জীবিকা অর্জনে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আদর্শ

রচনায়ঃ মুহাম্মদ আবু তাহের সিদ্দিকী

জীবনধারণের জন্য জীবিকা অর্জন অপরিহার্য। জীবমাত্রই জীবিকার মুখাপেক্ষী। মানুষ ব্যতীত অন্যান্য হাজার হাজার প্রজাতির সৃষ্টিরাজি প্রাকৃতিকভাবে লালিত- পালিত হয়ে থাকে। কিন্তু মানব জাতিকে জীবিকা অর্জন করে বাঁচতে হয়। জীবন- মরণ থেকে শুরু করে সবকিছুই তার অর্জিত জীবিকার মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। জন্মের পর থেকে উপার্জনক্ষম হওয়া পর্যন্ত বটেই, জন্মের আগেও প্রত্যেক মানবসন্তান তার পিতা-মাতার অর্জিত জীবিকা গ্রহণ করেই বেঁচে থাকে, প্রতিপালিত হয়। একমাত্র বাতাসের অক্সিজেন বিনা অর্থব্যয়ে অর্জিত হয়। তবে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে অক্সিজেনও ক্রয় করে ব্যবহার করতে হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানব জীবনের সবকিছুই অর্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

সৃষ্টিজগতে মানবজাতি ব্যতীত কারও অর্থ উপার্জনের প্রয়োজন হয় না। সুতরাং কেউই অর্থ সঞ্চয় করে না। সর্বশক্তিমান রিযিকদাতা আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যেক সৃষ্টিকে যে রিযিক সরবরাহ করেন তা খেয়েই তারা দিনাতিপাত করে। কিন্তু মানব জাতির জন্য সুযোগ রয়েছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থোপার্জনের, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ সঞ্চয়ের। এ সুযোগের ব্যবহার করে মানুষ অর্থোপার্জন করে। অনেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে, অনেকে পরিমিত পরিমাণে অর্থোপার্জন করে। অনেকে বৈধ-অবৈধ বিবেচনা না করেই সম্পদ উপার্জন করে, জায়গা-জমির মালিকানা অর্জন করে থাকে। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আদর্শের প্রশ্ন এখানেই নিহিত। সম্পদ উপার্জনের ব্যাপারে অন্যান্য মতাদর্শে হালাল-হারামের বিধি-বিধান কিংবা কঠোরতা না থাকলেও রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আদর্শে এর বিশদ দিকনির্দেশনা রয়েছে। ইসলামের হালাল-হারামের বিধানের আলোকেই মুসলিম উম্মাহর জীবন পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেননা কথায় আছে- ‘অর্থই সব অনর্থের মূল’- অর্থ থেকে অনর্থের সূত্রপাত ঘটে। অর্থের জন্য পাপাচার ঘটে, অর্থের জন্য হানহানিও হয়।

আল-কুরআন ও আল হাদীসে বর্ণিত হালাল-হারামের বিধান অনুসরণ করতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন তাকওয়ার। তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় না থাকলে কখনও কোন বিধান মানা সম্ভব নয়। তাকওয়াই অসৎ পথ থেকে বিরত রেখে সৎপথে পরিচালিত করে। হযরত উমর (রা) মুত্তাকীর উদাহরণ দিয়ে বলেছেন: কোন খুঁটিতে বাঁধা পশু যেমন তার রশির সীমা পর্যন্ত চলে আবার নির্দিষ্ট জায়গায় ফিরে আসে, তেমনি মুমিনের জীবনও খুঁটিতে বাঁধা। তার চলার জন্য রয়েছে আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আদর্শ। তাঁর আদর্শ ভারসাম্যপূর্ণ, উগ্রতা বা শঠতা তাঁর আদর্শের বিপরীত। এটাকে সর্বোত্তম আখ্যায়িত করে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন:

নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহর জীবনে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে। তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য। (সূরা আহযাব:২১)

