেন। এমনকি প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও জ্ঞান অর্জনের পথকে সুগম করে দেওয়া হত।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বদর যুদ্ধের সময় অসংখ্য মুশরিককে বন্দী করা হয়। নবী করীম (সা) শিক্ষিত বন্দীদের নিকট থেকে মুক্তিপণ দাবি করেন নি; বরং মুক্তিপণের পরিবর্তে তাদের প্রত্যেককে দশজন করে মুসলমান শিশুকে লেখাপড়া শেখানোর শর্ত আরোপ করেছিলেন।

বস্তুতপক্ষে শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে এটা একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। একজন হাদীস শাস্ত্রবিশারদ এ ঘটনাটিকে ‘একজন অমুসলিমকে শিক্ষা প্রদানের অনুমতি’ শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বদরের যুদ্ধের ময়দান থেকে যাদের বন্দী করে আনা হয়েছিল তারা সবাই ছিল অমুসলিম, মুশরিক। অথচ তাদের উপর কোমলমতি মুসলমান শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হল। এ ঘটনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, অমুসলিমের নিকট থেকে জ্ঞান অর্জন করা বিধিসম্মত এবং ইসলামী বিধানমতে একজন মুসলমানের জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টায় কোন কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। অনুরূপভাবে আরেকটি উদাহরণ থেকে আমরা একটি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি। তাবারীর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মুয়াজ ইবন জাবাল (রা) ছিলেন ইয়ামনের গভর্নর। তাঁর অন্যান্য কাজের মধ্যে বিভিন্ন জেলায় শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছিল অন্যতম। এ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জেলায় সফর করার জন্যও তাঁকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। আমর ইবন হাজমকে ইয়ামনের গভর্নর হিসাবে নিয়োগদানের সময়ও অনুরূপ নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল। একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে তা সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ জাতীয় নির্দেশনামা থেকে এটা স্পষ্ট যে, নিজ নিজ কর্ম-এলাকার জনগণের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়াটা একজন গভর্নরের দায়িত্ব। স্বাভাবিকভাবেই এটা হবে ইসলামী শিক্ষা এবং মুসলমানরা হবে শিক্ষার্থী।

কুরআনের বিধানমতে অমুসলিমদেরকে ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের মত ধর্মীয় চাহিদাগুলো তারাই স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করবে। আবার এগুলো পরিপূরণের ব্যবস্থাও তারাই নেবে। রাষ্ট্রকেই যে অমুসলিমদের শিক্ষার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে- স্পষ্টভাবে একথা কোথাও বলা হয়নি। অবশ্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। তবে নবী করীম (সা) যে সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেখানে অমুসলিমরা পূর্ণ স্বাধিকার ভোগ করত৷ তারাই উত্তমভাবে শিক্ষা সংক্রান্ত চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারত। একজন খ্রিস্টান ছাত্র একটি স্কুলে কুরআন সেখার জন্য একজন ভাল মুসলমান শিক্ষক পেত। কিন্তু বাইবেল শেখার জন্য একজন ভাল শিক্ষক হয়ত পেত না। আর সে কারণেই অমুসলিমদের স্বার্থেই তাদের স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার ছিল। সেখানে তারা নিজেদের শিক্ষকদের নিকট থেকে নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, কখনো কখনো ইয়াহুদীরা নবীজীর কাছে আসত এবং ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হত। এ ধরনের বিতর্কের ফলাফল মাঝে মাঝে প্রকৃত অর্থেই ফলপ্রসূ হত। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে, একবার ইয়াহুদীরা দু’জন ছেলেমেয়েকে নবীজীর কাছে নিয়ে আসে এবং অভিযোগ করে বলে যে, এরা অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়েছে। এদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত। নবীজী কিন্তু নিজের বিবেচনা অনুসারে কোন ব্যবস্থা নিলেন না, অথবা ইসলামী বিধানও প্রয়োগ করলেন না; বরং এ জাতীয় অপরাধের জন্য তাওরাতে কী ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে তা জানতে চাইলেন। ইয়াহুদীরা মিথ্যার আশ্রয় নিল এবং বলল: তাওরাতের বিধান অনুসারে এ জাতীয় অপরাধের জন্য অপরাধীদের মুখমণ্ডলকে কালিমালিপ্ত করতে হবে। তাদেরকে বসান হবে একটি গাধার পিঠে, তাদের মুখ থাকবে পেছনের দিকে। এরপর তাদের ঘুরান হবে গোটা শহরে এবং ঘোষণা দেওয়া হবে তাদের অপরাধ সম্পর্কে। নবী করীম (সা) অভিমত ব্যক্ত করেন যে, তাওরাতে অন্যরকম শাস্তির বিধান রয়েছে। তিনি একটি তাওরাত আনতে বললেন। দেখা গেল যে, এ ধরনের অপরাধের জন্য তাওরাতে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার বিধান রয়েছে। অবশেষে ইয়াহুদী আইন অনুযায়ী তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হল।