জীবিকার্জনের জন্য বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ

ইসলামে শুধু নামায-রোযার পেছনে সময় ব্যয় করে রিযিকের সন্ধান থেকে বিরত থাকতে নিষেধ করা হয়েছে; বরং নামাযের পরপরই জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঘরের কোণায় আল্লাহর উপর ভরসা করে বসে থাকলে চলবে না। উপার্জনের জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে। ইরশাদ হয়েছে:

যখন তোমাদের নামায সম্পন্ন হবে তখন আল্লাহর অনুগ্রহের (জীবিকার) সন্ধানে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়। আর আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা জুমুআ : ১০)

একবার মদীনা শরীফে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। খাদ্যশস্যের ভীষণ অনটন। সে সময় স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যশস্যের সংবাদ পেলে নিশ্চয়ই সবার ধাবিত হওয়ার কথা। এ অবস্থা বিরাজকালে এক জুমুআয় রাসূলুল্লাহ্ (সা) খুতবা দিচ্ছিলেন। তখন খাদ্যশস্য আমাদানীকারক একটি ব্যবসায়ী দল মদীনা শরীফে আগমন করল। মুসল্লীগণের অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে অনেকেই খাদ্যশস্যের সংবাদ পেয়ে ক্রয়ের উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বেরিয়ে পড়লেন। অবশ্য তখনও খুতবা শোনা ওয়াজিব হয়নি। এদিকে রাসূল (সা) একা দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা এ পরিপ্রেক্ষিতে আয়াত নাযিল করে সতর্ক করে দিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ভাষণ শোনা বাদ দিয়ে রিযিকের পেছনে ছোটা ঠিক হয়নি। আল্লাহ্ তা’আলা হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা। সুতরাং আল্লাহ্ ও রাসূলকে বাদ দিয়ে রিযিকের চিন্তা করো না। ইরশাদ হয়েছে:

যখন তারা ব্যবসায় ও কৌতুক দেখল, তখন তারা আপনাকে দাঁড়ান অবস্থায় রেখে তার দিকে ছুটে গেল। বলুন, ‘আল্লাহ্ কাছে যা আছে তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যবসায় অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা। (সূরা জুমুআ : ১১)

উপরোক্ত আয়াতগুলো দ্বারা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, রিযিক সব সময়ই আল্লাহর কাছে কামনা করতে হবে এবং আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধান করতে হবে। এটাই রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আদর্শ। কেননা জীবিকার সন্ধান করা এবং সৎ পথে উপার্জন করাও ইবাদত। এই ইবাদত যথাযথভাবে আদায় করার প্রয়োজন আল্লাহর উপর নির্ভরতা বা তাওয়াক্কুল। আবার কোন প্রচেষ্টা ছাড়া তাওয়াক্কুল করে বসে থাকাও বোকামি। প্রচেষ্টা থাকতেই হবে। এ বিশ্বকে জীবিকার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা বিশ্বের সবকিছু মানুষের জীবিকার জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন। যত নিয়ামত আছে তা মানুষের জন্য। চাষবাস থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প স্থাপন প্রভৃতি নির্ধারিত পেশা অবলম্বন করে রিযিকের ব্যবস্থা করা যায়। আল- কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

সেই আল্লাহ্ তা’আলাই তোমাদের জন্য বিশ্বকে নরম মসৃণ বানিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তার স্কন্ধসমূহে (দিক-দিগন্তে) বিচরণ কর এবং তাঁর প্রদত্ত জীবনোপকরণ হতে রিযিক গ্রহণ কর, পুনরুত্থান তো তাঁরই নিকট অবধারিত। (সূরা মুলক: ১৫)

কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকার্জন

রিযিকের আদি পেশা হচ্ছে কৃষি। আল্লাহ্ তা’আলা বিশ্বের স্থলভাগকে কৃষি ও চাষাবাদের জন্য উপযোগী করে দিয়েছেন। মরুভূমি হোক আর মাটিই হোক সব জায়গার উপযোগী ফল-ফসল, উদ্ভিদ-তৃণলতা উৎপাদনের ব্যবস্থা তিনি রেখেছেন। আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে তিনি মাটি ও আবহাওয়াকে উৎপাদনক্ষম রাখেন। মৃত মাটি সিক্ত হয়ে জীবিত হয়ে ওঠে। বৃষ্টির পানিতে নদ-নদী, খাল-বিল ভরে ওঠে। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