প্রধান পাঠ্যসূচি হিসাবে কুরআন

প্রসঙ্গক্রমে শিক্ষার আরেকটি বিষয়ের উপর সবিস্তারে আলোচনা করা উচিত- অবশ্য এ আলোচনাটি সম্পূর্ণরূপে অনুমান-নির্ভর। নবী করীম (সা) অবশ্যই জ্ঞান- বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে পূর্ণ সজাগ ছিলেন। নবীজী এটাও চাইতেন যে, মুসলমানরা এসব বিষয়ে শিক্ষা লাভ করবে। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তে একটি গ্রন্থকেই অগ্রাধিকার দিবেন। আর তা হল কুরআন শরীফ। যার যে বিষয়ে আগ্রহ থাকুক না কেন, প্রত্যেকেই এ গ্রন্থ অধ্যয়ন করবে। কেউ যদি কুরআনুল করীম বার বার অধ্যয়ন করে তাহলে সে যেমন নিজের আগ্রহের বিষয়টি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে; আবার অল্প করে হলেও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কেও সে জানতে পারবে। হতে পারে যে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, অন্যান্য বিষয়সম্পর্কিত জ্ঞান তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। তবু এই জ্ঞান বিভিন্নভাবে কাজে আসতে পারে। কুরআন পাকের আলোচনা কেবলমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী বা নীতিকথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা সম্পকে- ও বিস্তর আলোচনা রয়েছে কুরআন পাকে।

তাওরাতে ইয়াহুদীদের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা রয়েছে। ব্যতিক্রম শুধুমাত্র সূচনা অধ্যায়ে। এখানে হযরত আদম (আ) থেকে মূসা (আ) পর্যন্ত ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যাবে। অনুরূপভাবে গসপেল হল ঈসা (আ)-র জীবনেতিহাস। পক্ষান্তরে কুরআন পাককে আরব জাতির ইতিহাস বলা যাবে না, অথবা শুধুমাত্র নবী করীম (সা)-এর জীবনকে অবলম্বন করে এটা রচিত হয়নি। এটা হল সমগ্র মানব জাতির ইতিহাস। অসংখ্য রাজা-বাদশাহ, নবী-রাসূল, দেশ ও জাতির কাহিনী এখানে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। মুসলমানরা এগুলো থেকে শিক্ষা নেবে। তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে পূর্ণ দায়িত্বের গভীর অনুভূতি এবং তারা জীবন নির্বাহ করবে তদনুসারে। কুরআন পাকে মিসর, ব্যাবিলন এবং ইয়ামন ও ছাড়াও অনেক দেশ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে ফুল কিল নামে একজন নবীর কথা বলা হয়েছে। সম্ভবত তিনি ছিলেন ভারতীয় অঞ্চলের নবী। ফুল কিল-এর শাব্দিক অর্থ ‘কিল-এর মানুষ’। ভারতে বেনারাস-এর পাশে কপিলাবস্তু নামে একটি জায়গা আছে। সম্ভবত কপিলাবস্তুর আরবী সংস্করণই হল কিল। বস্তুতপক্ষে এটাই বুদ্ধের জন্মস্থান। খ্যাতিমান ভারতীয় পণ্ডিত মাওলানা মঞ্জুর আহসান গিলানী ‘ফুল কিফুল’- এর এরূপ ব্যাখ্যাই করেছেন। তিনি তাঁর ব্যাখ্যার স্বপক্ষে কুরআন পাক থেকে সূরা ‘তীনএর’ তিনটি আয়াতেরও উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আয়াতগুলো হলো ৯:১-৩।