পৃথিবীকে তিনি সৃষ্টিরাজির জন্য বানিয়েছেন। তাতে ফল, খেজুর গাছ, যার ফল আবরণ যুক্ত এবং খোসাবিশিষ্ট দানা ও সুগন্ধযুক্ত ফুল। অতএব তোমরা তোমাদের রবের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? (সূরা রহমান: ১০-১৩ )

এ আয়াতগুলো থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, সৃষ্টিরাজির মধ্যে ফল- ফলাদি ও শস্য ইত্যাদি একান্তই আল্লাহর দান। এগুলোর মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের পেশা আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কৃষি কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণের ঘটনা সুবিদিত। তিনি এক ইহুদীর খেজুর বাগানে এক এক বালতি পানি তুলে দেয়ার পরিবর্তে জীবিকার্জন করেছেন। সীরাতের গ্রন্থসমূহে এই ঘটনা সবিস্তারে বর্ণিত আছে। সাইয়্যেদুল মুরসালীন অর্থাৎ ‘রাসূলগণের সর্দার’ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ইহুদীর বাগানে নিজ হাতে বালতি দিয়ে পানি তুলে পারিশ্রমিক গ্রহণ করেছেন।

এখানেই তাঁর অনন্য মর্যাদা ও গৌরব। তিনি ইচ্ছে করলে সাহাবায়ে কিরাম থেকে দানদক্ষিণা গ্রহণ করে খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাসূলুল্লাহ (সা) স্বীয় হস্তে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ জমা করে রাখেন নি।

আজকাল আফসোস হয় সেসব তথাকথিত পীর-মাশায়েখদের জন্য, যারা ইসলাম প্রচারের দোহাই দিয়ে খানকায় বসে মুরীদান থেকে নজর -নেয়াজ, দান-অনুদান গ্রহণ করে সম্পদের বিরাট পাহাড় গড়ে তুলছেন, যা নবী করীম (সা)-এর আদর্শের বিপরীত। তারা কি একটু পরিশ্রম করে এ আয় করছেন? তাহলে অপরকে ধর্মের দোহাই দিয়ে সম্পদ উপার্জন করা প্রতারণা নয় কি? নবী করীম (সা) জিহাদের সময়, মুসলমানদের দুর্দিনের সময় অনুদান গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তা তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ গড়ার জন্য সঞ্চিত করেন নি; বরং যে উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে, তাতেই বিলিয়ে দেয়া হয়েছে। যুদ্ধলব্ধ গনীমতের মাল বায়তুল মালে জমা রাখা হয়েছে। সুতরাং অবৈধ উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা সম্পূর্ণ হারাম উপার্জন। আর হারাম উপার্জনের শেষ পরিণতি জাহান্নাম। হাদীস শরীফে আছে: সবচেয়ে উত্তম উপার্জন হল নিজের হাতে কামাই করে খাওয়া। আল্লাহর নবী দাউদ (আ) নিজ হাতে কামাই করে খেতেন। (এটা উদাহরণ স্বরূপ বলা হয়েছে) (তিরমিযী শরীফ)

কৃষি ও চাষাবাদে নিয়োজিত পেশার লোকেরা যদি একটু নিয়ত ঠিক রাখে তাহলে সে গাছ বা ফসল থেকে পাখি বা মানুষ কোন অংশ খেলেও তা তার জন্য সাদকা স্বরূপ হবে। হাদীস শরীফে ইরশাদ রয়েছে:

যে মুসলমানই কোন গাছ লাগায় বা ক্ষেত করে তা থেকে পাখি বা মানুষ কিছু খেলে তার তার জন্য সাদকাস্বরূপ হবে। (বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)

মানব-স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর বা নেশাজাতীয় বস্তুর উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণ ইত্যাদি রাসূল (সা) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যেমন গাঁজা, আফিম, মারিজুয়ানা, হেরোইন ইত্যাদির চাষ, ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। অনুরূপভাবে শূকর পালন করে আয় করাও নিষিদ্ধ। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশিয়ে আয় করাও সম্পূর্ণ অবৈধ। রাসূলুল্লাহ (সা) এদের প্রতি লা’নত বর্ষণ করেছেন। মোটকথা, কৃষির মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করা রাসূল (সা)-এর সুন্নত। কিন্তু মানব-স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, মানবতাবিরোধী কাজের মাধ্যমে কৃষিজাত দ্রব্যে ভেজাল মেশানো সম্পূর্ণ হারাম।

রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কার লোকদের ছাগল চরিয়েও জীবিকা নির্বাহ করেছেন ! বুখারী শরীফে সংকলিত হাদীস শরীফ দ্বারা জানা যায়, নবী করীম (সা) বলেছেন: আল্লাহ্ তা’আলা কর্তৃক প্রেরিত প্রত্যেক নবীই ছাগল চরিয়েছেন। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আপনিও ছাগল চরিয়েছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমিও মজুরীর বিনিময়ে মক্কার লোকদের ছাগল চরিয়েছি। (বুখারী শরীফ)

সুবহানাল্লাহ! রাসূলুল্লাহ (সা) স্বহস্তে উপার্জনকে কত গুরুত্ব দিয়েছেন, সহজে বোঝা যায়। জীবিকার প্রয়োজনে তিনি রাখালের পেশাও গ্রহণ করেছিলেন। এসব কিছু উম্মতের শিক্ষার জন্য, যাতে তারা সৎভাবে জীবিকার্জন করে সংসার নির্বাহ করে।

ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকার্জন

কৃষির পর আসে ব্যবসা-বাণিজ্য। ব্যবসা করাও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অন্যতম সুন্নত। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি বাণিজ্য উপলক্ষে চাচা আবূ তালিবের সাথে সিরিয়া গমন করেছিলেন। ১৭ বছর বয়সেও আরেকবার গিয়েছিলেন। তাঁর ব্যবসার সুখ্যাতির কথা অবগত হয়ে আরবের সম্ভ্রান্ত বিধবা মহিলা খাদীজা (রা) তাঁকে প্রতিনিধি নিয়োগ করেছিলেন। সে ব্যবসার আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা দেখে খাদীজা (রা) স্বয়ং যুবক মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পদরাজি আল-আমীন, আস্সাদিহ যুবকের পায়ের উপর রেখে নিজেকে সঁপে দেন। ব্যবসার সূত্র ধরেই তাঁদের শুভ বিয়ে। তারপর নবুয়তের পূর্ব পর্যন্ত ব্যবসা পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেন। অর্জিত অর্থ গরীব-দুঃখী মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। এখানেই রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সার্থকতা। তিনি ইচ্ছে করলে স্ত্রীর ধন-সম্পদ নিয়ে বসে বসে খেতে পারতেন। কিন্তু আদর্শের মূর্ত প্রতীক রাসূলুল্লাহ (সা) স্বহস্তে উপার্জিত অর্থকে প্রাধান্য দিতেন। ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত সম্মানী দিয়েই জীবন নির্বাহ করেছেন। সাহাবায়ে কিরামকে সৎপথে জীবিকার্জনের জন্য উৎসাহিত করেছেন।

আল-কুরআনে ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে বিদেশ সফরের কথা বলা হয়েছে। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধারণা দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা) নিজেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ব্যবসায়ী দলের সাথে বিদেশ সফর করেছেন। মক্কানগরী তখন সমগ্র আরব উপদ্বীপের মধ্যে বিশেষ ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশ ভ্রমণ করবে। (সূরা মুযযাম্মিল : ২০)

ব্যবসায়ের লক্ষ্য থাকতে হবে জনকল্যাণ। অনেকের মধ্যে বিক্রির সময় ওজনে কম দেয়া এবং কেনার সময় ওজনে বেশি নেয়ার প্রবণতা রয়েছে। দু’টো স্বভাবই মারাত্মক ক্ষতিকর। কেননা এর দ্বারা নিজের স্বার্থ সঠিক মাত্রায় আদায় করে অন্যের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া হয়। এটা কখনও মুমিনের চরিত্র হতে পারে না। রাসূল (সা)- এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলা ঘোষণা করেছেন:

দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে (ওজনে কম দেয়, যারা লোকের কাছ থেকে মেপে (ওজন করে) নেয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য মাপে অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে মহাদিবসে অর্থাৎ কিয়ামতের দিনে? (সূরা মুতাফফিফীন : ১-৫)

ব্যবসায়ী জেনেশুনে কোন খারাপ জিনিস ক্রেতার হাতে দিতে পারে না। খারাপ বা ভেজাল জিনিস বিক্রি করা মানেই জনগণের সাথে প্রতারণা করা। হাদীস শরীফে রাসূলে করীম (সা) কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন: যে ব্যক্তি প্রতারণা করল, কাউকে ঠকাল, সে আমার উম্মতভুক্ত নয়। (তিরমিযী শরীফ)

সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে ব্যবসা সম্পাদনকারী ব্যক্তিদের জন্য সুসংবাদ দিয়ে বলেছেন: সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পন্ন ব্যবসায়ী নবী, সিদ্দিক ও শহীদগণের সাথী হবেন। (তিরমিযী শরীফ)

অসততা ও অবিশ্বস্ততার সাথে ব্যবসা পরিচালনাকারীদের জন্য দুঃসংবাদ দিয়ে বলেছেন: হে ব্যবসায়ীরা! কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহাপাপীরূপে উত্থিত হবে। তবে সেসব ব্যবসায়ী নয়, যারা আল্লাহকে ভয় করবে, সৎভাবে লেন-দেন করবে, সততার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ)

অবৈধ উপার্জনের ব্যবসা হারাম ঘোষণা করে আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না; কিন্তু তোমাদের পরস্পর রাযী হয়ে ব্যবসা করা বৈধ। এবং নিজেদেরকে হত্যা করো না। আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। (সূরা নিসা: ২৯)

চোরাচালানী ব্যবসা কখনও জায়েয হতে পারে না। তেমনি মহিলাদের দেহব্যবসাও হারাম। কেননা এর মাধ্যমে চরিত্র বিধ্বংসী কাজ সংঘটিত হয়। চোরাচালান যেমন দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে তেমনি দেহব্যবসা জাতীয় চরিত্র ধ্বংস করে। দুটোই অপরাধ। সুতরাং ব্যবসা বললেই হালাল হবে না; বরং তার প্রকৃতি ও লক্ষ্য জানতে হবে।

চাকুরির মাধ্যমে উপার্জন

রাসূলুল্লাহ (সা) অপরের অধীনে চাকরিকালে সততা ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছেন। যদিও তিনি স্থায়ীভাবে দীর্ঘকাল চাকরি করেন নি, তবুও খণ্ডকালীন যেখানে জীবিকার জন্য শ্রম দিয়েছেন, সেখানেই তিনি আমানত রক্ষা করেছেন। সর্বদা তাঁর মধ্যে দায়িত্বপরায়ণতা ছিল। এ পর্যায়ে বিখ্যাত হাদীসটি উদ্ধৃত করাই যথেষ্ট মনে করছি:

সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। (বুখারী শরীফ)

অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা পর্যন্ত প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হতে হবে। প্রত্যেকের কর্তব্যকর্মের রেকর্ড কেরামান কাতেবীন ফেরেশতাগণ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। ফলে কেউই ভুল তথ্য দিতে পারবে না। কর্তব্যকর্মের অবহেলার দরুন তাকে জবাবদিহি করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হল চাকুরিতে ফাঁকি দিয়ে, অফিসের ক্ষতি করে উপার্জিত অর্থ তার জন্য জাহান্নামের আগুন বয়ে আনবে। সুতরাং চাকরি থেকে উপার্জন বৈধ করার একমাত্র পন্থা হলো অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা। তাহলে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আদর্শের অনুসরণ হবে। আর এভাবেই গড়ে উঠবে একটি যথার্থ কল্যাণ-সমাজ।

***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button