তাফসীরকারগণের মতে উপরোক্ত সূরায় আরো চারজন নবীর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যায়তুনকে ইঙ্গিত করা হয়েছে ইয়াহুদীর সঙ্গে। তারা ছিল যায়তুন পর্বতের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। ‘সিনাই’ শব্দ দিয়ে মূসা (আ)-র তুর পর্বতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর ‘নিরাপদ নগরী’ বলতে বোঝান হয়েছে মক্কা শহরকে। কিন্তু আয়াতের প্রথম শব্দ ‘তীন’ দিয়ে কী বোঝান হয়েছে? তাফসীরকারগণ এর বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ এ শব্দটি দিয়ে ইবরাহীম (আ)-কে বুঝিয়েছেন। কেউ কেউ আবার অন্যান্য নবীগণের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু ইবরাহীম (আ) অথবা নবীগণের জীবনে ‘তীন’ শব্দের কোন তাৎপর্য নেই। পক্ষান্তরে মাওলানা গিলানী এরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, তীন হল একটা বন্য গাছ। এই গাছের নিচে বসেই বুদ্ধ প্রথম ঐশীবাণী লাভ করেন- বুদ্ধের অনুসারীদের বিশ্বাস এরকমই। এবং এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য নেই। মাওলানা মনজুর আহসান গিলানীর অনুমানটা এ রকম যে, কুরআনুল করীমে বিশ্বের প্রধান প্রধান সকল ধর্মের বিবরণ রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের উল্লেখও সেখানে থাকবে, তবে হয়ত খুবই সূক্ষ্মভাবে হতে পারে যে, আরবরা বুদ্ধ সম্পর্কে বেশি কিছু একটা জানত না। তাই কুরআন পাকেও তার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা স্থান পায়নি।

এটা স্পষ্ট যে, কুরআন পাকের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এখানে ইতিহাস সম্পর্কে যেমন আলোচনা রয়েছে, তেমনি বর্ণনা রয়েছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে। বিজ্ঞানের বিষয়সূচির মধ্যে রয়েছে জীববিদ্যা, সমুদ্রবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিজ্ঞান, স্ত্রীরোগবিজ্ঞান ইত্যাদি। কুরআন থেকে আমরা আরো জানতে পারি সমুদ্রের ঝড়, জাহাজের পাল, গভীর সমুদ্রের মণি-মুক্তা ও প্রবাল প্রভৃতি বিষয়ে।

একজন মানুষের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা থাকতে পারে। তবে প্রত্যেক মুসলমানকেই বাধ্যতামূলক মৌলিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বলা যেতে পারে যে, এটা ছিল নবী করীম (সা)-এর স্থির নির্দেশ। আর কুরআন পাকের মধ্যে যেহেতু বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত আলোচনা স্থান পেয়েছে, সেহেতু কুরআন তিলাওয়াত করার জন্য তাকীদ দেওয়া হয়েছে।

নবী করীম (সা)-এর যমানায় কলা এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার ততটা বিকাশ ঘটেনি। তবে আবশ্যকীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে মানুষের ঠিকই ধারণা ছিল এবং এগুলো ক্রমবিকাশের ধারায় যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল। এ রকম একটি বিষয় ছিল চিকিৎসাবিদ্যা। সে আমলের চিকিৎসক ও চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা অনেক কথাই জানতে পারি। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, একবার একজন সাহাবী অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী করীম (সা) তাঁকে দেখতে যান। এবং আশেপাশে কোন চিকিৎসক পাওয়া যাবে কি না, সে বিষয়ে জানতে চান। তাঁকে দু’জন ডাক্তারের নাম বলা হল। দু’জনের মধ্যে ডাক্তার হিসাবে যিনি ভাল ও অভিজ্ঞ নবীজী তাকে ডাকতে বললেন।

উপরোক্ত ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, নবী করীম (সা) কোন বিষয়ে গভীর জ্ঞানের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন এবং একজন বিশেষজ্ঞ দিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থাৎ একজন অপরিপক্ক চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রকে তিনি অনুমোদন করেন নি। একজন অপেশাদার চিকিৎসকদের অজ্ঞতা যে সমাজের জন্য কতখানি ক্ষতিকর হতে পারে সে বিষয়ে তিনি পুরোপুরি সজাগ ছিলেন। হাদীসে বর্ণিত আছে যে, এ ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থাকে তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। এমনকি যথাযোগ্য প্রশিক্ষণ ব্যতীত যারা চিকিৎসাপত্র প্রদান করে, তাদের শাস্তির বিধান রেখেছেন।

একটি বিজ্ঞান হিসাবে জ্যোতির্বিদ্যার উপরও যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কুরআন শরীফেও জ্যোতির্বিদ্যার উল্লেখ রয়েছে এবং সুবিধাগুলো বর্ণিত হয়েছে বিস্তারিতভাবে। জ্যোতির্বিদ্যার সাহায্যেই একজন পর্যটক রাতের বেলায় পথ চলতে পারে। এ বিদ্যার সাহায্যেই হজ্জের মওসুম ও সময় নির্ধারণ করা যায়। এমনকি নবী করীম (সা)-এরও এ বিষয়ে যথেষ্ট পাণ্ডিত্য ছিল। হিজরতের পর কুবায় মসজিদ নির্মাণ কালে কিবলা নির্ধারণ করা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শুধুমাত্র অনুমানের উপর নির্ভর করে এটা নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে নবী করীম (সা) এ সমস্যার সমাধান বাতলে দেন। আসলে জ্যোতির্বিদ্যা সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানই এ সময়ে বিশেষ কাজে এসেছিলো। তিনি বহুবার জেরুযালেম সফর করেন। বস্তুতপক্ষে বাণিজ্য উপলক্ষে আরো দূরের শহর বসরায় যান। সে আমলে উটই ছিল একমাত্র বাহন এবং সফর করতে হত রাতের বেলা। চাঁদ-তারার গণনার মাধ্যমে একজন পর্যটক কিভাবে জেরুযালেম পৌঁছে, সে অভিজ্ঞতা তিনি সে সফরেই অর্জন করেছিলেন। কোন্ তারার অবস্থান দেখে পর্যটকরা জেরুযালেম থেকে মক্কা বা মদীনা সফর করে তিনি তা-ও জানতেন। এ সমস্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সাহায্যে অনায়াসেই তাঁর পক্ষে কিবলা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছিল।

উপরোক্ত ঘটনা ছাড়া আরো অনেক উপমা-উদাহরণ রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে জ্যোতির্বিদ্যাচর্চাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তাছাড়া পারিবারিক বংশতালিকা সংরক্ষণ-কৌশল অধ্যয়নের উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইতিহাস-চর্চা ছাড়াও এর কতকগুলো ব্যবহারিক উপকার রয়েছে। যেমন, যে সকল ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম করা হয়েছে, তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা থাকলেও এ বিদ্যা অধ্যয়নের মাধ্যমে তার প্রতিকার করা যায়। আবার কিছু বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নবী করীম (সা)-এর পৃষ্ঠেপোষকতা ছিল উল্লেখ করার মত। উদাহরণ হিসাবে সমরবিজ্ঞানের কথা বলা যেতে পারে। সমরবিজ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি জনগণকে অবহিত করেছেন। এর ফলে তাদের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।

টিকা-টিপ্পনীসহকারে কুরআন তিলাওয়াত করলেই আমরা বিভিন্ন বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারি। কুরআন শরীফে বিভিন্ন ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ ও বিশ্বাস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। পরে এগুলোকে আবার খণ্ডনও করা হয়েছে। যারা বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক অধ্যয়নে আগ্রহী তাদেরকে বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে হবে। এজন্য তাদেরকে কুরআনের তাফসীর বা অন্যান্য গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে হবে। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা এবং ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে এটা খুবই সহায়ক হবে। উদাহরণ হিসাবে এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। একজন ফরাসি সন্ন্যাসিনী একবার ইসলাম ধর্মের বিহুবিবাহ সম্পর্কে আপত্তি তোলে। তাকে বলা হল যে, অন্য যে কোন ধর্মের একজন অনুসারী এ প্রশ্ন তুললে সেটা গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু খ্রিস্টধর্মের একজন সচেতন ও শিক্ষা-অনুসারীর এ আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তোমার ধর্মবিশ্বাস অনুসারে প্রতিটি সন্ন্যাসিনী-ই প্রভুর স্ত্রী। অর্থাৎ তার স্বামীর লক্ষ লক্ষ স্ত্রী রাখার স্বাধীনতা আছে। সেক্ষেত্রে একজন মুসলমান পুরুষের পক্ষে মাত্র চারজন স্ত্রী রাখার বিধানকে সে সমালোচনা করে কিভাবে? তাছাড়া একজন পুরুষ কেবলমাত্র এ শর্তে চারজন স্ত্রী রাখতে পারে যে, তারা সবাই হবে সমমর্যাদার এবং তাকে সকল স্ত্রীর প্রতি সুবিচার করতে হবে। সেই সন্ন্যাসিনী এ যুক্তিতে খুবই অভিভূত হয়। সে আশ্রম পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। আরো দু’বছর সে এ বিষয়ে তার অধ্যয়ন অব্যাহত রাখে, অবশ্য পত্র যোগোযোগের মাধ্যমে। পরে সে ইসলাম গ্রহণ করে মুলমান হয়ে যায়। তার বর্তমান নাম হাজ্জা তাহিরাহ।

***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button